মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের সন্ধিক্ষণের দার্শনিক ম্যাকিয়াভেলি তাঁর রাষ্ট্র দর্শন ও রাজনৈতিক অবদানের জন্য স্বরণীয় হয় আছেন। তিনি ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম নিকালো ম্যাকিয়াভেলি। মাত্র ২৫ বছর বয়সে তিনি ফ্লোরেন্স স্বরাষ্ট্র ও দেশরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারি পদে অধিষ্ঠিত হন। পরে রাজনৈতিক বিপ্লব ঘটলে ১৫১২ সালে তাঁকে নির্বাসন দণ্ড দেওয়া হয়। নির্বাসনকালেই তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “The Prince” এবং “The Discourse” রচনা করেন।
রাষ্ট্রচিন্তায় ম্যাকিয়াভেলির অবদান
ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্র দর্শন উপলব্ধি করতে হলে ষোড়শ শতাব্দীর ইতালির সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে বিচার করতে হবে। তিনি এমন এক সময় রাষ্ট্র দর্শন নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন যখন জনগণ নিজেদের স্বার্থরক্ষায় ব্যাপৃত ছিল। তাঁর চিন্তাচেতনায় এমন কিছু বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান যা অন্য কোন রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যে ছিল না, যার জন্য তাকে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার জনক বলা হয়।
ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রীয় দর্শন ও রাজনৈতিক অবদান আলোচনা করলে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে তাকে কেন রাষ্ট্রচিন্তার জনক বলা হয়। নিম্নে তাঁর রাষ্ট্র দর্শন ও রাজনৈতিক অবদান আলোচনা করা হল-
১. জাতীয়তাবাদী ধারণার প্রবর্তন
ম্যাকিয়াভেলি তাঁর বিপন্ন স্বদেশ ইতালি প্রতি মমত্ববোধ প্রকাশের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটান।
২. রাষ্ট্র সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত আলোচনার উন্মেষ
ম্যাকিয়াভেলিই প্রথম রাষ্ট্র সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা করেন। সমগ্র মধ্যযুগব্যাপী রাষ্ট্রকে কল্পনা করা হতো একটি প্রাকৃতিক প্রতিষ্ঠান রূপে। শাসনকর্তা ছিলেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি এবং আইনকানুন ছিল ঐশীবাণী। ম্যাকিয়াভেলিই প্রথম ঘোষণা করেন যে, রাষ্ট্রই হল একমাত্র মানবিক প্রতিষ্ঠান।
৩. রাজনীতির বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি স্থাপন
ম্যাকিয়াভেলি তার বাস্তব অভিজ্ঞতা ও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক আরোহ পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করে রাজনীতির বৈজ্ঞানিক ভিত্তি স্থাপন করেন।
আরও পড়ুন: এরিস্টটলের সরকারের শ্রেণীবিভাগ আলোচনা কর
৪. কূটনীতি ও রণনীতি
বর্তমান বিশ্বের আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ম্যাকিয়াভেলিই মূলভিত্তি। তিনি মনে করেন, কোন দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা মুখ্য, যার জন্য যে কোন দেশে সেনাবাহিনী গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি।
৫. আইনের শাসন
ম্যাকিয়াভেলি ধর্মগ্রন্থ ও আধ্যাত্মিক আইনের পরিবর্তে বিজ্ঞানসম্মত আইনের উপর গুরুত্বারোপ করেন। আইন পালনে শাসক ও শাসিত উভয়কেই নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর মতে, রাষ্ট্রে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার্থে এবং নাগরিক জীবন ও সম্পত্তির বিধান করতে আইনের শাসন দরকার।
৬. সার্বভৌম রাষ্ট্রের ধারণা
ম্যাকিয়াভেলি আধুনিক সার্বভৌম রাষ্ট্রের ধারণার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তাঁর মতে, রাষ্ট্র সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। আর এ ক্ষমতার সাহায্যেই রাষ্ট্রে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে।
৭. ক্ষমতা সম্প্রসারণ নীতি
আধুনিক রাজনীতি ক্ষমতার রাজনীতি। ক্ষমতা লাভের পদ্ধতি, কিভাবে ক্ষমতার সম্প্রসারণ সম্ভব সে বিষয়ে ম্যাকিয়াভেলিই সর্বপ্রথম সুস্পষ্ট দর্শন প্রচার করেন।
৮. ধর্ম থেকে রাজনীতি পৃথকীকরণ
মধ্যযুগের রাজনীতিকে গির্জার বাইরে বের করে নিয়ে আসতে ম্যাকিয়াভেলির অবদান সবচেয়ে বেশি।
৯. দেশপ্রেমিক
একজন মহান দেশপ্রেমিক হিসেবে ম্যাকিয়াভেলি ছিলেন অনন্য। ইতালির জাতীয় ঐক্য অর্জনের জন্য তিনি তাঁর রাষ্ট্রদর্শনে গভীরভাবে আলোচনা করেন। গ্যারিবল্ডি, ক্যাভুর প্রমুখ জাতীয়তাবাদী নেতাগণ ম্যাকিয়াভেলির নিকট থেকে দেশপ্রেমের পাঠ শিক্ষা নেন।
১০. বাস্তববাদী দার্শনিক
পূর্ববর্তী রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণের ন্যায় ম্যাকিয়াভেলি কল্পনা বিলাসী ছিলেন না, বরং ছিলেন অত্যন্ত বাস্তববাদী। ডানিং এর মতে, “গোটা মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তাবিদেরা যখন কল্পনার রথে চড়ে রাজনৈতিক তত্ত্ব গড়ে তুলেছেন ম্যাকিয়াভেলি তখন বাস্তব ও তত্ত্বের মধ্যে সফলতার সাথে সমন্বয় সাধন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।”
১১. শাসকের চরিত্র
ম্যাকিয়াভেলির মতে, শাসকের চরিত্রে দু’টি বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত। সেগুলো হল-
ক. সৎ বা আইনী শক্তি সম্পন্ন।
খ. পাশবিক শক্তি সম্পন্ন।
১২. ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র
ম্যাকিয়াভেলির মতে, একমাত্র ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র মানুষের সার্বিক কল্যাণ সাধন করতে পারে। তাই সমগ্র মধ্যযুগে যখন ছিল ধর্মের জয় জয়কার, তখন রাষ্ট্রের মত ইহলৌকিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ম্যাকিয়াভেলি চেয়েছিলেন রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ করে তুলতে।
১৩. প্রজাতন্ত্রের গুরুত্ব
ম্যাকিয়াভেলি একদিকে রাজতন্ত্রের সমর্থন করেছেন, অন্যদিকে স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণকারী জনগণের তথা প্রজাতন্ত্রের গুণগান করেছেন। প্রথমটির উদ্দেশ্য ছিল সুসংগঠিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা এবং দ্বিতীয়টির উদ্দেশ্য ছিল প্রজাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
১৪. রাষ্ট্রীয় ঐক্য বজায় রাখা
ম্যাকিয়াভেলি রাষ্ট্রীয় ঐক্য ও শৃঙ্খলার প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করেছেন। রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য শৃঙ্খলা প্রয়োজন। তাঁর মতে, রাষ্ট্রের শক্তি বৃদ্ধি করা এবং রাষ্ট্রকে সকল দিক হতে শক্তিশালী করে তোলা হবে শাসকের একমাত্র কাজ।”