বঙ্গভঙ্গের কারণ
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের পিছনে প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণ নিহিত ছিল। নিম্নে কারণগুলো আলোচনা করা হল-
১) প্রশাসনিক কারণ
প্রশাসনিক কারণ বঙ্গভঙ্গের মুখ্য কারণ ছিল। ১৯০৫ সাল পর্যন্ত বিহার, ছোট নাগপুর এবং উড়িষ্যাও ‘বাংলা প্রেসিডেন্সীর’ অন্তর্ভূক্ত ছিল। ব্রিটিশ ভারতে বাংলা প্রেসিডেন্সীই ছিল আয়তনে এবং জনসংখ্যার দিক থেকে সর্বাপেক্ষা বড় প্রদেশ। একজন গভর্নরের পক্ষে এ বিশালায়তন প্রদেশের বিপুলায়তন জনগোষ্ঠীকে শাসন করা দুরূহ হয়ে পড়েছিল। বঙ্গপ্রদেশের কর্মকর্তাগণও এ অসুবিধা বারবার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট তুলে ধরেছিলেন। বড়লাট লর্ড কার্জনও সমস্যাটি উপলব্ধি করেন প্রশাসনিক অসুবিধা দূরীকরণের লক্ষ্যে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং ‘পূর্ব বাংলা ও আসাম’ নামে নতুন একটি প্রদেশ সৃষ্টি করা হয়।
২) রাজনৈতিক কারণ
বঙ্গভঙ্গ করার জন্য নিম্নলিখিত রাজনৈতিক কারণগুলোও বিদ্যমান ছিল-
ক) জাতীয়তাবাদী চেতনাকে ধ্বংস করা
১৮৮৫ সালে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী ভারতীয় রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থানকে সুসংহত করে। সমগ্র ভারতবর্ষের রাজনীতি তখন পরিচালিত হত বাংলা তথা কলিকাতা থেকে। কাজেই লর্ড কার্জন, এন্ড্রো ফ্রেজার প্রমুখ শাসকগণ বঙ্গভঙ্গ করে ভারতীয় রাজনীতিতে বাঙালি হিন্দুদের প্রভাব বিনষ্ট করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
খ) হিন্দু-মুসলমান বিভেদ সৃষ্টি
ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী Divide and Rule (ভাগ কর, শাসন কর) নীতি সুকৌশলে বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে কার্যকরী করেন। এতে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিরোধের বীজ বপিত হয় যা ব্রিটিশ শাসকের ভিতকে অনেক শক্তিশালী করে।
গ) মুসলমানদের দাবি
বাংলা প্রদেশের রাজধানী কলিকাতা হওয়ায় সকল সুযোগ-সুবিধা ও রাজনীতি কলিকাতা কেন্দ্রিক হয়ে উঠে। এতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয় মূলত হিন্দুরা। আর পূর্ব বাংলার মানুষ বিশেষত মুসলমানেরা ছিল অনেকটা সুবিধা বঞ্চিত। এজন্য ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ নিজস্ব উদ্যোগে মুসলমানদের পক্ষে ব্রিটিশ সরকারের নিকট বঙ্গভঙ্গের দাবি জানান এবং এর জন্য আন্দোলন শুরু করেন।
৩) অর্থনৈতিক কারণ
অর্থনৈতিক কারণও বঙ্গভঙ্গের একটি অন্যতম কারণ। পূর্ব বাংলার অর্থনীতি ছিল কৃষিভিত্তিক। কিন্তু কৃষি এবং কৃষকের উন্নতির কোনরূপ প্রচেষ্টা না থাকার ফলে উৎপাদনমূলক কাজে পূর্ব বাংলা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। তৎকালীন রাজধানী কলিকাতায় সকল শিল্প প্রতিষ্ঠান ও কারখানাসমূহ গড়ে ওঠে। ফলে অর্থনৈতিক দিক থেকে কলিকাতা উন্নত হতে থাকে এবং পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক অবনতি ঘটে। বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হবে- একথা ভেবে তারা একে সমর্থন করেন।
৪) সামাজিক কারণ
ব্রিটিশ শাসনামলে মুসলমান সম্প্রদায় নির্মমভাবে শোষিত ও বঞ্চিত হতে থাকে। ব্রিটিশ সরকার হিন্দুদের প্রতি উদার নীতি এবং মুসলমানদের প্রতি বৈরী নীতি অনুসরণ করতে থাকে। মুসলমানরা সামাজিক প্রভাব প্রতিপত্তিহীন একটি দরিদ্র, রিক্ত ও নিঃস্ব সম্প্রদায়ে পরিণত হয়। সুতরাং লর্ড কার্জন কর্তৃক বঙ্গভঙ্গের চিন্তা ভাবনা শুরু হলে পূর্ব বঙ্গের মুসলমান সম্প্রদায় স্বভাবতই এর প্রতি সমর্থন জানায়।
৫) ধর্মীয় কারণ
অবিভক্ত বাংলার পূর্বাংশে মুসলমান এবং পশ্চিমাংশে হিন্দু সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। ফলে এ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও দু’টি সম্প্রদায়ের জন্য দু’টি প্রদেশ গঠনের চেষ্টা করা হয়।
আরও পড়ুন: বঙ্গভঙ্গ কি? বঙ্গভঙ্গের ঐতিহাসিক পটভূমি কি ছিল?
