লাহোর প্রস্তাব কী?
লাহোর প্রস্তাব হল ভারতীয় উপমহাদেশে বসবাসকারী মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্রের দাবী জানিয়ে উত্থাপিত প্রস্তাবনা। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলীম লীগের অধিবেশনে প্রস্তাবটি উপস্থাপন করেন তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী আবুল কাশেম ফজলুল হক। পরবর্তীতে এ প্রস্তাবের ভিত্তিতে ‘ভারত’ ও ‘পাকিস্তান’ নামের দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এজন্য লাহোর প্রস্তাবকে পাকিস্তান প্রস্তাবও বলা হয়।
প্রস্তাবটি পাঠ করা হয় উর্দু ভাষায়। এবং এই প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য এই সম্মেলনে এ. কে. ফজলুল হক “শেরে বাংলা” উপাধিতে ভূষিত হন।
লাহোর প্রস্তাবের মূল বৈশিষ্ট্য সমূহ
১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের মূল বৈশিষ্ট্য সমূহ নিচে উল্লেখ করা হলো-
প্রথমত,“নিখিল ভারত মুসলিম লীগ দৃঢ়তার সাথে পুনঃঘোষণা করছে যে, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে যে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা রয়েছে, তা এ দেশের উদ্ভূত অবস্থার প্রেক্ষিতে অসঙ্গত ও অকার্যকর বিধায় তা ভারতীয় মুসলমানদের জন্য অগ্রহণযোগ্য।”
দ্বিতীয়ত, “সমস্ত সাংবিধানিক পরিকল্পনা নতুনভাবে বিবেচনা না করা হলে মুসলিম ভারত অসন্তুষ্ট হবে এবং মুসলমানদের অনুমোদন ও সম্মতি ছাড়া সংবিধান রচিত হলে কোন সংশোধিত পরিকল্পনাও তাদের নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না।”
তৃতীয়ত, “নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সুচিন্তিত অভিমত এরূপ যে, ভারতে কোন শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা কার্যকর হবে না বা মুসলমানদের নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না যদি তা নিম্নবর্ণিত মূলনীতির উপর ভিত্তি করে রচিত না হয়-
ক) ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী সংলগ্ন বা সন্নিহিত স্থানসমূহকে ‘অঞ্চল’ হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে,
খ) প্রয়োজন অনুযায়ী সীমানা পরিবর্তন করে এমনভাবে গঠন করতে হবে যেখানে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান এলাকাগুলো ‘স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ’ (Independent Sates) গঠন করতে পারে,
গ) ‘স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ’ সংশ্লিষ্ট অঙ্গরাষ্ট্র বা প্রদেশসমূহ হবে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম।”
চতুর্থত, এ সমস্ত অঞ্চলের সংখ্যালঘুদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অন্যান্য অধিকার ও স্বার্থরক্ষার জন্য তাদের সাথে পরামর্শ সাপেক্ষে সংবিধানের কার্যকর ও বাধ্যতামূলক বিধান রাখতে হবে। ভারতবর্ষের মুসলমান জনগণ যেখানে সংখ্যালঘু সেখানে তাদের সাথে পরামর্শ সাপেক্ষে এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাথে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অন্যান্য অধিকার এবং স্বার্থরক্ষার জন্য পরামর্শ সাপেক্ষে সংবিধানে পর্যাপ্ত কার্যকর ও বাধ্যতামূলক বিধান রাখতে হবে।
আরও পড়ুন: অসহযোগ আন্দোলন কী? অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি ও কারণসমূহ
লাহোর প্রস্তাবের মূল ধারাগুলো বিশ্লেষণ করলে এর নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য দেখতে পাওয়া যায়-
১। অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিতকরণ : ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী সংলগ্ন বা সন্নিহিত স্থানসমূহকে ‘অঞ্চল’ হিসেবে চিহ্নিতকরণ।
২। মুসলমানদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন : ভারতের উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্বভাগের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোকে নিয়ে ‘স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ’ (Independent Sates) গঠন।
৩। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলোর সীমানা পরিবর্তন : এসব স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের জন্য প্রয়োজনবোধে ভারতবর্ষের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলোর সীমানা পরিবর্তন।
৪। স্বায়ত্তশাসিত ও স্বাধীন অঙ্গরাজ্য : এসব স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রদেশ বা অঙ্গরাষ্ট্রগুলো হবে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম।
৫। সংখ্যালঘু মুসলমানদের অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণ : সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর সাথে পরামর্শ করে তাদের অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য সংবিধানে পর্যাপ্ত, কার্যকর ও বাধ্যতামূলক বিধান করা।
৬। মৌলনীতি হিসেবে গ্রহণ : লাহোর প্রস্তাবের উল্লিখিত বিষয়গুলো দেশের ভবিষ্যৎ সাংবিধানিক পরিকল্পনার ক্ষেত্রে মৌলিক নীতি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।