সামাজিক গবেষণার ধাপ
সামাজিক গবেষণা হচ্ছে একটি সূক্ষ্ম সুশৃঙ্খল অনুসন্ধান পদ্ধতি। কোনো বিষয় বা ঘটনা সম্পর্কে গবেষণা পরিচালনা করতে হলে সুনির্দিষ্টভাবে কতকগুলো ধাপ অনুসরণ করতে হয়। প্রতিটি সামাজিক গবেষণার ধাপ বা পর্যায়গুলোর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকলেও এগুলো পরস্পর নির্ভরশীল ও অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত। এজন্য সামাজিক গবেষণা পরিচালনার প্রাক্কালে অনেক সময় প্রথম পর্যায়েই শেষ পর্যায়ের প্রকৃতি নিরূপণ করতে হয়।
নিম্নে সামাজিক গবেষণার ধাপ গুলো আলোচনা করা হলো-
সমস্যা চিহ্নিতকরণ (Identification of the Problem)
গবেষণার প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হচ্ছে প্রচলিত সমস্যাবলি হতে গবেষণাযোগ্য সমস্যাবলি চিহ্নিত করা। কারণ, সমাজে বিরাজমান সব সমস্যাই গবেষণার উপযোগী নয়। গবেষণার সমস্যা চিহ্নিত করার সময় নিম্নোক্ত বিষয়াবলির প্রতি সচেতন থাকতে হয়-
ক) যেসব সমস্যা জটিল এবং যেগুলোর সমাধান কাম্য,
খ) যেসব সমস্যা সমাধানযোগ্য,
গ) সমস্যাটির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে অনেক কিছু জানার প্রয়োজন রয়েছে,
ঘ) সমস্যাটি বিশ্লেষণ ও পরিমাপে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের সুযোগ রয়েছে। এসব দিক বিবেচনা করে গবেষণার সমস্যাবলি চিহ্নিত করা প্রয়োজন।
সম্পর্কিত বিষয়
সামাজিক গবেষণার উদ্দেশ্য আলোচনা কর
সামাজিক গবেষণার বৈশিষ্ট্য গুলো কি কি?
সমস্যা নির্বাচন (Selection of the Problem)
গবেষণার প্রথম পর্যায়ে চিহ্নিত সমস্যাগুলোর উপর যেহেতু একত্রে গবেষণা করা সম্ভব নয় এবং সব সমস্যা সমাধানের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সমান নয়, সেহেতু চিহ্নিত সমস্যাগুলো হতে গবেষণার জন্য একটি নির্বাচন করতে হয়। গবেষণা রজন্য সমস্যা নির্বাচনের সময় নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হয়-
ক) সমস্যা, প্রভাব ও বিস্তৃতি,
খ) সমস্যার সমাধান যোগ্যতা,
গ) গবেষণার বাস্তব উপযোগিতা ও গুরুত্ব,
ঘ) গবেষণার সাফল্য,
ঙ) গবেষণার তথ্যাবলি সংগ্রহ এবং পরিমাপের সম্ভাব্যতা ইত্যাদি।
সমস্যা সম্পর্কে প্রচলিত জ্ঞান ও মতবাদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া
এ পর্যায়ে গবেষণা রজন্য নির্বাচিত সমস্যার উপর প্রকাশিত মন্তব্য, পূর্বোক্ত গবেষণা, মতবাদ এবং সমস্যার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রবন্ধ, বই-পুস্তক প্রভৃতি প্রচলিত জ্ঞান পর্যালোচনা করে দেখা হয়। এতে গবেষক সমস্যা সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান লাভে এবং সংজ্ঞা প্রদানে সক্ষম হন। অনেকের মতে গবেষণার প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে প্রাসঙ্গিক তথ্য ও প্রকাশনা পর্যালোচনা। প্রচলিত জ্ঞান ও তত্ত্বের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার গুরুত্ব অনেক। যেমন-
ক) সমস্যা ব্যক্তকরণে সহায়তা দান করে,
খ) প্রাসঙ্গিক জ্ঞানের পর্যালোচনা সমস্যার গুরুত্বকে তুলে ধরে।
গ) গবেষণার প্রাথমিক খসড়া প্রণয়নে সহায়তা করে,
ঘ) সমস্যার কার্যকরী সংজ্ঞা প্রদান সহজ হয় ইত্যাদি।
সমস্যার কার্যকরী সংজ্ঞা প্রদান (Defining the Problem)
গবেষণা পর্যায়ে এমনভাবে সমস্যাকে সংজ্ঞায়িত করা হয় যাতে সমস্যার সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় হতে একে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায়। এটি গবেষণার সামগ্রিক দার্শনিক পটভূমি তুলে ধরে, যার প্রেক্ষিতে গবেষণার লক্ষ্য নিরূপিত হয়। এ পর্যায়ে গবেষক সমস্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং গবেষণায় ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রত্যয় ও অর্থবোধক শব্দের সুস্পষ্ট সংজ্ঞা প্রদান করেন। এ ধরনের সংজ্ঞা প্রদান ব্যতীত গবেষণার বিষয়বস্তু অস্পষ্ট হয় পড়ে।
