সিন্ধু সভ্যতা গুলোর ভিত রচিত হয় নদী তীরবর্তী নব্য প্রস্তর যুগে এবং তা পরিপুষ্ট হয় ধাতব দ্রব্য ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। কৃষি নির্ভর এ সভ্যতাগুলোর ব্যক্তিগত মালিকানার সূত্রপাত করে এবং তা সামাজিক শ্রেণি সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ এবং সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালন করে।
সিন্ধু সভ্যতার পতনের কারণ
যথাযথ তথ্যাদির অভাবে পরোক্ষ প্রমাণের ভিত্তিতে সিন্ধু সভ্যতার পতনের কারণ হিসেবে সেই অঞ্চলের পরিবর্তনশীল প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রভাবকে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। নিচে সেগুলো আলোচনা করা হল-
ভূপ্রকৃতির পরিবর্তন
সিন্ধু নদের অতুল ঐশ্বর্যকে ঘিরে একদিন তার তীরে ‘সিন্ধু সভ্যতা’ নামে যে সুবিশাল জনপদ গড়ে উঠেছিল, সময়ের বিবর্তনে তা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট চিন্তাবিদগণের ধারণা মতে, “সিন্ধুনদের গতিপথ পরিবর্তনের ফলে তীরাঞ্চলের শাখানদীসহ অন্যান্য অংশ শুষ্ক মরু অঞ্চলে পরিণত হয়েছিল।” অরেল স্টাইন বলেন, “তাম্রযুগ থেকে সিন্ধু উপত্যকা অঞ্চল কালক্রমে শুকিয়ে গিয়েছিল।” অতএব, সিন্ধুনদের গতিপথ পরিবর্তনে প্রয়োজনীয় জলাভাবে ভূপৃষ্ঠের ক্রমবর্ধমান শুষ্কতা সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের অন্যতম একটি কারণ।
বনবৃক্ষের ধ্বংস সাধন
সিন্ধু সভ্যতা থেকে প্রাপ্ত সিলমোহরগুলো থেকে পরিষ্কার অনুধাবণ করা যায় যে, সেখানে একসময় বনজঙ্গল, জলাশয় এবং জীব-জানোয়ার যথা- বাঘ, গণ্ডার, হাতি, মহিষ প্রভৃতির ব্যাপক উপস্থিতি ছিল। কিন্তু নগর সভ্যতার প্রয়োজনে ‘ইট’ প্রস্তুত করতে গিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের জন্য বনবৃক্ষের ধ্বংস সাধন করা হয়। এটাও সভ্যতা ধ্বংসের অন্যতম একটি কারণ।
সিন্ধু সভ্যতার পরিবর্তন
সিন্ধু সভ্যতা কালক্রমে নগর সভ্যতায় রূপ নিলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপে এটি তার নিজস্ব উৎকর্ষ হারিয়ে ফেলে। লোকসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বড় বড় দালানের কক্ষগুলোকে ছোট ছোট করে ভাগ করতে হয়েছে। ফলে বাসস্থান ঘনবস্তিতে পরিণত হয়েছে। এভাবে সিন্ধু সভ্যতা নিজের সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলে এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
আরও পড়ুন: প্রাচীন বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের গুরুত্ব
প্রাকৃতিক বিপর্যয়
সিন্ধুনদের প্লাবন, প্রাকৃতিক ভূমিধস, ভূমিকম্প ইত্যাদির ফলে সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল বলে ইতিহাসবেত্তাগণ ধারণা পোষণ করে থাকেন। তাই বলা যায় যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিঃসন্দেহে সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসের অন্যতম কারণ ছিল।
মরু অঞ্চলের ক্রমপ্রসার
রাজপুতানার মরু অঞ্চলের ক্রমপ্রসার সিন্ধু সভ্যতা বিনাশের কারণগুলোর অন্যতম হিসেবে বিবেচ্য বলে পণ্ডিতগণ মনে করেন। সিন্ধু উপত্যকাকে আর্দ্রতাহীন শুষ্ক মরু অঞ্চলে পরিণত করে সে সভ্যতা ধ্বংসের জন্য রাজপুতানার মরুভূমির সম্প্রসারণ অনেকটা দায়ী ছিল।
নাগরিক উৎকর্ষের অবনতি
সিন্ধু সভ্যতার শহর-নগরগুলোর পূর্বেকার নাগরিক উৎকর্ষ ক্রমশই হ্রাসপ্রাপ্ত হচ্ছিল। লোকসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বড় বড় দালানের ঘরগুলোকে ছোট ছোট ঘরে ভাগ করে নেওয়া হয়েছিল। দরিদ্রদের বাসস্থান ঘিঞ্জি বস্তিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। মহেঞ্জোদারো শহরটি ক্রমে এটার পূর্বেকার সৌষ্ঠব হারিয়ে এক শ্রীহীন, শৃঙ্খলাহীন শহরে রূপান্তরিত হয়েছিল।
কৃষি ও অপরাপর অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অবনতি
অবশ্য প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তনই সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসের প্রধান বা একমাত্র কারণ একথা যুক্তিসিদ্ধ নয়। নগরকেন্দ্রিক সভ্যতায় ক্রমে কৃষির গুরুত্ব ও উৎকর্ষ হ্রাস পেতে থাকলে অর্থনৈতিক কারণও এ সভ্যতার ধ্বংসের পথ উন্মুক্ত করেছিল।
আর্যদের আক্রমণ
সিন্ধু সভ্যতার হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো প্রভৃতি স্থানে খননকার্যের ফলে যে সকল নর কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছে, সেগুলোর মাথার খুলিতে আঘাতের চিহ্ন পরিলক্ষিত হয়। সিন্ধুতীরের জনগণ একাধিক বহিরাগত শত্রু কর্তৃক আক্রমণের শিকার হয়েছিল। তবে আর্যদের আক্রমণেই সিন্ধু সভ্যতার পতন ঘটেছিল। আর আর্যদের আক্রমণ থেকে যারা প্রাণে বেঁচেছিল, তারা সিন্ধু ত্যাগ করে দক্ষিণ ভারতে আশ্রয়গ্রহণ করেছিল। এভাবেই সময়ের স্রোতে সিন্ধু সভ্যতা বিলীন হয়ে যায়।
খাদ্য সমস্যা
অনেকের মতে, জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরা যেভাবে উদ্ভিদ ও প্রাণী ধ্বংস করেছে, একইভাবে তা উৎপাদনে উদ্যোগ গ্রহণ করে নি। যার কারণে এককালে প্রচন্ড খাদ্য সমস্যা দেখা দেয়। এটিও সভ্যতা পতনের অন্যতম কারণ বলে মনে করা হেয়ছে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি
জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য একসময় নগরীর ওপর প্রচন্ড চাপ বৃদ্ধি পায়। এতে খাদ্য ও আবাসন সংকট দেখা দেয়। দালানকোঠার বড় বড় কক্ষ ছোট ছোট ঝুপরি ঘরে পরিণত হতে থাকে। ফলে দরিদ্র জনগণের বাসস্থান অস্বাস্থ্যকর বস্তিতে পরিণত হয়।