সিন্ধু সভ্যতা
সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কার ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। এ সভ্যতার আবিষ্কারকদের মধ্যে ঐতিহাসিক রাখাল দাস বন্দোপাধ্যায়, রায় বাহাদুর, দয়ারাম সাহনী এবং তদানীনন্তন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ডাইরেক্টর স্যার জন মার্শালের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সিন্ধু সভ্যতা হিমালয়ান উপমহাদেশের প্রাচীনতম সভ্যতা। তিন সহস্র খ্রিস্টপূর্বাব্দে পাকিস্তানের সিন্ধু অববাহিকায় একটি ঐশ্বর্যশালী নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা গড়ে ওঠে। ভৌগোলিক দিক থেকে এ দু অঞ্চলের ব্যবধান প্রায় চারশ মাইলের অধিক হলেও এ অঞ্চলগুলো সিন্ধনদের তীরে অবস্থিত বলে এ দু অঞ্চলের সভ্যতা ‘সিন্ধু সভ্যতা’ নামে পরিচিত।
এ পর্যন্ত মোট ৬০টিরও বেশি স্থানে সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। তন্মধ্যে সিন্ধুর লারকানা জেলার মহেঞ্জোদারো এবং পাঞ্জাবের মন্টোগোমারি জেলার হরপ্পা নামক শহর দুটি সর্বাপেক্ষা বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ।
কে বা কারা এ সভ্যতার জনক সে সম্বন্ধে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। একদল ঐতিহাসিক বিভিন্ন জাতির লোকসমষ্টিকে, আর একদল সুমেরীয় দেশের অধিবাসীকে, তৃতীয় একদল আর্যদেরকে এবং চতুর্থ একদল ঐতিহাসিক দ্রাবিড়দেরকেই সিন্ধু সভ্যতার জনক বা স্রষ্টা বলে মত প্রকাশ করেছেন। তবে সিন্ধু সভ্যতার প্রকৃত জনক কে তা এখনও পর্যন্ত সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হয় নি।
পড়ুন: সিন্ধু সভ্যতা পতনের কারণ কি ছিল?
সিন্ধু সভ্যতার ব্যাপ্তিকাল নির্ণয় করাও কঠিন। তবে অনেকের মতে, খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০-১৫০০ অব্দের মধ্যে সিন্ধু সভ্যতার উত্থান ও পতন হয়েছিল। এ হিসেবে বলা যায় যে, বর্তমান সময় থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে সিন্ধু সভ্যতা পূর্ণভাবে বিকাশ লাভ করেছিল।
সিন্ধু অববাহিকা অঞ্চলে আবিষ্কৃত নিদর্শনগুলো থেকে অনুধাবন করা যায় সমগ্র বিস্তীর্ণ অঞ্চল একটা বিশেষ শাসনব্যবস্থার অধীনে ছিল। এসময় শহর ও জনপথগুলো নির্মিত হয়েছিল।
সিন্ধু অঞ্চলের লোকেরা সমাজবদ্ধভাবে বাস করত। সমাজ জীবনে তারা ছিল খুবই শান্তিপ্রিয় ও সনাতনপন্থি। নগরবাসী দোতলা পাকা বাড়িতে বাস করত। উভয় তলাতেই স্নানাগার ছিল। সারা নগরে নর্দমার মাধ্যমে ময়লা পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা ছিল। এ অঞ্চলের অধিবাসীরা চার শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল- শিক্ষিত সম্প্রদায়, যোদ্ধা, ব্যবসায়ী ও শ্রমিক।
সিন্ধু উপত্যকার ধ্বংসাবশেষ থেকে যে সকল পাথর ও পোড়ামাটির মূর্তি পাওয়া গেছে তাতে মনে হয় ঐ এলাকার অধিবাসীরা পৌত্তলিক ছিল। সে যুগে দুর্গা ও কালিপূজার প্রচলন ছিল বলে মনে হয়। বৃক্ষ, প্রস্তরখন্ড ইত্যাদি পূজার প্রচলন ছিল বলেও নিদর্শন পাওয়া গেছে।
সিন্ধু সভ্যতার লোকেরা ব্যবসার জন্য সুনির্দিষ্ট ওজন ও ছোটবড় বাটখারা ব্যবহার করত। নগরীর লোকেরা খাদ্য গুদামজাত করার জন্য আর্দ্রতাবর্জিত ও আর্দ্রতা প্রতিরোধক গুদাম তৈরি করত। রাজস্ব হিসেবে সংগৃহীত অর্থ এ সমস্ত গুদামে রাখা হতো। শস্য মাড়াবার জন্য উঁচু মঞ্চ ছিল। শ্রমিকদের শ্রেণীবদ্ধ আবাসগৃহ ছিল। তাদের কাজের ও যুদ্ধের হাতিয়ারগুলো ছিল হালকা। তাদের কুঠারগুলো ছিল চ্যাপ্টা ও পাতলা।
সিন্ধু সভ্যতার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এ সভ্যতা ছিল ব্রোঞ্জযুগীয় সভ্যতা। এ সভ্যতার অধিবাসীদের ব্যবহৃত নিত্যপ্রয়োজনীয় হাতিয়ার ও অস্ত্রশস্ত্র ছিল মূলত ব্রোঞ্জ দ্বারা তৈরি। তারা লোহার ব্যবহার জানত না। এ সভ্যতায় ছিল অত্যন্ত উন্নত নাগরিক সভ্যতা। নগরগুলো তৈরি হয়েছিল সুপরিকল্পিতভাবে।
সিন্ধু সভ্যতার নগরগুলো বিশেষত হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো নগর দুটিই উঁচু ইটের ভিত্তিভূমির ওপর নির্মিত হয়েছিল। উভয় নগরের একাংশ ছিল প্রাচীর দ্বারা সুরক্ষিত। অপর অংশ ছিল সাধারণ নগরী। এ সভ্যতার যুগে শহরের রাস্তাগুলো ছিল পাকা, সোজা ও চওড়া।
সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের কারণ হিসেবে আর্যদের আক্রমণকে প্রধানত গণ্য করা হয়। উন্নত ধরনের অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত আর্যদের কাছে সিন্ধু সভ্যতার লোকদের পরাজয় অনিবার্য ছিল।