সিভিল সার্ভিস যেকোন রাষ্ট্রব্যবস্থায় অবিচ্ছেদ্য অংশ। বর্তমান সিভিল সার্ভিসের ইতিহাস ব্রিটিশ ভারতের শাসকগোষ্ঠী প্রবর্তিত সিভিল সার্ভিসেরই ক্রমবিকাশ ধারার উত্তরাধিকার। ব্রিটিশ শাসকগণ এই উপমহাদেশে তাদের ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য ভারতীয় সিভিল সার্ভিস নামে প্রচন্ড শক্তিশালী একটি এলিট প্রশাসনিক সার্ভিস সৃষ্টি করেছিল। তবে এই প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছিল বৈশিষ্ট্য পূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান। কেউ এই সার্ভিসকে আখ্যায়িত করেছে ‘স্বর্গ সৃষ্ট একটি সার্ভিস’ বলে। আবার কারও কারও মতে এটি ছিল, পৃথিবীর অন্যতম সুদৃশ ট্রেড ইউনিয়নতুল্য। পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর মতে ভারতীয় সিভিল সার্ভিস একটি ‘রুদ্ধদ্বার কর্পোরেশন’। জোসেফ চেলির নিকট লিখিত এক পত্রে ভারতের গভর্ণর জেনারেল লর্ড জাফরিন বলেছিলেন, এর মত সর্বাঙ্গ সুন্দর সিভিল সার্ভিস পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সিভিল সার্ভিসের প্রায় দেড়শ বছরের ধারাবাহিক ইতিহাস রয়েছে। আর সে ইতিহাস সত্যিই বিচিত্র।
ভারতীয় সিভিল সার্ভিস
সাধারণত ইংরেজিতে সিভিল সার্ভিস বলতে যা বুঝায় ভারতীয় সিভিল সার্ভিস ছিল তা থেকে ভিন্ন। ভরতীয় সিভিল সার্ভিস ছিল ভারতের শাসন ব্যবস্থার শীর্ষ বিন্দু এবং দক্ষ এলিট প্রশাসনিক গোষ্ঠী। ভারতীয় সিভিল সার্ভিস শুধুমাত্র সরকারের শাসন বিভাগ পরিচালনার দায়িত্বই গ্রহণ করেনি, সাথে সাথে সরকারের নীতি নির্ধারণ করেছে। সার্ভিসের প্রবীণ সদস্যরা প্রাদেশিক গভর্ণরের দায়িত্ব পালন করেছেন, শ্রেষ্ঠ বিচারালয়ে বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। গভর্ণর আর গভর্ণর জেনারেলের শাসন পরিষদের সদস্য হিসেবেও কাজ করেছেন। এমনকি আইন পরিষদের সদস্য হিসেবে আইন প্রণয়নও করেছেন। একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের চাকুরী ব্যবস্থা থেকে ভারতীয় সিভিল সার্ভিস বিশ্বের অন্যতম খ্যাতনামা শাসন ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে।
ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের সূচনা
ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের জন্মলগ্ন ১৬০১ সালে। ১৬০০ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর “The Governor and Company of Merchants of London Trading into the East Indies” নামধারী লন্ডনের এক বণিকগোষ্ঠী রাণী এলিজাবেথের নিকট থেকে এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকায় বাণিজ্য করার সনদ লাভ করে। পরে সে বণিকগোষ্ঠী আরো কতিপয় বণিকগোষ্ঠীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নতুন এক সংগঠন তথা কোম্পানী গঠন করেন। ১৮৩৩ সালে সে কোম্পানিকে সংক্ষেপে বলা হয়, East India Company. East India Company এর নিয়ন্ত্রণে যে ভূখন্ড ছিল তা প্রথমে তিনটি প্রেসিডেন্সিতে বিভক্ত ছিল। বোম্বাই, মাদ্রাজ ও কোলকাতা এই তিনটি স্থানে কোম্পানির তিনটি বৃহৎ কুঠি ছিল ও কুঠির পরিচালক প্রেসিডেন্টের পদবী অনুসারে এই অঞ্চলগুলোকে প্রেসিডেন্সি নামে আখ্যায়িত করে। প্রেসিডেন্সিগুলো ছিল স্বতন্ত্র, তবে কোম্পানির নিকট দায়বদ্ধ। ১৭৭৩ সালে