১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের মূল সংবিধান সংসদীয় ও মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার প্রবর্তন করে। জাতীয় সংসদ কর্তৃক নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান হলেন নামমাত্র শাসক প্রধান। প্রধানমন্ত্রীয় নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার হাতে প্রকৃত শাসনক্ষমতা অর্পিত হয়। জাতীয় সংসদের সদস্যগণকে নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের নিকট দায়ী ছিল। ১৯৭৫ সালের ২৫ মার্চ সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনী দ্বারা বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৯১ সালের ৬ আগস্টে প্রণীত এবং ১৫ সেপ্টেম্বরের গণভোটে অনুমোদিত দ্বাদশ সংশোধনী আইনে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তিত হয়। বর্তমানে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রপতি
রাষ্ট্রপতি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান। সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদ (১) দফা অনুযায়ী তিনি জাতীয় সংসদের সদস্যগণ কর্তৃক প্রকাশ্য ভোটে নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রপতির নামে দেশের সকল নির্বাহী ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে বলে প্রকাশ করা হয়। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি রাষ্ট্রের অন্য সকল পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তির উর্ধ্বে স্থান লাভ করেন ও সর্বোচ্চ পদমর্যাদার অধিকারি হবেন। পাঁচ বছর মেয়াদে তিনি এ পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন। ব্রিটেনের রাণী বা ভারতের রাষ্ট্রপতির ন্যায় তিনি শাসনতান্ত্রিক প্রধান।
রাষ্ট্রপতি পদের যোগ্যতা
৪৮ অনুচ্ছেদের (৪) দফা অনুযায়ী কোন ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হইবার যোগ্য হবেন না, যদি তিনি
(ক) পঁয়ত্রিশ বৎসরের কম বয়স্ক হন, অথবা
(খ) সংসদ কর্তৃক নির্বাচিত হইবার যোগ্য না হন, অথবা
(গ) কখনও এই সংবিধানের অধীন অভিসংশন দ্বারা রাষ্ট্রপতির পদ হইতে অপসারিত হইয়া থাকেন।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন
রাষ্ট্রপতিকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের ভোটে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হবেন। সংবিধানের ৫০ অনুচ্ছেদের (২) দফায় বলা হয়েছে, “একাদিক্রমে হউক বা না হউক দুই মেয়াদের অধিক রাষ্ট্রপতির পদে কোন ব্যক্তি অধিষ্ঠিত থাকিবেন না।” ৫০ অনুচ্ছেদের (৪) দফায় বলা হয়েছে, “রাষ্ট্রপতি তাঁহার কার্যভারকালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইবার যোগ্য হইবেন না এবং কোন সংসদ সদস্য সদ্য রাষ্টপতি নির্বাচিত হইলে রাষ্ট্রপতিরুপে তাঁহার কার্যভার গ্রহণের দিনে সংসদে তাঁহার আসন শূণ্য হইবে।” সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদ (১) দফা অনুসারে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার রাষ্ট্রপতির নির্বাচন কার্য পরিচালনা করবেন।
আরও পড়ুন: |
সুশাসনের জন্য গণতন্ত্র কি অত্যাবশ্যকীয়? |
রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কার্যাবলি
রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের প্রধান। রাষ্ট্রের সকল ব্যক্তির উর্ধ্বে স্থান লাভ করেন এবং সংবিধান অনুসারে দায়িত্ব পালন করেন। নিম্নে তাঁর ক্ষমতা ও কার্যাবলি দেয়া হল:
শাসন সংক্রান্ত
সরকারের যাবতীয় নির্বাহী কার্যাদি রাষ্ট্রপতির নামে সম্পাদিত হয়। তাঁর নির্বাহী ক্ষমতা ও কার্যসমূহ হচ্ছে:
(ক) রাষ্ট্রপতি আইনবলে তার নামে প্রণীত আদেশ ও অন্যান্য দলিদ সত্যায়িত বা প্রমাণীকৃত হওয়ার ধরণ নির্ধারণ করেন।
(খ) রাষ্ট্রপতি সরকারের কার্যক্রম বন্টন এবং কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য বিধি প্রণয়ন করেন।
(গ) সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (২) দফা অনুসারে প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীগণদের রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করিবেন। তবে শর্ত থাকে যে, “তাঁহাদের সংখ্যার অন্যূন নয়-দশমাংশ সংসদ সদস্যগণের মধ্য হইতে নিযুক্ত হইবেন এবং অনধিক এক-দশমাংশ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইবার যোগ্য ব্যক্তিগণের মধ্য হইতে মনোনীত হইতে পারিবেন।
(ঘ) সংবিধানের ৬৪ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে, সুপ্রীম কোর্টের বিচারক হইবার যোগ্য কোন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের অ্যাটর্নি-জেনারেল পদে নিয়োগদান করিবেন।
(ঙ) সংবিধানের ৬১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগসমূহের সর্বাধিনায়কতা রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত হইবে এবং আইনের দ্বারা তাহার প্রয়োগ নিয়ন্ত্রিত হইবে।
আইন সংক্রান্ত
(ক) সংসদের অধিবেশন আহ্বান
সংবিধানের ৭২ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুযায়ী, সরকারি বিজ্ঞপ্তি দ্বারা রাষ্ট্রপতি সংসদ আহ্বান, স্থগিত ও ভঙ্গ করিবেন এবং সংসদ আহ্বানকালে রাষ্ট্রপতি প্রথম বৈঠকের সময় ও স্থান নির্ধারণ করিবেন।
