আলাউদ্দিন খলজির মূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা মধ্যযুগের একটি বিস্ময়কর বিষয়। উচ্চাকাঙ্ক্ষী আলাউদ্দিন খলজি ১২৯৬ সালের ১৯ জুলাই রক্তপাতের মাধ্যমে দিল্লির খলজি সিংহাসনে আরোহণ করেন। ঐতিহাসিক Stainley Lane Poole তার ‘Medieval India Under Muhammadan Rule’ গ্রন্থে আলাউদ্দিন খলজিকে “A great political economist” অর্থাৎ এক মহান রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ বলে অভিহিত করেছেন।
মূল্য নিয়ন্ত্রণের কারণ
আলাউদ্দিন খলজির মূল্য নিয়ন্ত্রণের পশ্চাতে কতকগুলো কারণ ছিল। যেমন-
ক) জনজীবনে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়ন করা।
খ) সামরিক বাহিনী লালন।
গ) মুদ্রাস্ফীতি রোধ।
আরও পড়ুন: মনসবদারি প্রথা কি?
মূল্য নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন ক্ষেত্র
আলাউদ্দিন খলজি যে সকল দ্রব্যের মূল্য নির্দিষ্ট করে বেঁধে দেন সেগুলো হলো-
ক) ভোগ্যপণ্য
গম প্রতি মণ সাড়ে ৭ জিতল, চাউল প্রতি মণ ৫ জিতল, ডাল প্রতি মণ ৫ জিতল, চিনি প্রতি সের সাড়ে ১ জিতল, লবণ আড়াই মণ ৫ জিতল, তেল ৩ সের ১ জিতল, ঘি সাড়ে ২ সের ১ জিতল। গুড় প্রতি সের ১/৪ জিতল, মাসকলাই প্রতি মণ ৫ জিতল, বার্লি প্রতি মণ ৪ জিতল।
খ) বস্ত্রের মূল্য তালিকা
লংক্লথ ২০ গজ ১ তংকা, মোটা ক্লথ ৪০ গজ ১ তংকা, চাদর ১০ তংকা, দিল্লি কাস সিল্ক ১৬ তংকা, আরোজ সিল্ক ৬ তংকা, অর্ধ পশম মিশ্রিত হালকা সিল্ক ৩ তংকা।
গ) গৃহপালিত পশু
১ টি প্রথম শ্রেণীর ঘোড়া ১০০ থেকে ১২০ তংকা, ১ টি দ্বিতীয় শ্রেণীর ঘোড়া ৮০ থেকে ৯০ তংকা, ১ টি তৃতীয় শ্রেণীর ঘোড়া ৬০ থেকে ৭০ তংকা, ১ টি টাট্টু ঘোড়া ১০ থেকে ১২ তংকা, ১টি দুগ্ধবতী গাভী ৪ তংকা, ১টি দুগ্ধবতী ছাগল ১০ জিতল, ১টি দুগ্ধবতী মহিষ ৬ তংকা।
ঘ) দাস-দাসীর মূল্য তালিকা
প্রথম শ্রেণীর দাস-দাসী ১০০০ থেকে ২০০০ তংকা, দ্বিতীয় শ্রেণীর দাস-দাসী ২০ থেকে ৩০/৪০ তংকা, তৃতীয় শ্রেণীর দাস-দাসী ৫ থেকে ১২ তংকা।
মুদ্রামান
১ তংকা ছিল তৎকালীন ভারতীয় এক টাকা। এক জিতল বর্তমানে বাংলাদেশী ০.০৬ পয়সার সমান।
মূল্য নিয়ন্ত্রণ বাস্তবায়নের জন্য গৃহীত পদক্ষেপসমূহ
সুলতান আলাউদ্দিন খলজি বিভিন্ন দ্রব্যের মূল্য বেঁধে দিয়ে এটি নিয়ন্ত্রণ বা সঠিকরূপে বাস্তবায়নের জন্য কতকগুলো বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যেমন-
ক) সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ,
খ) মজুদ নিরোধ ব্যবস্থা,
গ) মুনাফা নিয়ন্ত্রণ,
ঘ) ওজন নিয়ন্ত্রণ,
ঙ) পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ ও
চ) রেশনিং প্রথা প্রবর্তন।
মূল্য নিয়ন্ত্রণের ফলাফল
আলাউদ্দিন খলজির মূল্য নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ফলাফল ছিল নিম্নরূপ-
ক) সৈন্যদের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি
ঐতিহাসিক ‘Ishwari Prasad‘-এর ভাষায়, “মূল্য নিয়ন্ত্রণর ফলে সেনাবাহিনীর শক্তি ও দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।”
খ) মুদ্রাস্ফীতি রোধ
মূল্য নিয়ন্ত্রণের ফলে মুদ্রাস্ফীতির হার কমে যায় এবং খাদ্যশস্যের দাম নমনীয় হয়।
গ) জনগণের সুখস্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধি
ঐতিহাসিক ‘Ishwari Prasad‘ বলেন, দ্রব্যাদির মূল্যের স্বল্পতা জনগণের সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধি করে। ফলে জনগণ এ স্বেচ্ছাচারী শাসনের প্রতি নিবিড়ভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে।
ঘ) ব্যবসায়ীদের ক্ষতিসাধন
ঐতিহাসিক K.S. Lal তার “History of the Khaljis” গ্রন্থে বলেন, এ ব্যবস্থায় দিল্লি অধিবাসীরা উপকৃত হলেও খাদ্যশস্যের দাম নির্দিষ্ট হওয়ায় কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং মুনাফা হ্রাস পাওয়ায় ব্যবসায়ীরা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ে।