নিয়ন্ত্রণকারী আইনে সর্বপ্রথম গভর্ণর জেনারেল পদটির সৃষ্টি হয়। গভর্ণর জেনারেলকে সহায়তা করার জন্য একটি শাসন পরিষদ সৃষ্টি করা হয়। এই আইনে ব্রিটিশ সরকার ভারতে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার নীতি স্বীকার করে। তাছাড়া কোলকাতা প্রেসিডেন্সিকে ভারতের গভর্ণর জেনারেল নামে আখ্যায়িত করে বোম্বাই ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিকে কোলকাতা প্রেসিডেন্সির নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। এভাবে প্রেসিডেন্সিগুলোকে একত্রিত করা হয় ও সর্বভারতীয় সিভিল সার্ভিসের সূত্রপাত হয়।
Indian Civil Service তিনটি পর্বে বিকশিত হয়েছে। যথা-
- প্রথম পর্বের সূচনা হয় ১৬০১ সালে, আর তার সমাপ্তি ঘটে ১৭৭২ সালে। এ পর্বে কোম্পানির মৌল কার্যক্রম ছিল বাণিজ্য পরিচালনা। তবে মাঝে মাঝে কোম্পানির কর্মচারীদের শাসন কার্য পরিচালনা করতে হয়েছে।
- দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় ১৭৭২ সালে, আর তা শেষ হয় ১৮৫৫ সালে। এ পর্যায়ে বাণিজ্য পরিচালনা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। আর ১৮৩৩ সালে বাণিজ্য সংগঠন হিসেবে কোম্পানির সমাপ্তি ঘটে।
- তৃতীয় পর্ব ১৮৫৬ সালে শুরু হয়ে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এ পর্বে ভারতীয় সিভিল সার্ভিস এবং দক্ষ শাসন ব্যবস্থায় রুপলাভ করে।
সরকারী চাকুরী ভারতীয়করণ
ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে ভারতীয়দের অন্তর্ভূক্তের দাবি বহু দিনের। লর্ড কর্ণওয়ালিস ভারতের গভর্ণর জেনারেল নিযুক্ত হয়ে দায়িত্বপূর্ণ পদে ইউরোপীয়দের নিয়োগদানের নীতি গ্রহণ করেন। সকল প্রকার কর্তৃত্বব্যঞ্জক দায়িত্বপূর্ণ পদ থেকে ভারতীয় কর্মকর্তাদের ইচ্ছাপূর্বক সরিয়ে রাখা হয়। কর্ণওয়ালিসের এই নীতি ১৭৯৩ সালের সনদ আইনের ৫৯ নং ধারায় বলা হয় যে, কোম্পানির শাসন ব্যবস্থার কোন পর্যায়ে কোন পদ শূণ্য হলে কোম্পানির কর্মকর্তারা ডিরেক্টরদের কোর্টে যথনিয়মে নোটিশ প্রদান করবেন ও সে মোতাবেক ডিরেক্টর কর্মকর্তা নিয়োগ করে ভারতে পাঠাবেন। এই আইনির ৬ নং ধারাতে আরও বলা আছে কাউন্সিলরদের নিম্ন পর্যায়ের সকল কর্মকর্তা সিভিল সার্ভিসের সদস্যদের মধ্য হতে নিয়োগ লাভ করবেন। এই আইনটি এক দিক থেকে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের ‘ম্যাগনা কার্টা’ স্বরুপ ছিল। কেননা এই আইনে সিভিল সার্ভিস আিইনগত স্বীকৃতি লাভ করে ও কর্মকর্তাদের অধিকার স্বীকৃত হয়। কিন্তু অন্য দিকে এই আইনের ফলে উচ্চতর প্রশাসনে ভারতীয়দের অন্তর্ভূক্তির পথ রুদ্ধ হয়ে আসে। তখন থেকেই সিভিল সার্ভিসে ভারতীয়দের অন্তর্ভূক্তির দাবির প্রারম্ভ।
অনেক সময় বলা হয়েছে, ভারতীয় সিভিল সার্ভিস না ছিল কোন ভারতীয়, না ছিল সম্পূর্ণ সিভিল বা বেসামরিক রুপ, আর কোন দিনই এর লক্ষ্য সার্ভিস বা সেবা ছিল না। এ ধরণের উক্তি থেকে সিভিল সার্ভিস সম্পর্কে ভারতীয়দের মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। প্রশাসনে উচ্চ পর্যায় থেকে ভারতীয়দের দূরে সরিয়ে রাখার নীতি শুধুমাত্র ভারতেই সমালোচিত হয়েছে তা নয়। মুনরো, এলফিনস্টোন, ম্যালকম, হেনরি লরেন্স প্রমুখ দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ইংরেজ কর্মকর্তারাও এই নীতির সমালোচনায় মুখর ছিলেন।
