Home » অসহযোগ আন্দোলন কী? অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি ও কারণসমূহ
অসহযোগ আন্দোলন

অসহযোগ আন্দোলন কী? অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি ও কারণসমূহ

by TRI

অসহযোগ আন্দোলন কী

মহাত্মা গান্ধীভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কর্তৃক পরিচালিত গণ-আইন অমান্য আন্দোলন হল অসহযোগ আন্দোলন। ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলা এই আন্দোলন ভারতবর্ষের ইতিহাসে প্রথম ও প্রকৃত গণভিত্তিক জাতীয় আন্দোলন। ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশ অমান্য ও সরকারি কাজে অসহযোগিতা করাই হলো এই আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য। তাই এই আন্দোলনকে ‘অহিংস অসহযোগ আন্দোলন’ও বলা হয়। এটি খিলাফত আন্দোলনের সাথে যুগপৎভাবে সংঘটিত হয়।

আরও পড়ুন:  খিলাফত আন্দোলনের গুরুত্ব বা তাৎপর্য

অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি

বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শেষার্ধে ভারতীয় রাজনীতিতে মহাত্মা গান্ধীর আবির্ভাব সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় সংগ্রামের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। ১৯২০ সালে গান্ধী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং তখন থেকেই তিনি জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেন।

ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে সঙ্গত ও ন্যায় বিবেচনা লাভ করার সকল আশা যখন তিরোহিত, তখন মহাত্মা গান্ধী শাসন কর্তৃপক্ষের প্রতি ভারতীয়দের সহযোগিতা ও সমর্থন প্রত্যাহার করে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ রাজ্যের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তোলার উদ্দেশ্যে যে আন্দোলনের ডাক দেন, তা-ই ‘অসহযোগ আন্দোলন’ নামে পরিচিত। তিনি ১৯২০ সালে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে তাঁর অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন। এ আন্দোলনে হিন্দু ও মুসলমান যুগপৎ অংশগ্রহণ করে এবং ব্যাপকভাবে আন্দোলন গড়ে তোলে।

অসহযোগ আন্দোলনের কারণসমূহ

অসহযোগ আন্দোলন গড়ে উঠার পেছনে অনেকগুলো সুনির্দিষ্ট কারণ দায়ী ছিল। নিচে অসহযোগ আন্দোলনের কারণসমূহ আলোচনা করা হল-

১) তুরস্কের পতন ও ব্রিটিশ সরকারের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশ সরকার মুসলমানদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, যুদ্ধের ফল যাই হোক না কেন, তুরস্কের রাজ্য সীমানাকে অখণ্ড রাখা হবে এবং খিলাফতের উপর কোন আঘাত হানা হবে না। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই তারা সে প্রতিশ্রুতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। ফলে মুসলমানগণ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে লিপ্ত হয়। গান্ধীজি মুসলমানদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন।

২) ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের অপ্রতুলতা

১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন বা মন্টফোর্ড সংস্কার আইন ভারতবাসীকে সন্তুষ্ট করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। এ আইনে ভারতবাসীদেরকে কোন স্বায়ত্তশাসন না দিয়ে প্রদেশে দ্বৈতশাসন প্রবর্তন করা হয়েছিল। জাতীয় কংগ্রেস এ আইনকে ‘অসম্পূর্ণ এবং হতাশাজনক’ বলে অভিহিত করেন।

১৯১৯ সালের আইনে মুসলিমদের স্বতন্ত্র নির্বাচনের অধিকারকে ব্যাপক স্বীকৃতি দান জাতীয় ঐক্যে ফাটল ধরায়। এমতাবস্থায় কংগ্রেস ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন লাভের জন্য গণ-আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে।

৩) রাওলাট আইনের বিলোপ সাধন

১৯১৯ সালের রাষ্ট্রদ্রোহী কার্যকলাপ দমনের লক্ষ্যে রাওলাট আইন পাস করা হয়। সেখানে উল্লেখ থাকে যে,

ক) রাষ্ট্রদ্রোহী কার্যকলাপ দমনের লক্ষ্যে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে এবং তার বিচারের জন্য কোন আপিল মঞ্জুর হবে না।

খ) এ আইনে পুলিশ প্রাদেশিক সরকারের অনুমতি ব্যতীতই যে কাউকে যে কোন সময়ে গ্রেফতার করতে পারবে।

ফলে ভারতীয় নেতৃবৃন্দ এ আইনকে তাদের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ বলে ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করে। এ দমনমূল আইন বাতিলের দাবিতে অসহযোগ আন্দোল গড়ে উঠে।

