Home » আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের ফলাফল

আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের ফলাফল

by TRI

খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ সালে মেসিডনের রাজা গ্রীকবীর আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণ করেন যা একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা হিসেবে ইতিহাসে পরিচিত। ভারতবর্ষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলো পারসিক রাজাদের আক্রমণের দখল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আলেকজান্ডার ভারতবর্ষ অভিযানে আসেন। তিনি মধ্য এশিয়া ও পারস্য জয় করে দক্ষিণাভিমুখে অগ্রসর হয়ে খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে হিন্দুকুশ পর্বত আক্রমণ করে ভারতে প্রবেশ করেন। তিনি দু বছর ভারতে অবস্থান করেন এবং প্রায় সমস্ত ভারতীয় রাজ্য তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে।

আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের ফলাফল

আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ফলাফল বিদ্যমান। নিম্নে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-

ক) প্রত্যক্ষ ফল

আলেকজান্ডারের ভারতবর্ষ আক্রমণের প্রত্যক্ষ ফল নিম্নরূপ-

১) অসংখ্য জনপদ বিধ্বস্ত

আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের ফলে এদেশের বহু জনপদ ও নগর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল এবং অসংখ্য প্রাণনাশ হয়েছিল। কথিত আছে যে, একমাত্র সিন্ধু প্রদেশেই আশি হাজার লোক নিহত হয়েছিল, হাজার হাজার ভারতবাসী যুদ্ধবন্দী দাসরূপে বিক্রীত হয়েছিল এবং দুর্ভিক্ষ ও মহামরীতে হাজার হাজার লোক মারা গিয়েছিল।

আরজ আলী সমীপে : আরিফ আজাদ - Aroj Ali Somipe : Arif Azad

TK. 300 TK. 210 You Save TK. 90 (30%)

২) একটি নিষ্ফল বিজয়

আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের কোনো রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল না। তিনি এদেশের কোথাও স্থায়ী শাসন প্রতিষ্ঠার সুব্যবস্থা করতে পারেন নি। যার ফলে তাঁর মৃত্যুর পরে এদেশ থেকে গ্রিক আধিপত্য লোপ পায়। ভারতীয় সমাজ, রাজনীতি ও যুদ্ধনীতির ওপর আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণ কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারে নি। আলেকজান্ডার উত্তর পথে কয়েকটি উপনিবেশ স্থাপন করে সেগুলোকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিলনক্ষেত্র করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেগুলোও বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। সর্বোপরি বলা যায়, এটি ছিল একটি নিষ্ফল বিজয়।

৩) গ্রিক বসতি স্থাপন

আলেকজান্ডারের আক্রমণের কারণে উত্তর ভারতের সীমান্ত অঞ্চলে কয়েকটি গ্রিক উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল। এগুলো হল আলেকজান্ডার যে অঞ্চলে ঝিলাম নদী অতিক্রম করেছিলেন সেখানে ‘বুকিফালা’, পুরুর সাথে যে প্রান্তরে যুদ্ধ হয়েছিল সেখানে ‘নিকিয়া’ বা ‘নিকাইয়া’, সিন্ধু ও চিনাব নদীর সংগমস্থলে ‘আলেকজান্দ্রিয়া’ এবং পাঞ্জাবের নদীগুলোর সংগমস্থলে ‘সোগডিয়ান আলেকজান্দ্রিয়া’। প্রাচ্যের সাথে পাশ্চাত্যের যোগসূত্র তৈরির উদ্দেশ্য আলেকজান্ডার অনেক গ্রিককে বসবাসের জন্য এখানে রেখে যান।

আরও পড়ুন:  সিন্ধু সভ্যতা পতনের কারণ কি ছিল?

৪) নতুন যোগাযোগের পথ আবিষ্কার

আলেকজান্ডারের অভিযানের ফলে ভারতীয় উপমহাদেশ ও পাশ্চাত্য দেশের মধ্যে তিনটি স্থলপথ ও একটি জলপথ আবিষ্কৃত হয়েছিল। এ পথ ধরে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করা সহজ হয়েছিল এবং সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক আদান-প্রদানও সম্ভব হয়েছিল।

৫) বিজিত অঞ্চলে শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন

আলেকজান্ডার তাঁর অধিকৃত ভারতের ৫টি অঞ্চলের প্রত্যেকটিতে একজন করে শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। নবগঠিত এসব প্রদেশের নিরাপত্তার জন্য আলেকজান্ডার অনেক গ্রিক সৈন্য রেখে গিয়েছিলেন। তবে এই গ্রিক প্রদেশগুলো দীর্ঘস্থায়ী ছিল না। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর সাথে সাথে গ্রিক শাসনকর্তা নিজেদের শাসনাঞ্চল ছেড়ে পশ্চিম দিকে চলে যান। এতে দেশীয় শাসকরা নিজ নিজ অঞ্চলে স্বাধীন হতে থাকেন।