ব্রিটিশ সরকার কতৃক গৃহীত পদক্ষেপ
১) ১৮৩৩ সালের আইন
১৮৩৩ সালের সনদ আইন অনুযায়ী ধর্ম, জন্মস্থান, বর্ণ, বংশ পভৃতির জন্য ব্রিটিশ ভারতের কোন ব্যক্তি ও ভারতে বসবাসরত ব্রিটিশ রাজ্যের কোন প্রজা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোন কর্ম বা চাকরির ক্ষেত্রে অযোগ্য ঘোষিত হবে না। শুধু তাই নয়, ব্রিটেনে House of Lords এ এক সভায় বলা হয়, ভারতের প্রতিটি কার্যালয়ে প্রতিটি ভারতবাসীর সমান অধিকার নিশ্চিত হবে। কিন্তু আইন প্রণীত হলেও ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে ভারতীয়দের অন্তর্ভূক্তির দাবি পূর্ণ হয়নি। কেননা নিয়োগদানের ক্ষেত্রে কোম্পানির ডিরেক্টর কোর্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন আর উচ্চতর পদগুলোতে ভারতীয়দের নিয়োগদানে তাদের ছিল অদ্ভুদ এক অনীহা। ১৮৩৩ সালের চার্টার আইনকে তারা সম্পূর্ণ নতুন ভাবে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন। তাদের মতে ভারতীয়দের অযোগ্যতা দূর হলেও উচ্চতর পদের জন্য কোন যোগ্যতার মানদন্ড নির্ধারিত হয়নি। কোম্পানির কোর্ট অর ডাইরেক্টর ভারত সরকারের নিকট এক লিপিতে বলেন, ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের সমান যোগ্যতা অর্জনের জন্য ভারতে এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে যেন ভারতীয়রা যোগ্য শিক্ষালাভ করে সিভিল সার্ভিসে নিয়োগ লাভে সক্ষম হয়। এভাবে এ পর্যায়ে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে ভারতীয়দের অন্তর্ভূক্তির প্রশ্নটি এড়িয়ে যাওয়া হয়।
২) ১৮৫৩ সালের অবাধ প্রতিযোগিতা
১৮৫৩ সালের সনদ আইনে সিভিল সার্ভিসের নিয়োগের ক্ষেত্রে অবাধ প্রতিযোগিতা প্রবর্তিত হলে অনেকে আশা পোষণ করেন। এবার ভারতীয়রা ‘সদর দরজা’ দিয়ে সিভিল সার্ভিসে নিয়োগ লাভ করতে পারবেন। অতীতের কুলগত বৈষম্যের অবসান হল। অবাধ প্রতিযোগিতা প্রবর্তিত হবার পর তোষণ নীতিরও অবসান হল। লর্ড মেকলেও দৃঢ় আশা পোষণ করেন যে সিভিল সার্ভিস ক্ষেত্রে এবার ভারতবাসীর আশা বাস্তবায়িত হবে। কার্যত অবাধ প্রতিযোগিতা ভারতবাসীদের জন্য দ্বার উন্মুক্ত করেনি। এর অনেক কারণ ছিল। যেমন-
- প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা লন্ডনে অনুষ্ঠিত হবার ফলে অতি অল্প সংখ্যক যুবক সে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছে।
- সর্বোচ্চ বয়সসীমা ২১ বছর নির্ধারিত হওয়ায় ভারতীয় যুবকদের পক্ষে সম পর্যায়ের শিক্ষা লাভ অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয়নি।
- ব্রিটেনের উচ্চমান সম্পন্ন শিক্ষায়তনের শিক্ষিত ছাত্রদের সাথে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে সফল হওয়া ছিল ভারতীয় ছাত্রদের জন্য প্রায় এক অসম্ভব কাজ।
- ধর্মীয় ক্ষেত্রেও ছিল বহু প্রতিবন্ধকতা। ভারতীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে সমুদ্র অতিক্রম করা ছিল অনেকটা ধর্মত্যাগেরই নামান্তর।
- আর্থিক সমস্যা ছাড়াও অল্প বয়সে ছেলেদের বিদেশে পাঠানোর প্রতি ছিল এক ভীতি ও অনিচ্ছা।
