রাষ্ট্রবিজ্ঞান হচ্ছে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল উপজীব্য বিষয়। তবে সংক্ষিপ্ত পরিসরে এর প্রকৃতি ও স্বরূপ নির্ণয় করা কঠিন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি বা স্বরূপ সম্পর্কে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্ন মত পোষণ করেছেন। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি বা স্বরূপ বিভিন্ন রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মতাদর্শ, জাতীয় রাষ্ট্রনীতি, বৈদেশিক রাষ্ট্রনীতি প্রভৃতি এককের উপর নির্ভর করে। তবে বর্তমান ‘Modern Political Theory’ সম্পর্কে অবগত হতে হলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি বা স্বরূপ সম্পর্কে জ্ঞান থাকা অত্যাবশ্যক।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান কী?
রাষ্ট্রবিজ্ঞান শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হল Political Science। এটি এসেছে গ্রিক শব্দ Polis থেকে, যার অর্থ নগর। প্রাচীন গ্রীস এবং রোমে প্রতিটি নগরকে এক একটি রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করা হতো। তাই শাব্দিক দিক থেকে আমরা বলতে পারি, নগররাষ্ট্র সম্পর্কে এবং নগর রাষ্ট্রের যাবতীয় সমস্যা এবং সমাধান নিয়ে যে শাস্ত্রে আলোচনা করা হয় তাকেই বলা হয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান।
বর্তমানে রাষ্ট্র বলতে শুধুমাত্র নগরকে বুঝায় না। সভ্যতার পরিবর্তনের সাথে সাথে রাষ্ট্রের সংজ্ঞায়ও পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে রাষ্ট্রের জনসংখ্যায় এবং ভৌগোলিক সীমানায়ও পরিবর্তন এসেছে। পূর্বে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলতে বুঝাত সে শাস্ত্রকে, যে শাস্ত্র মানুষের রাজনৈতিক জীবন নিয়ে আলোচনা করত। কিন্তু বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলতে সমাজবিজ্ঞানের সে শাখাকেই নির্দেশ করে, যে শাখায় মানুষের রাষ্ট্রীয় জীবনের নানামুখী বিষয় আলোচিত হয়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা
বিভিন্ন দার্শনিক বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। নিম্নে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা প্রদান করা হলো-
অধ্যাপক গিলক্রিস্ট (Gilchrist) এর মতে, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্র ও সরকার নিয়ে আলোচনা করে।” (Political science deals with the state and government.)
পল জানেট (Paul Janet) এর মতে, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমাজবিজ্ঞানের সে অংশ যা রাষ্ট্রের ভিত্তি এবং সরকারের বিভিন্ন নীতিমালা নিয়ে আলোচনা করে।” (Political science is that part of social science which treats of the foundations of the state and principles of the government.)
অধ্যাপক গেটেল (Gettel) এর মতে, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করে।” (Political science is the study of the state in the past, present and future.)
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি বা স্বরূপ
সামাজিক বিজ্ঞানে অন্যতম শাখা হিসেবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি বা স্বরূপ সম্পর্কে ধারণা থাকা অত্যাবশ্যক। সুদূর গ্রিসের রাষ্ট্রচিন্তা তথা ‘Western Political Thought’ থেকে বর্তমানে ‘Modern Political Thought’ পর্যন্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও তার সাথে সম্পর্কিত বিষয়। যে কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অস্তিত্ব ও সক্রিয়তা ছাড়া সামাজিক বিজ্ঞানের অন্য কোন শাখাই পরিপুষ্ট ও বিকাশলাভ করতে পার না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি হচ্ছে সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ, সমাজ, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়। নিম্নে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হল-
১। মানুষের চিন্তাচেতনা
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল আলোচ্যবিষয় মানুষ। যেহেতু মানুষ প্রাণশীল, স্বাধীন চিন্তা ও ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন, বহুমুখী ভাব ও বহুমাত্রিক চেতনার অধিকারী এবং তার ইচ্ছা, অভিরুচি সদা পরিবর্তনশীল, তাই মানুষকে নিয়ে আলোচনায় বিজ্ঞানের ছকবাঁধা পদ্ধতি অবলম্বন করা যায় না। অর্থাৎ মানুষের চিন্তাচেতনার সাথে রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কিত।
২। পরিবর্তনশীল প্রকৃতি
রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি গতিশীল শাস্ত্র। একে কেন্দ্র করে বিরাজমান পরিবেশ পরিস্থিতি সদা পরিবর্তনশীল। সেজন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি, পরিধি ও বিষয়বস্তু সর্বদা স্থিতিশীল নয়। দেশীয় অবস্থার পরিবর্তনে আন্তর্জাতিক পরিবর্তনের যোগসূত্র অতি নিবিড় হওয়ার পরিবর্তনশীলতা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্যতম প্রকৃতিতে পরিণত হয়েছে।
৩। সামঞ্জস্যকারী বিজ্ঞান
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় উদ্দেশ্যমূলক, বাস্তব ও বিশ্লেষণমূলক পদ্ধতির পাশাপাশি সামাজিক বিজ্ঞানের অন্যান্য পদ্ধতিকেও ব্যবহার করা যায়। সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য এর অধ্যয়ন রীতিতে সর্বদাই নতুন পন্থা ও পদ্ধতি ব্যবহৃত হতে পারে।
৪। উদার প্রকৃতির
রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রের সদস্যদের সামাজিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক প্রেক্ষিতের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক এমনকি মানসিক, দৈহিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিক সম্পর্কে সজাগ। এজন্য বলা যায়, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি উদার প্রকৃতির। মানুষ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ নিশ্চিতকরণের পদক্ষেপ গ্রহণই এর উদ্দেশ্য।
আরও পড়ুন: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাথে ইতিহাসের সম্পর্ক আলোচনা কর
৫। অনানুষ্ঠানিক বিষয়
রাষ্ট্রবিজ্ঞান শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে সংঘটিত বিষয় নিয়েই আলোচনা করেনা, অনানুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠান বা বিষয়কেও তার আলোচনার ক্ষেত্রে স্থান দেয়। এটি আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত নয় এমনসব সংগঠন, রাজনৈতিক দল, চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী, ব্যক্তিত্বের ভূমিকা, সামাজিক ব্যবহার, অভ্যাস, প্রথা, সমাজের অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত ও জনসংখ্যা সম্পর্কিত অবস্থারও বিচার বিশ্লেষণ করে।
৬। পলিসি বিজ্ঞান
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্যতম আলোচ্যবিষয় হিসেবে পলিসিবিজ্ঞান রাষ্ট্রব্যবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। পলিসিবিজ্ঞানে যেসব সরকারি নীতি প্রণীত হয় সেগুলো বিশ্লেষণ করলে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো পাওয়া যায়-
ক) সরকারি নীতি প্রণয়ন কর্তৃপক্ষ
বিশেষ কোন সংস্থা বা বিশেষ কোন ব্যক্তির দ্বারা সরকারি নীতি প্রণীত হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, কোন নীতি ঠিক এবং সেগুলো কার দ্বারা প্রণীত হল তা সঠিকভাবে বলা যায় না। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৫৬ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এন্থনী ইডেন যখন ‘সুয়েজ’ আক্রমণের নির্দেশ দেন, তখন বহিঃবিশ্বের বোধগম্য হয়নি যে, সিদ্ধান্তটি প্রধানমন্ত্রীর নিজের, না ব্রিটিশ মন্ত্রিপরিষদের, না টোরী নেতৃত্বের সংকীর্ণ কোন গোষ্ঠীর। এসব সমস্যার সমাধানের জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা অনেক ফলপ্রসূ বলে প্রতিপন্ন হয়।
খ) সরকারি নীতি যাদের জন্য প্রণীত
কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সংস্থা ও অধিবাসী বা বিদেশী রাষ্ট্র লক্ষ্য করে সাধারণত সংকীর্ণ নীতি প্রণীত হয়। কোন বিদেশী সরকারকে যদি স্বীকৃতি প্রদান না করা সম্পর্কিত কোন সিদ্ধান্ত হয় সেক্ষেত্রে এ নীতি প্রযোজ্য।
গ) সরকরি নীতিপ্রণয়ন প্রক্রিয়ার গতিশীল প্রকৃতি
প্রত্যেকটি সিদ্ধান্তই কতকগুলো ব্যক্তি, সংগঠিত গোষ্ঠী কিংবা বিবিধ সরকারি সংস্থার মধ্যে অনুষ্ঠিত আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সচেষ্ট পারস্পরিক প্রক্রিয়ার প্রতিশ্রুতি।
উপরিউক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম শাখা হিসেবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানর প্রকৃতি মূলত সমাজ ও মানুষকে ঘিরে আবর্তিত। তবে মানুষের প্রয়োজনে এবং রাষ্ট্রের আদর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতিগত পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান যেহেতু গতিশীল, সুতরাং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি গতিশীল পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে তার স্বকীয়তা বজায় রাখে। সেজন্য আধুনিক কালে রাষ্ট্রের প্রকৃতি অনেক প্রসারিত হচ্ছে।