৬) ভারত সম্পর্কে পাশ্চাত্যবাসীদের জ্ঞানের স্বচ্ছতা

আলেকজান্ডারের সৈন্যরা স্বদেশে ফিরে গিয়ে তাদের ভারত সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। এতে ভারত তথা প্রাচ্য দেশ সম্পর্কে নানারকম ভৌগোলিক ও অন্যান্য তথ্য পাশ্চাত্য দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি একজন বিখ্যাত নাবিক নিয়ারচাসের নেতৃত্বে সিন্ধু থেকে ইউফ্রেটিস নদী পর্যন্ত বিভিন্ন নৌ ও সমুদ্রবন্দরের অনুসন্ধান চালানোর জন্য একটি অভিযাত্রী দল পাঠিয়েছিলেন।

খ) পরোক্ষ ফল

আলেকজান্ডার কর্তৃক ভারত আক্রমণের পরোক্ষ ফলাফল নিম্নরূপ-

১) রাজনৈতিক ঐক্যের উপলব্ধি

আলেকজান্ডারের অভিযানের ফলে উত্তর-পশ্চিম ভারতের ক্ষুদ্র রাজ্যগুলোর স্বাতন্ত্র্য নষ্ট হওয়ায় ভারতীয়দের মনে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একতার প্রয়োজন অনুভূত হয়েছিল। রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা বহিরাগত শত্রুর বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার পরিপন্থী, এ ধারণা ভারতীয়দের মনে জন্মেছিল। ফলে ভারতে রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপনের পথ সহজ হয়েছিল এবং এর ফলে পরবর্তীকালে চন্দ্রগুপ্তের পক্ষে শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ সাম্রাজ্য স্থাপন করা সম্ভব হয়েছিল।

২) স্থলপথ ও জলপথ আবিষ্কার

আলেকজান্ডারের অভিযানের ফলে ভারতীয় উপমহাদেশ ও ইউরোপের মধ্যে তিনটি স্থলপথ ও একটি জলপথ আবিষ্কৃত হয়েছিল। এ সকল পথ ধরে পরবর্তীকালে যোগাযোগের পথ সুগম হয়েছিল। এরূপে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধিত হওয়ায় উভয়ের সম্পর্ক অধিকতর ঘনিষ্ঠ হয়েছিল এবং ব্যবসায় বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছিল।

৩) চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের উত্থান

আলেকজান্ডারের আক্রমণের ফলে পাঞ্জাবের কলহপ্রিয় কতকগুলো রাজ্যের শক্তি ও স্বাতন্ত্র্য নষ্ট হয়। ফলে উত্তর ভারতের চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পক্ষে পাঞ্জাব জয় করে ঐক্যবদ্ধ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা সহজ হয়েছিল।

৪) ভাবের আদান-প্রদান

আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের ফলে ভারতবাসী ও গ্রিকদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান ঘটে। ফলে ভারতীয় ও গ্রিক সভ্যতা পরস্পরের সংমিশ্রণে শ্রীবৃদ্ধি লাভ করতে থাকে।

৫) ভারতীয় শিল্প ও সাহিত্যের ওপর প্রভাব

আলেকজান্ডারের আক্রমণের ফলে ভারতীয় ধর্ম, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্প, স্থাপত্য ও জ্যোতিষশাস্ত্রে উন্নত গ্রিক সভ্যতার প্রভাব পড়ে। উপমহাদেশে পরবর্তীকালের ‘গান্ধার শিল্প’ এ প্রভাবেরই পরোক্ষ ফল। এ আক্রমণের ফলে ভারতবর্ষে একটি ঐক্যবদ্ধ সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে।

আরও পড়ুন:  গান্ধার শিল্পের সংক্ষিপ্ত ধারণা দাও। বৌদ্ধ শিল্পকলার ইতিহাসে এর গুরুত্ব মূল্যায়ণ কর।

৬) বিশ্ব সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার অনুপ্রেরণা

আলেকজান্ডার তাঁর দিগ্বিজয় দ্বারা একটি বিশ্ব সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন যা পরবর্তীকালে অনেককেই এরূপ বিশ্ব সাম্রাজ্য স্থাপনে উদ্বুদ্ধ করে।

৭) উপমাহদেশের ইতিহাস সম্পর্কে জানা

আলেকজান্ডারের অনুচর গ্রিক লেখকদের বিবরণে তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশের অবস্থা সম্বন্ধে জানা যায়। আলেকজান্ডারের আক্রমণের সুনির্দিষ্ট তারিখ ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। 

৮) ইউরোপে ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার

আলেকজান্ডারের অনুচরদের মাধ্যমে ভারতের ভৌগোলিক অপরাপর জ্ঞান ইউরোপে বিস্তার লাভ করে।

 

অতএব বলা যায়, আলেকজান্ডারই ছিলেন প্রাচীন পৃথিবীর একমাত্র সম্রাট ‍যিনি গ্রিস থেকে ভারত পর্যন্ত ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার ভূখন্ড জুড়ে একটি বিশ্ব সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। তিনিই প্রথম হেলেনিস্টিক ও ভারতীয় সভ্যতার মধ্যে সংযোগ সূত্র রচনা করে গিয়েছেন। এ সংযোগের ফলে ভারতীয় সভ্যতা ব্যাপকভাবে পশ্চিমা সভ্যতার সংস্পর্শে সমৃদ্ধ হয়েছিল।

Related Posts