১৮৫৭ সালের ভারতীয় বিপ্লবের পর কোম্পানির শাসনের সমাপ্তি ঘটে, প্রত্যক্ষভাবে তা ব্রিটেনের মহারানী ভিক্টোরিয়ার নিয়ন্ত্রণে আসলে তিনি ভারতবাসীর উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেন, “জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে আমাদের সকল প্রজা তাদের শিক্ষা, সামর্থ্য ও সততার ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় কর্মব্যবস্থায় অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে নিযুক্ত হবেন”। মহারানী ভিক্টোরিয়ার ঘোষণার পর ভারতীয়রদের উচ্চাশা আরো বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বাস্তব অবস্থার পরিবর্তন তেমন হয়নি। এবং ভারতীয় সিভিল সার্ভিসকে ভারতীয়করণের তেমন কোন প্রচেষ্টাও গ্রহণ করা হয়নি।
৩) সংবিধিবদ্ধ সিভিল সার্ভিস
ঊনিশ শতকের পাঁচ দশক থেকে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের ভারতীয়করণের দাবির মূল কথা ছিল দুইটি। যথা- (ক) ব্রিটের ও ভারতে একসাথে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা অনুষ্ঠান; (খ) প্রার্থীদের বয়:সীমা বৃদ্ধি। ব্রিটিশ সরকার এই দুইটি দাবি পূরণ না করে মনোনয়নের মাধ্যমে দাবি পূরণে সচেষ্ট হন।
১৮৭০ সালে আইন প্রণীত হয় ও আইনে ব্যবস্থা করা হয় যে, ভারতের কর্মব্যবস্থায় সপরিষদ ভারত সচিবের মঞ্জুরী ভিত্তিতে সপরিষদ জেনারেল কর্তৃক স্থিরীকৃত নিয়ম পদ্ধতি অনুযায়ী ভারতীয়দের নিয়োগ দান করা হবে। এই আইনে যে নিয়ম পদ্ধতি স্থির করা হয় তাকে কেন্দ্র করে ভারত সরকার ও ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের মধ্যে তীব্র এক মতবিরোধ দেখা দেয়। আর দীর্ঘ ৯ বছরে সে মত পার্থক্যের অবসান হয়নি। ১৮৭৯ সালের পূর্ব পর্যন্ত ১৮৭০ সালের আইনকে কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। এ আইনে বিধিবদ্ধ হয় যে, ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের এক-ষষ্ঠাংশ পদ ভারতীয়দের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। এসব ভারতীয় প্রার্থী স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক মনোনীত হবে। এই আইনে নিযুক্ত কর্মকর্তাদের বলা হতে “সংবিধিবদ্ধ প্রশাসনিক কর্মকর্তা”।
সংবিধিব্ধ সিভিল সার্ভিস ভারতীয়দের সন্তুষ্ট করতে না পারার পিছনে অনেকগুলো কারণ ছিল। প্রথমত, এ সার্ভিসের জন্য মনোনীত কর্মকর্তাদের নির্দিষ্ট পদে নিয়োগদান করা হতো। তারা ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের সদস্য হতেন না। দ্বিতীয়ত, তাদের জন্য যে বেতন ধার্য করা হয় তা সিভিল সার্ভিসের সদস্যদের থেকে অনেক কম ছিল। তৃতীয়ত, এসব কর্মকর্তাদের পদমর্যাদা ছিল ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের সদস্যদের অপেক্ষা নিম্ন।
সংবিধিবদ্ধ সিভিল সার্ভিসের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ ছিল নিয়োগদান ক্ষেত্রে ছিল স্বজনতোষণ ও পৃষ্ঠপোষকতার অবাধ গতি। নীতিগত দিক থেক মনোনয়ন দান পদ্ধতি সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিল। মনোনয়ন দান পদ্ধতিকে অনেকেই ভারতীয়দের অযোগ্যতার প্রতীক হিসেবে অসম্মানজনক মনে করেছে। এসব কারণে সংবিধিবদ্ধ সিভিল সার্ভিস ভারতীয়দের বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষিত হিন্দু সম্প্রদায়ের শ্রদ্ধা অর্জনে সক্ষম হয়নি। তাই অনেক পর্যবেক্ষকের মতে, ভারতের উচ্চতর প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ভারতীয়দের অন্তর্ভুক্তির পদ্ধতি হিসেবে সংবিধিবদ্ধ সিভিল সার্ভিস ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
