সিদ্ধান্ত গ্রহণ এমন একটি প্রপঞ্চ যা মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রায় প্রতিটি মুহুর্তে ঘটে। যেকোন সংগঠন যেমন: সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ একটি অপরিহার্য ও মৌলিক বিষয়। তাই সামাজিক বিজ্ঞানে, বিশেষ করে লোকপ্রশাসনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে সংযোজিত হয়েছে। এ সম্পর্কে হার্বাট সাইমন বলেছেন, “Public administration is the whole process of decision-making.”
সিদ্ধান্ত গ্রহণ কি?
সাধারণ ভাষায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ বলতে বর্তমানের আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে অতীতের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করাই হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
Chester I. Barnard তাঁর “The Functions of the Executive” গ্রন্থে বলেন, “সিদ্ধান্ত গ্রহণ হচ্ছে সংগঠন ও ব্যবস্থাপনার মূল বিষয়। তাই সংগঠনের ভিতরের ও বাহিরের পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে দুই বা ততোধিক বিকল্প হতে উপযোগী কোন একটির উপর মনস্থির করাই হচ্ছে সিদ্ধান্ত গ্রহণ।”
George R. Terry বলেন, “দুই অথবা সম্ভাব্য অনেকগুলো বিকল্প থেকে যুক্তি নির্ভর একটি গ্রহণ করার প্রক্রিয়া হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণ।”
সাইমনের মতে, “সকল ব্যবস্থাপকীয় কার্যাবলিই সিদ্ধান্ত গ্রহণ।”
উপরোক্ত আলোচনা থেকে বলা যায়, যে কোন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য কর্মকৌশল নির্ধারণের নিমিত্তে অনেকগুলো বিকল্প থেকে একটি সর্বোত্তম বিকল্প বেছে নেয়াই হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
সাইমনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ তত্ত্ব (Rational Decision Making Model)
হার্বাট সাইমন সকল ব্যবস্থাপকীয় কার্যকেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণকে সংগঠনের কেন্দ্রবিন্দু এবং সর্বত্র পরিব্যপ্ত কর্মকান্ড মনে করেছেন। তিনি বলেন, যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ হল প্রত্যাশিত লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য যথোপযুক্ত উপায় নির্বাচন করা।
সাধারণত একটি সিদ্ধান্ত তখনই যৌক্তিক (rational) হয় যখন তা সংগঠনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হয়। সাইমন তাঁর যৌক্তিক সিদ্ধান্ত প্রণয়ন তত্ত্বে বিভিন্ন ধাপ বা স্তরের কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলো হল-
১) তথ্য অনুসন্ধান ও সংগ্রহ
২) তথ্য বিশ্লেষণ ও পদ্ধতিকরণ
৩) বিকল্প তৈরি ও অনুসন্ধান
৪) বিকল্প বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন
৫) বিকল্প বাছাই তথা সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
সাইমনের মতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সমস্যা থেকে শুরু হয় এবং সমস্যা নির্ণয় ও সমস্যা সমাধানের শ্রেষ্ঠ পন্থা নির্ধারণের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। তিনি তাঁর তত্ত্বে সিদ্ধান্ত গ্রহণের চারটি পর্যায়ক্রমিক কর্মকান্ডের কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলো হলো-
১) বুদ্ধিবত্তিক কার্যক্রম (Intelligence activity)
এটি হল সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীর পরিবেশকে বিচার করা। এর আলোকে উপাত্ত ও তথ্য আহরণ করা।
২) নকশা কার্যক্রম (Design activity)
এটি হল সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীর সামনে যে সকল বিকল্প কার্যপদ্ধতি খোলা আছে তা পরীক্ষা করা। এই স্তরে সম্ভাব্য পদ্ধীতর উদ্ভাবন ও বিকাশ বিশ্লেষিত হয়।
৩) বাছাই কার্যক্রম (Choice activity)
প্রত্যেকটি বিকল্প কার্যপদ্ধতির ফলাফল দেখে সর্বশ্রেষ্ঠ বিকল্পটি গ্রহণ করা।
৪) পর্যালোচনা কার্যক্রম (Review activity)
গৃহীত সিদ্ধান্ত কতটা কার্যকর হবার সম্ভাবনা আছে তা বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন।
আরও পড়ুন: পদোন্নতির উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব বর্ণনা কর
সীমিত যৌক্তিকতা (Bounded rationality)
সাইমন পরবর্তী কালে স্বীকার করে নেন যে, একজন মানুষের পক্ষে যৌক্তিকতা অর্জন করা কখনোই সম্ভব নয়। কারণ, তাঁর পক্ষে সকল বিকল্প উদ্ভাবন করা সম্ভব নয় এবং সকল ফলাফল নির্ধারণ করাও সম্ভব নয়। তাছাড়া এসব কাজ করার মতো পর্যাপ্ত সময়ও মানুষের হাতে থাকে না । কেননা তাকে একটা নির্দিষ্ট সময় সীমার মধ্যেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। অন্যদিকে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত প্রণয়নের জন্যে প্রয়োজন পূর্বানুমান। আর পূর্বানুমান সঠিক নাও হতে পারে। এজন্য সাইমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের সন্তোষজনক মডেলের তাত্ত্বিক ধারণা প্রদান করেন। সাইমন এই মডেলে মানুষকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। যেমন-
১) অর্থনৈতিক মানুষ (Economic Man)
২) সামাজিক মানুষ ও (Social Man)
৩) প্রশাসনিক মানুষ (Administrative Man)
সাইমন মনে করেছেন, একজন অর্থনৈতিক মানুষ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সর্বনিম্ন খরচে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের কথা বিবেচনা করেন। একজন সামাজিক মানুষ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সামাজিক মূল্যবোধের দ্বারা আক্রান্ত থাকেন। অপরদিকে একজন প্রশাসনিক মানুষ সীমিত সংখ্যক বিকল্পের সীমিত সংখ্যক ফলাফলের ভিত্তিতে সবচেয়ে সন্তোষজনক বিকল্পটি বেছে নেন। ফলে তার দ্বারা সর্বোচ্চ সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব হয়।
সাইমন প্রশাসনিক মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণের যৌক্তিকতাকে সীমিত যৌক্তিকতা (Bounded Rationality) হিসেবে অভিহিত করেছেন। নিম্নে চিত্রের সাহায্যে উক্ত তিন প্রকার মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের ভূমিকা দেখানো যায়।
সাইমনের যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ মডেলের সীমাবদ্ধতা
১) সাইমনের যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ মডেলের সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করতে গিয়ে Charles Lindblom বলেন, এটি যে পরিমাণ বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতা ও তথ্যের উৎস দাবী করে তা মানুষের মধ্যে থাকে না। নীতি সমস্যার জন্য যে পরিমাণ সময় ও অর্থ প্রয়োজন তা না থাকলে এ তত্ত্বটি আরো বেশি অযৌক্তিক প্রমাণিত হয়।
২) Dror-সাইমন এর satisfying মডেলের সমালোচনা করে বলেন, এটি কার্যত সাধারণ মানুষের কাছে প্রথমেই যে বিকল্পটি সন্তোষজনক মনে হবে সেটিকেই নির্বাচন করার মতোই গুরুত্বহীন।
৩) Waldo এর মতে, যে যৌক্তিক দৃষ্টিবাদের উপর ভিত্তি করে সাইমনের তত্ত্ব গড়ে উঠেছে সেটি জীবনের সঙ্গে যুক্তির পার্থক্য নির্দেশ করতে ব্যর্থ এবং স্বয়ং মূল্যবোধ দ্বারা আক্রান্ত।