রুশোর সামাজিক চুক্তি তত্ত্ব
রুশো তাঁর অমর গ্রন্থ “The Social Contract“-এ সামাজিক চুক্তি মতবাদের আলোচনা করেন। তাঁর মতে, রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বে মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে বসবাস করত। প্রকৃতির রাজ্য ছিল স্বর্গের মত। সেখানে মানুষের মধ্যে কোন সংঘাত-দ্বন্দ ছিল না। মানুষ সুখে শান্তিতে জীবন অতিবাহিত করত। মানুষ ছিল সহজ, সরল ও শান্তিপ্রিয়। প্রত্যেকেই অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করত।
রুশোর মতে, প্রকৃতির এ অবস্থা ছিল ক্ষণস্থায়ী। কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভবের ফলে মানুষের মধ্যে স্বার্থপরতা জন্ম নেয়। ফলে সমাজে বিভেদের সূত্রপাত হয়। মানুষ বুঝতে পারে যে, সমাজ ক্রমে ক্রমে দুর্বিষহ হয়ে উঠছে, তাই তারা চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠন
রুশো বলেছেন, একমাত্র চুক্তির মাধ্যমে একটি সমাজ এর সদস্যদের জন্য নৈতিক স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার বিধান করতে পারে। এ ব্যবস্থায় প্রত্যেক মানুষ কর্তৃপক্ষের সাথে আনুগত্যের সামঞ্জস্য বিধান সম্ভব হয়। তিনি বলেছেন, কোন মানুষ অন্য আর একজন মানুষের স্বাভাবিক কর্তৃত্ব প্রয়োগ করতে পারে না। এখানে সমস্ত ইচ্ছা একটিমাত্র ইচ্ছায় এবং বিভিন্ন সত্তা একটিমাত্র সত্তায় পরিণত হয়।
রুশোর মতে, চুক্তি সম্পাদন করে প্রত্যেক সদস্য স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব পরিত্যাগ করে এক যৌথ ব্যক্তিত্বের সৃষ্টি করে, যার নাম সাধারণ ইচ্ছা। এভাবেই প্রকৃতির রাজ্য থেকে মানুষ সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে তাদের মনোনীত কর্তৃপক্ষের নিকট সকল ক্ষমতা ন্যস্ত করার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সংগঠন গড়ে তোলে।
সম্পর্কিত বিষয়
রুশোর সার্বভৌমত্ত্ব তত্ত্ব ব্যাখ্যা কর
টমাস হবসের সামাজিক চুক্তি মতবাদটি ব্যাখ্যা কর
রুশোর সামাজিক চুক্তির বৈশিষ্ট্য
রুশোর সামাজিক চুক্তি বিশ্লেষণ করলে কতিপয় বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। সেগুলো হলো-
১. কর্তৃপক্ষ গড়ে তোলা
প্রকৃতির রাজ্যে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানার উদ্ভব হয় এবং তা রক্ষা করার জন্য জনগণ এক শক্তিশালী কর্তৃপক্ষ গড়ে তোলেন।
২. চিরস্থায়ী চুক্তি
রুশোর মতে, এটা সমষ্টিগত চুক্তি এবং সমাজের সার্বিক কল্যাণ সাধন করা এর উদ্দেশ্য।
৩. সাম্য প্রতিষ্ঠা
চুক্তির ফলে সাধারণ ইচ্ছার নিকট ক্ষমতা অর্পণ করে জনগণ সমপর্যায়ভুক্ত হয়। প্রত্যেকে সাধারণ ইচ্ছার অংশ হিসেবে সমাজে সমান কর্তৃত্বের দাবিদার হয়।
৪. রাষ্ট্রের ব্যবহার
রুশো জনগণের দ্বারা গঠিত এ রাষ্ট্রকে বলেছেন, Public Person, অর্থাৎ কোন ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহৃত হবে না। এটি সম্পূর্ণরূপে সার্বিক প্রয়োজনে ব্যবহৃত হবে।
৫. ব্যক্তিস্বাধীনতা
রুশো ব্যক্তিস্বাধীনতার পক্ষে মতামত দেন। তিনি জনসাধারণের কল্যাণকে সরকারের যথার্থ লক্ষ্য হিসেবে বর্ণনা করেন। জনগণের বাণীই ছিল ঈশ্বরের বাণী, এ ধারণায় ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস।
৬. হস্তান্তর অযোগ্য ও নৈতিক চুক্তি
রুশো সামাজিক চুক্তিকে হস্তান্তর অযোগ্য বলে মত প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে, যেহেতু নাগরিকগণ প্রত্যেকে স্বেচ্ছায় নিজেদের বৃহৎ কল্যাণ সাধনের জন্য এ চুক্তি সম্পাদন করেছেন, সেহেতু এ চুক্তি পুনরায় অন্য কারো নিকট হস্তান্তর করা যাবে না। তাঁর মতে, কেবল স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার জন্য জনগণ রাষ্ট্র সৃষ্টি করে নি, বরং নৈতিকতার পরিপূর্ণ বিকাশের জন্যও তারা চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে।
৭. সার্বভৌম ক্ষমতার অবস্থান
রুশোর পূর্ববর্তী দার্শনিকগণ সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা না দিলেও তিনি এ সম্পর্কে যথাযথ রায় প্রদান করে বলেছেন, জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী।
৮. সাধারণ ইচ্ছা
রুশো তাঁর সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘সামাজিক চুক্তি’তে উল্লেখ করেন যে, চুক্তির মাধ্যমে সমাজ সৃষ্টির অব্যবহিত পরে মানুষের ব্যক্তিগত ইচ্ছা অর্থহীন হয়ে পড়ে। তখন মানুষের ব্যক্তিগত ইচ্ছা সমগ্র ইচ্ছায় পরিণত হয় যা থেকে জন্ম নেয় সাধারণ ইচ্ছার।