- আমলাতন্ত্র কি? আমলাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য, কার্যাবলি ও ত্রুটিসমূহের আলোচনা
- বাংলাদেশে আমলাতন্ত্রের রাজনীতিকরণের কারণ ও প্রভাব
৪) এচিশন কমিশন (১৮৮৬-১৮৮৭)
এই কমিশনের সভাপতি ছিলেন পাঞ্জাবের গভর্ণর এচিশন। কমিশনের সর্বমোট সদস্য ছিল ১৫ জন। এই কমিশনের লক্ষ্য ছিল, এমন ব্যবস্থা উদ্ভাবন করা যা প্রশাসনের উচ্চতর পর্যায়ে ভারতীয়দের নিয়োগের দাবির প্রতি পূর্ণ সুবিচার করতে পারে ও কর্মাবস্থায় প্রয়োজনীয় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত করতে পারে।
এচিশন কমিশনের সুপারিশ: কমিশন ভারতের কর্মব্যবস্থার বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে নিম্ন লিখিত সিদ্ধান্তে উপনীত হন:
- যুগপৎ প্রতিযোগীতা মূলক পরীক্ষার দাবি নাকচ: ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে ভারতীয়দের অন্তর্ভূক্তির দাবির বিশিষ্ট এক উপাদান ছিল ভারত ও ইংল্যান্ডে যুগপৎ পরীক্ষার দাবি। কমিশন এ দাবির যৌক্তিকতা পরীক্ষা করে তা নাকচ ঘোষণা করেন।
- বয়:সীমা বৃদ্ধি: এচিশন কমিশন ইংল্যান্ড ও ভারতে যুগপৎ পরীক্ষা অনুষ্ঠানের দাবি নাকচ করলেও প্রার্থীদের বয়:সীমা বৃদ্ধির দাবি সমর্থন করেন। এচিশন কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রার্থীদের সর্বোনিম্ন ও সর্বোচ্চ বয়স নির্ধারিত হয় ১৯ ও ২৩ বছর।
- পাঠক্রম পরিবর্তন: এচিশন কমিশন ভারতীয় পরীক্ষার্থীদের আরো একটি অসুবিধা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তা হল পরীক্ষার পাঠক্রমে কিছুটা পরিবর্তন। কমিশন বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে সুপারিশ করেন, আরবি ও সংস্কৃত ভাষার সাম্প্রতিক অনুশীলন বৃদ্ধির ফলে এগুলো ল্যাটিন ভাষার মর্যাদা লাভ করবে।
- সংবিধিবদ্ধ সিভিল সার্ভিসের বিলুপ্তি: এচিশন কমিশনের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল ১৮৭০ সালের সৃষ্ট সংবিধিবদ্ধ সিভিল সার্ভিসের বিলুপ্তির সুপারিশন। সংবিধিবদ্ধ সিভিল সার্ভিস ভারতীয়দের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। এ সার্ভিসের কার্যকারিতা শুধুমাত্র অসন্তোষই সৃষ্টি করেছে। তাই কমিশন এই সার্ভিসের বিলুপ্তির সুপারিশ করে।
- চুক্তিবদ্ধ সিভিল সার্ভিসের নতুন নামকরণ: এচিশন কমিশন চুক্তিবদ্ধ সিভিল সার্ভিসের নতুন নামকরণ করেন। তা হল, ‘ইম্পিরিয়াল সিভিল সার্ভিস অব ইন্ডিয়া’।
- প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিস ও অধস্তন সিভিল সার্ভিস: এচিশন কমিশনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল ভারতীয় সিভিল সার্ভিসকে ‘এলিট প্রশাসনিক ব্যবস্থা’ তে রুপান্তর করা। তাছাড়া এচিশন কমিশন প্রত্যেক প্রদেশে একটি করে ‘প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিস’ এবং নিম্ন পর্যায়ের প্রশাসনিক কাজের জন্য ‘অধস্তন সিভিল সার্ভিস’ সংগঠনের সুপারিশ করেন।