তবে শর্ত থাকে যে, সংসদের এক অধিবেশনের সমাপ্তি ও পরবর্তী অধিবেশনের প্রথম বৈঠকের মধ্যে ষাট দিনের অতিরিক্ত বিরতি থাকিবে না।
তবে আরও শর্ত থাকে যে, এই দফার অধীন তাঁহার দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক লিখিতভাবে প্রদত্ত পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন।
সংবিধানের ৭৩ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সংসদে ভাষণ দান এবং বাণী প্রেরণ করিতে পারিবেন।
(খ) বিলে সম্মতি প্রদান
সংবিধানের ৮০ অনুচ্ছেদের (২) দফা অনুযায়ী, সংসদ কর্তৃক কোন বিল গৃহীত হইলে সম্মতির জন্য তাহা রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করা হইবে।
সংবিধানের ৮২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোন অর্থ বিল অথবা সরকারি অর্থ ব্যয়ের প্রশ্ন জড়িত রয়েছে এবম কোন বিল রাষ্ট্রপতির সুপারিশ ব্যতীত সংসদে উত্থাপন করা যাইবে না।
(গ) অধ্যাদেশ প্রণয়ন ক্ষমতা
অধ্যাদেশ প্রণয়ণ ক্ষমতা সম্পর্কে ৯৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, সংসদ ভাঙিয়া যাওয়া অবস্থায় অথবা উহার অধিবেশন ব্যতীত কোন সময়ে রাষ্ট্রপতির নিকট আশু ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় পরিস্থিতি বিদ্যমান রহিয়াছে বলিয়া সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হইলে রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি করে আইন তৈরি করিতে পারিবেন।
বিচার সংক্রান্ত
(ক) সংবিধানের ৯৫ নং অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুযায়ী, প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগদান করিবেন।
(খ) সংবিধানের ৪৯ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, “কোন আদালত, ট্রাইবুন্যাল বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত যে কোন দন্ডের মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করিবার এবং যে কোন দন্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করিবার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকিবে।”
(গ) সংবিধানের ৯৪ অনুচ্ছেদের (২) দফা অনুযায়ী, প্রধান বিচারপতি এবং প্রত্যেক বিভাগে আসন গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপতি যেরুপ সংখ্যাক বিচারক নিয়োগের প্রয়োজন বোধ করিবেন, সেইরুপ সংখ্যাক অন্যান্য বিচারক লইয়া সুপ্রীম কোর্ট গঠিত হইবে।
আর্থিক সংক্রান্ত
(ক) যে কোন সরকারি অনুদানে রাষ্ট্রপতির অনমোদনের পর তা কার্যকর হয়।
(খ) অতিরিক্ত বা অনুপূরক অনুদান হিসেবে সমন্বিত তহবিল থেকে ব্যয় অনুমোদনের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির রয়েছে।
(গ) রাষ্ট্রপতির সুপারিশ ব্যতীত কোন মঞ্জুরী দাবি করা যাবে না।
(ঘ) সংবিধানের ৯২ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুযায়ী, জাতীয় সংসদ কোন অর্থবছরে অনুদান মঞ্জুরে ব্যর্থ হলে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি সমন্বিত তহবিল থেকে ঐ বছরে বার্ষি আর্থিক বিবরণীতে উল্লেখর বল অনধিক ষাট দিনের ব্যয় সংকুলানের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করতে পারবেন।
বিবিধ ক্ষমতা ও কার্যাবলি
(ক) প্রধান বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রী, অন্যান্য মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, স্পিকার, ডেপুটি স্পীকারকে রাষ্ট্রপতি শপথ গ্রহণ করান।
(খ) রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রদূত ও অন্যান্য কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের প্রেরণ ও গ্রহণ করেন।
(গ) সংবিধানের ১২৭ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে মহাহসিাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রককে রাষ্ট্রপতি নিয়োগদান করেন।
(ঘ) সংবিধানের ১৩৮ অনুচ্ছেদ এর (১) দফা অনুসারে প্রত্যেক সরকারি কর্মকমিশনের সভাপতি ও অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হন।
(ঙ) সংবিধানের ১৩২ অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রজাতন্ত্রের হিসাব সম্পর্কিত মহা হিসাব নিরীক্ষকের রিপোর্টসমূহ রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করা হবে এবং রাষ্ট্রপতি তা সংসদে পেশ করার ব্যবস্থা করবেন।
রাষ্ট্রপতিকে সর্বোতভাবে সহযোগিতার জন্য রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে দুটি বিভাগ রয়েছে। সরকারি বিভাগ ও ব্যক্তিগত বিভাগ। সরকারি বিভাগের দায়িত্ব হল রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপতিকে সাংবিধানিক, আইনগত ও নির্বাহী দায়িত্ব পালনে দাপ্তরিক সহায়তা দান। ব্যক্তিগত বিভাগের দায়িত্ব হল রাষ্ট্রপতির বাসভবন সংক্রান্ত কার্যক্রম, অন্যদেশীয় ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের অভ্যর্থনা, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা প্রভৃতি পালন করা। সংসদীয় ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় প্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কার্যাবলি অনেকটাই প্রতীকস্বরুপ হলেও প্রাতিষ্ঠানিক গণতান্ত্রিক চর্চায় রাষ্ট্রপতির দক্ষ ক্ষমতা প্রয়োগ ও কার্য সম্পাদন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।