৪) জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ড

১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল রাওলাট আইনের বিরোধিতার লক্ষ্যে অমৃতস্বরের জালিয়ানওয়ালা বাগে সমাবেত জনতার উপর জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে গুলি চালানো হয়েছিল। এতে প্রায় ২০০০ জন হতাহত হয়। এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের ফলে ভারতবাসী ব্রিটিশ সরকারের প্রতি অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ হয়। অধিকিন্তু খুনী ডায়ার ও তাঁর সহযোগীদের উপযুক্ত শাস্তি বিধানে ব্রিটিশ তদন্ত কমিটির পক্ষপাতিত্ব ও অবহেলার কারণে অসহযোগ আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠে।

৫) প্রথম বিশ্বযুদ্ধজনিত অর্থনৈতিক অসন্তোষ ও ব্রিটিশদের অন্যায় অবিচার

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশরা ভারতীয়দের উপর নানাভাবে বিভিন্ন পন্থায় অন্যায় অবিচার চালিয়ে যায়। ফলে তারা ব্রিটিশ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনে সামিল হয়েছিল। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ১.২ মিলিয়ন ভারতীয় সেনা নিয়োগ করা হয় যাদের নিশ্চিত মৃত্যু ও ঝুঁকিপূর্ণ মিশনে পাঠানো হয়। এবং যুদ্ধশেষে এসব সেনাদের বিনা ক্ষতিপূরণে ছাঁটাই করা হয়। এতে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি পায়।

এছাড়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও কৃষক অসন্তোষ দেখা দেয়। যুদ্ধের ফলে শিল্পতি ও বণিক শ্রেণীও ক্ষতির মুখে পড়ে। শ্রমিক অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়, এবং রুশ বিপ্লবের ফলে শ্রমিকদের মনে প্রবল আত্মবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়। এভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ জনিত অর্থনৈতিক অসন্তোষ অসহযোগ আন্দোলনের বাতাবরণ সৃষ্টি করে।

৬) অধিকতর স্বরাজ লাভ

ব্রিটিশদের একচেটিয়া আধিপত্য ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে ভারতবাসী সোচ্চার হয়ে উঠে। তারা স্বরাজ পার্টির নেতৃত্বে পৃথক নির্বাচন দাবি করে আন্দোলন শুরু করে। কিন্তু সরকারের চক্রান্তের কাছে তাদের সব আশা-আকাঙ্ক্ষা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ফলে তাদের ক্ষোভের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। তখন তারা তীব্রভাবে আন্দোলনের পথ খুঁজতে থাকে।

৭) বিভিন্ন উপনিবেশের উপর অত্যাচার

ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী শাসকগোষ্ঠী দক্ষিণ আফ্রিকাসহ ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে অত্যাচার ও নিপীড়ন চালায়। এ সকল অত্যাচার ও নিপীড়নের প্রতিবাদে স্বাভাবিকভাবে আন্দোলন তৈরি হয়।

৮) দক্ষিণ আফ্রিকার অভিজ্ঞতা

দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকার এশিয়াটিক সংশোধনী আইন প্রবর্তন করে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রবাসী ভারতীয়দের উপর অকথ্য অত্যাচার শুরু করলে গান্ধীজি প্রকাশ্যে রাজনীতিতে অবতীর্ণ হন এবং প্রবাসী ভারতীয়দের সংঘবদ্ধ করে এক প্রবল প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেন।

অবশেষে, ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার ‘ইন্ডিয়ান রিলিফ আইন’ প্রবর্তন করলে আন্দোলন বন্ধ হয়। এভাবে গান্ধীজির রাজনৈতিক জীবনের প্রথম পর্ব শেষ হয়।

দক্ষিণ আফ্রিকায় অর্জিত অভিজ্ঞতা বিভিন্নভাবে গান্ধীজির রাজনৈতিক মতাদর্শ ও কৌশলের ভিত্তি রচনা করে এবং পরবর্তীকালে ভারতে তাঁর কৃতিত্বের সহায়ক হয়।

দক্ষিণ আফ্রিকার আন্দোলনের ফলে গান্ধীজির আন্তর্জাতিক খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে এবং তাঁর নেতৃত্বের প্রভাব ভারতেও এসে পড়ে। ফলে গান্ধীজি ব্রিটিশ ভারতে অসহযোগ আন্দোলনের নেতৃত্বে এগিয়ে আসলে সর্বস্তরের জনতা একে স্বাগত জানায় এবং ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সমাগত হয়।

Related Posts