- অন্যান্য সুপারিশ: ভারতীয় সিভিল সার্ভিসকে এলিট প্রশাসনিক ব্যবস্থা, ভারতীয়দের অংশগ্রহণের জন্য প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিস ও অধস্তন সিভিল সার্ভিস সংগঠন ছাড়াও এচিশন কমিশন বিশেষ বিশেষ বিভাগের জন্য অনেকগুলো সুপারিশ প্রদান করে। কমিশন সুপারিশ করে যে, পুলিশ, শিক্ষা, বন, পূর্ত বিভাগ এর জন্য প্রশাসনিক ব্যবস্থা এমন ভাবে সংগঠিত করতে হবে যেন উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সংখ্যা হয় তুলনামূলক ভাবে অল্প ও তারা প্রধানত ব্রিটেন থেকেই নিয়োগ লাভ করে। মধ্যম ও নিম্ন পর্যায়ের জন্য ভারতবসাসীদের নিয়োগ উত্তরোত্তর বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়।
বাস্তবায়ন: ভারত সরকার এচিশন কমিশনের অধিকাংশ সুপারিশ গহণ করেন। যেমন-
- সংবিধিবদ্ধ সিভিল সার্ভিসের অবসান হয়।
- প্রাদেশিক ও অধস্তন সিভিল সার্ভিসের ভিত্তি পত্তন হয়।
- প্রার্থীদের সর্বোচ্চ বয়:সীমা ২৩ বছরে উন্নীত হয়।
- চুক্তিবদ্ধ সিভিল সার্ভিসের জন্য নির্ধারিত এক-ষষ্ঠাংশ প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিসের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
- চুক্তিবদ্ধ সিভিল সার্ভিসের নাম ‘ভারতীয় সিভিল সার্ভিস’ করা হয়।
৫) ভারতীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা সম্পর্কে রাজকীয় (ইসলিংটন) কমিশন, ১৯১৭
এচিশন কমিশনের সুপারিশ ভারতীয়দের খুশি করতে ব্যর্থ হয়। ভারতে উচ্চ শিক্ষার প্রসার, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন চেতনা, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব প্রভৃতি বিভিন্ন কারণে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে ভারতীয়দের অন্তর্ভূক্তির দাবি বিশ শতকের প্রথম দশকে অত্যন্ত প্রবল হয়ে উঠে। এদিকে মুসলিম নেতৃবর্গও প্রথমবারের মতো এ দাবির প্রতি সমর্থন দান করে। মহামান্য আগা খান বলেন, ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের জন্য পরীক্ষা ভারত ও ব্রিটেনে হওয়া দরকার, কেননা উভয় দেশে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলে অধিক সংখ্যক ভারতীয় অংশগ্রহণে সক্ষম হবেন এবং তাদের অসন্তোষ দূরীভূত হবে।
এদিকে এসময় প্রশাসনিক ব্যবস্থার জটিলতা, মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং তার জন্য প্রশাসকদের বেতন বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তাও দেখা দিয়েছিল। এ প্রেক্ষিতে নিউজিল্যান্ডের গভর্ণর লর্ড ইসলিংটনের সভাপতিত্বে ১৯১২ সালে একটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন করা হয়। এই কমিশনের সদস্য সংখ্যা ছিল ১০ জন। এই কমিশন তিনটি নীতির ভিত্তিতে পর্যালোচনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। সেগুলো হলো-
- ব্রিটিশ ভারতে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে উন্নতমান বজায় রাখা নীতি,
- ভারতে ব্রিটিশ শাসনের নীতি সুদৃঢ় রাখার নীতি, ও
- ভারতীয়দের যুক্তিযুক্ত দাবি পূরণ করে ভারতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা নীতি।
কমিশন ১৯১৫ সালে রিপোর্ট প্রণয়ন সমাপ্ত করলেও প্রথম মহাযুদ্ধের কারণে তা প্রকাশিত হয় ১৯১৭ সালে।
ইসলিংটন কমিশনের সুপারিশ: ইসলিংটন কমিশন নিম্নোক্ত সুপারিশগুলো করে-