কার্যকরী অনুমান গঠন (Formulation of Working Hypothesis)
গবেষণার আরম্ভ বিন্দু হতে অনুমান গঠন করা হয়। অনুমান হচ্ছে এমন একটি অন্তরবর্তীকালীন সিদ্ধান্ত যাকে গ্রহণ এবং প্রত্যাখ্যান করার পূর্বে এর সত্যতা প্রমাণ করার প্রয়োজন রয়েছে। কার্যকরী অনুমান গবেষণার দিকনির্দেশনা করে অন্ধ অনুসন্ধানের হাত থেক গবেষককে মুক্ত রাখে। সমস্যা সম্পর্কে পূর্ব অভিজ্ঞতার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে অনুমান গঠনের ভিত্তি। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্তর।
নকশা প্রস্তুত করা (Designing the Research)
গবেষণার নকশা গবেষকের গবেষণামূলক কার্যাবলির পথ প্রদর্শক স্বরূপ। একজন প্রকৌশলীর নিকট নির্মাণ কাজের নকশা যেরূপ গুরুত্বপূর্ণ তেমনি সমাজ গবেষকের নিকটও গবেষণার নকশা গুরুত্বপূর্ণ। এতে গবেষণার বিষয়বস্তু, লক্ষ্য, যৌক্তিকতা, তথ্যের উৎস ও সংগ্রহ পদ্ধতি, তথ্য বিশ্লেষণ প্রক্রিয়া, নির্ভরযোগ্যতা, সময়, বাজেট, গবেষণাকার্যের প্রশাসনিক কাঠামো ও ব্যবস্থাপনা কার্যের প্রশাসনিক কাঠামো প্রভৃতি উপস্থাপন করা হয়।
তথ্য সংগ্রহের হাতিয়ার নির্ণয় (Determining Instruments)
এ পর্যায়ে গবেষণার তথ্য সংগ্রহের কোন পদ্ধতি ও কৌশল অবলম্বন করা হবে তা নির্ণয় করা হয়। তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা এর উপর নির্ভরশীল বটে, এটি গবেষণার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্তর। তথ্য সংগ্রহের হাতিয়ার বা উপায় নির্বাচনের সময় লক্ষ রাখতে হবে, যাতে এগুলো যথার্থ, নির্ভরযোগ্য এবং সঠিক তথ্য প্রদানে সক্ষম হয়।
তথ্য সংগ্রহ (Data Collection)
এ পর্যায়ে গবেষক তথ্য সংগ্রহকারী, তত্ত্বাবধানকারী, তথ্যসংগ্রহের সময়সীমা, ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি নির্ধারণ করেন। এসবের উপর তথ্যের সঠিকতা, গুণগত মান নির্ভর করে বলে এক্ষেত্রে গবেষককে অত্যন্ত সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে।
তথ্যের বিশ্লেষণ (Analysis of Data)
সংগৃহীত তথ্যসমূহকে প্রক্রিয়াজাত ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে গবেষক সমস্যার আনুমানিক সিদ্ধান্তের সঙ্গে সংগৃহীত তথ্যের মিল রয়েছে কি-না তা যাচাই করে দেখেন। যুক্তিসম্মত উপায়ে তথ্যের পর্যায়ক্রমিকতা বজায় রেখে তথ্যকে শ্রেণি ও সারণিবদ্ধকরণও এর পর্যায়ে করা হয়ে থাকে।
তথ্যের মূল্যায়ন ও ব্যাখ্যা (Interpretation and Evaluation of Data)
গবেষণার এ পর্যায়ে সংগৃহীত তথ্যের বিস্তারিত ব্যাখ্যার মাধ্যমে তথ্যের বিভিন্ন দিক ও পরিধি মূল্যায়ন করা হয়। এ পর্যায়ে বিশেষভাবে লক্ষ করা হয় যে, তথ্যসমূহ সমস্যা সম্পর্কে সন্তোষজনক জ্ঞান দানে সক্ষম কিনা এবং ভবিষ্যৎ অনুসন্ধানের তথ্য সহায়ক হবে কিনা সে সম্পর্কে বিশ্লেষণ করে দেখা হয়।
গবেষণার ফলাফল বা প্রতিবেদন প্রকাশ (Reporting)
গবেষণার সর্বশেষ স্তর হচ্ছে প্রাপ্ত ফলাফল সংক্ষিপ্ত ও সহজবোধ্য করে প্রকাশ করা। সামাজিক গবেষণার ফলাফল সাধরণত সারণি, রেখাচিত্র, মানচিত্র, গ্রাফ প্রভৃতির মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়ে থাকে। গবেষণা রিপোর্টে সাধারণত নিম্নোক্ত বিষয়গুলো অন্তর্ভূক্ত করা হয়ে থাকে-
ক) সমস্যার সংজ্ঞা,
খ) গবেষণার লক্ষ্য,
গ) গবেষণার পদ্ধতি,
ঘ) গবেষণার ফলাফল, এবং
ঙ) ফলাফলের ব্যবহারিক গুরুত্ব।