খিলাফত আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সমগ্র ভারতবর্ষে স্বাধীনতা সংগ্রামের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। সমগ্র ভারতবর্ষে আর্থিক সংকট, সরকারি উৎপীড়ন, ভয়ংকর মহামারী এবং পাঞ্জাবের অমানবিক হত্যাকান্ড ও উৎপীড়ন এমন এক পটভূমিতে সূচিত হয়েছিল ১৯২০ সালের খিলাফত আন্দোলন। এক পর্যায়ে খিলাফত আন্দোলনের সাথে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন যুক্ত হয়ে আন্দোলনের তীব্রতা অধিকতর বৃদ্ধি করে।
খিলাফত আন্দোলনের গুরুত্ব
খিলাফত আন্দোলন শুধুমাত্র ধর্মীয় ভাবধারার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এর একটা রাজনৈতিক চরিত্রও ছিল। মুসলমান নেতৃবৃন্দ খিলাফত আন্দোলনে ধর্মীয়, আত্মিক ও রাজনৈতিক দিকের উপর জোর প্রদান করতে থাকেন।
কংগ্রেসের নাগপুর অধিবেশনে গান্ধীজীর সাথে সুর মিলিয়ে মাওলানা মোহাম্মদ আলীও ঘোষণা করেন যে, “পূর্বেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মৃত্যু হয়েছে, একে এখন কবরস্থ করতে হবে মাত্র।”
খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন একসাথে সংঘটিত হওয়ায়, এর মাধ্যমে হিন্দু ও মুসলমান জনগণ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের এক অভিন্ন মঞ্চ রচনা করতে সক্ষম হন। এদিক থেকে বিবেচনা করলে খিলাফত আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য যে কতটুকু তা স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে।
আরও পড়ুন: খিলাফত আন্দোলন কি? খিলাফত আন্দোলনের কারণসমূহ কি ছিল?
তাই বলা যায়, আপাতদৃষ্টিতে খিলাফত আন্দোলন ব্যর্থ হলেও, ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে খিলাফত আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম।
নিচে খিলাফত আন্দোলনের গুরুত্ব আলোচনা করা হল-
১) রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ
খিলাফত আন্দোলন ভারতীয় মুসলিম জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটায়। মুসলমান জনগণ সর্বপ্রথম গণআন্দোলনের সাথে পরিচিত হয়। এ রাজনৈতিক চেতনাই তাদেরকে সর্বভারতীয় বৃহত্তর গণআন্দোলনের প্রশস্ত অঙ্গনে টেনে আনে।
২) ঐক্যবদ্ধ হওয়ার শিক্ষা
যেকোন আন্দোলনের সফলতা নির্ভর করে জাতীয় ঐক্য ও সংহতির উপর। ঐক্যবদ্ধ হওয়ার শিক্ষা ভারতীয় মুসলমান জনগণ এ আন্দোলনের মাধ্যমে লাভ করে। যে মুহূর্তে ভারতীয় জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি হয়, সে মুহূর্ত থেকেই ঐক্য বিনষ্ট হয় এবং খিলাফত আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যায়।
৩) দাবি আদায়ের শক্তি অর্জন
বিনাকষ্টে ও শ্রমে কোন জাতিই মহৎ কিছু অর্জন করতে পারেনি। খিলাফত আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে মুসলমান জনগণ দাবি আদায়ের কৌশল ও দুঃখ কষ্ট বরণ করে নেওয়ার শক্তি অর্জন করে।
৪) নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি
সাফল্যের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে গান্ধীজি হঠাৎ করে আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘোষণা করলে মুসলমান জনগণ দিশেহারা হয়ে পড়েন। কেননা ইতিপূর্বে তাদের সর্বাপেক্ষা সুযোগ্য নেতা মাওলানা মোহাম্মদ আলীকে ব্রিটিশ সরকার গ্রেফতার করায় মূলত এ আন্দোলন সম্পূর্ণভাবে গান্ধীজির নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছিল। গান্ধীজি কর্তৃক আন্দোলন পরিহারের ঘোষণার ফলে মুসলমান জনগণ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন যে, যেকোন আন্দোলনের সাফল্যের জন্য নিজস্ব নেতৃত্ব প্রয়োজন।
৫) ব্রিটিশ সরকারের স্বার্থপরতা সম্পর্কে মুসলমান জনগণের সচেতনতা
খিলাফত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মুসলিম জনগণ সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের স্বার্থপরতা ও ওয়াদাভঙ্গ করার নীতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেন।
৬) স্বাধীনতা আন্দোলন জোরদারকরণ
খিলাফত আন্দোলনের প্রাণপুরুষ মওলানা মোহাম্মদ আলী ছিলেন ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। জনগণকে তিনি এ লক্ষ্যে উদ্দীপ্ত করে তুলেছিলেন। তার নেতৃত্বে খিলাফত আন্দোলন উপমহাদেশের রাজনৈতিক প্রবাহে যে প্রচণ্ড গতিবেগ সৃষ্টি করেছিল তা স্বাধীনতা আন্দোলনকেই জোরদার করেছিল।