বঙ্গভঙ্গের ফলাফল
বাংলার রাজনীতিতে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের ফলাফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। বঙ্গভঙ্গের ফলে অবিভক্ত বাংলার হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে দুই ধরনের বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। নিম্নে বঙ্গভঙ্গের ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করা হল-
১) মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া
পূর্ব বাংলার মুসলমানগণ বঙ্গভঙ্গকে এক কাম্য পদক্ষেপ হিসেবে গ্রহণ করেন। বঙ্গভঙ্গের সরকারি সিদ্ধান্ত মুসলিম জনগণের মধ্যে আনন্দ-উল্লাসের সৃষ্টি করে।‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ নামের নতুন প্রদেশের রাজধানী করা হয় ঢাকাকে। একে পূর্ব বাংলার মুসলমান সম্প্রদায় আশীর্বাদ বলে স্বাগত জানায়। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত মুসলমানগণ বঙ্গভঙ্গকে তাদের অর্থনৈতিক উন্নতির দিশারী বলে মনে করে।
২) হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া
হিন্দু সম্প্রদায় ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা শুরু করে এবং বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। বাংলা ও বাঙালি জাতিকে বিভক্ত করে ব্রিটিশদের ভাগ কর, শাসন কর নীতির বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে হিন্দু জনগণ। এতে একদিকে যেমন ছিল স্বার্থ ও প্রভাব হারানোর আশঙ্কা, অন্যদিকে কলিকাতা বন্দরের গুরুত্ব হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা। সব মিলিয়ে বঙ্গভঙ্গ হিন্দু সম্প্রদায়ের স্বার্থের উপর আঘাত হানায় তার এর ঘোর বিরোধিতা করে এবং আন্দোলন শুরু করে।
৩) মুসলমানগণ লাভবান হয়
বঙ্গভঙ্গের ফলে বাংলার মুসলিম সম্প্রদায় নব জীবন লাভ করে। এর মাধ্যমে তারা তাদের হৃত গৌরব এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার লাভের আশায় আশান্বিত হয়ে উঠে। নতুন প্রদেশের রাজধানী ‘ঢাকা’ হওয়ায় ঢাকাকে কেন্দ্র করে মুসলমান সম্প্রদায়ের উন্নতির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়।
৪) হিন্দুরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়
বঙ্গভঙ্গের ফলে কলিকাতার মাড়োয়ারী, হিন্দু ধনিক ও বণিক সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক জীভনব্যবস্থা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। হিন্দু লেখক-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতাগণ বঙ্গভঙ্গকে বাঙালি জাতির বিকাশমান ধারাকে নস্যাৎ করার গভীর ষড়যন্ত্র বলে প্রচার করেন। হিন্দু কায়েমী স্বার্থবাদী মহলের ক্ষেত্রে বঙ্গভঙ্গ অভিশাপ হিসেবে দেখা দেয়।
৫) সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি
বঙ্গভঙ্গ হিন্দু-মুসলিম জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক চেতনার বিষবৃক্ষ রোপণ করে। ভারতীয় রাজনীতিতে এ সাম্প্রদায়িকতা চরম আকার ধারণ করে এবং হিন্দু-মুসলমানদের মিলনের সম্ভাবনা চিরতরে লুপ্ত হয়ে যায়।
৬) ব্রিটিশ শাসকদের বিজয়
বঙ্গভঙ্গের ফলে ব্রিটিশ শাসকদের ‘ভাগ কর, শাসন কর’ নীতির বিজয় হয়। ব্রিটিশ শাসকগণ কৌশলে হিন্দু মুসলমান জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়।
৭) ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন নস্যাৎ
বঙ্গভঙ্গের দ্বারা ব্রিটিশ সরকার কৌশলে কলিকাতাকেন্দ্রিক সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন নস্যাৎ করার সুযোগ লাভ করে।
৮) সন্ত্রাসবাদ ও উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থান
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের ফলে ভারতীয় রাজনীতিতে বিশেষ করে বাংলা, পাঞ্জাব ও মহারাষ্ট্রে সন্ত্রাসবাদী ও নাশকতামূলক কার্যকলাপ বৃদ্ধি পায় এবং উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী চিন্তা চেতনা বিস্তৃত হয়।
1 comment
It’s very excellent
Comments are closed.