- অধিক সংখ্যক ভারতীয়দের সুযোগদান: ইসলিংটন কমিশন সুপারিশ করে যে, ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে শতকরা ৭৫ জন অবাধ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ব্রিটেনে নিয়োগ লাভ করবে। আর অবশিষ্ট শতকরা ২৫ জন মনোনয়নের মাধ্যমে ভারতবর্ষ থেকে বাছাই করা হবে। কমিশনের মতে, এ ব্যবস্থায় যথেষ্ট সংখ্যক ভারতীয়দের অন্তর্ভূক্তির সুযোগ থাকবে।
- মনোনয়ন ব্যবস্থা: ভারতীয় প্রশাসনের উচ্চতর পর্যায়ে ভারতীয়দের অধিক সংখ্যক অন্তর্ভূক্ত করার পদ্ধতি হিসেবে ইসলিংটন কমিশন মনোনয়ন দানের ব্যবস্থাকেই অধিক যুক্তিযুক্ত মনে করেন। মনোনয়ন পদ্ধতির মাধ্যমে প্রত্যেক অঞ্চল ও সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে অসমতা দূর করা সম্ভব হবে বলে কমিশন মত প্রকাশ করে।
- কর্মকর্তাদের বেতন বৃদ্ধি: ইসলিংটন কমিশন ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের ব্রিটিশ ও ভারতীয় সদস্যদের মধ্যে বেতনের ক্ষেত্রে এক ব্যবধান ও বৈষম্য রচনার সুপারিশ করেন। কমিশনের মতে, এ তারতম্যের ভিত্তি বর্ণগত নয়, বরং অর্থনৈতিক প্রয়োজন।
- বিশেষ বিশেষ কর্মব্যবস্থা সম্পর্কে সুপারিশ: সিভিল সার্ভিস ছাড়াও অন্যান্য বিশেষিকৃত সার্ভিসে ভারতীয়দের যথেষ্ট পরিমাণে অন্তর্ভূক্ত করার জন্য ইসলিংটন কমিশন কতগুলো সুপারিশ করেন। পুলিশ সার্ভিসের শতকরা ২৫ ভাগ ভারতীয়দের মধ্য থেকে মনোনয়নের মাধ্যমে বাছাইয়ের সুপারিশ করা হয়। শিক্ষা, চিকিৎসা, জরিপ, টেলিগ্রাফ ও রেলওয়ে বিভাগ সম্পর্কে কমিশনের মত ছিল যে, এসবের বড় অংশ ব্রিটেন থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত না হলেও চলবে। কমিশনের মতে, শুল্ক ও অর্থ বিভাগের সকল কর্মকর্তা ভারতীয়দের থেকে বাছাই করা যেতে পারে। যেহেতু কর্মব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে ভারতীয়দের অবস্থা ছিল অত্যন্ত নগন্য। তাই ইসলিংটন কমিশনের সুপারিশ ভারতীয়করণের ক্ষেত্রে ছিল বিপ্লবাত্মক।
- ব্রিটেন ও ভারতে যুগপৎ পরীক্ষা গ্রহণের দাবি নাকচ: ইসলিংটন কমিশনের মতে, এ ব্যবস্থায় উচ্চ পর্যায়ে অদক্ষ ও যোগ্য শিক্ষায় শিক্ষিত নয় এমন ব্যক্তিবর্গের আগমন শুরু হতে পারে। ব্রিটেন ও ভারতে যুগপৎ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলে সমমান রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে উঠবে। এসব কারণে কমিশন যুগপৎ পরীক্ষার দাবি নাকচ করে।
- কর্মাবস্থায় কাঠামোগত পরিবর্তন: এই কমিশনের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ ছিল ভারতীয় কর্মাবস্থায় কাঠামোগত পরিবর্তন। কমিশন ভারতীয় কর্মব্যবস্থাকে স্তর ভিত্তিক প্রথম শ্রেনী, দ্বিতীয় শ্রেনী, তৃতীয় শ্রেণী ও চতুর্থ শ্রেণীতে বিভক্ত করা এবং আনুভূমিক ভাবে রাজকীয় সিভিল সার্ভিস, কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিস, প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিস ও অধস্তন সিভিল সার্ভিস এই চার ভাগে বিভক্ত করার প্রস্তাব দেন।
- চাকরির শর্তাবলি: ইসলিংটন কমিশন চাকরির শর্তাবলি নির্ধারণ করার জন্য বিভিন্ন প্রকারের ভাতা সংক্রান্ত বিধি বিধানকে সহজ সরল করার সুপারিশ করেন। ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের জন্য স্বতন্ত্র ছুটির নির্দেশ দেন আর পেনশন বিধি উদার ভাবে বিবেচনার সুপারিশ করেন।
কমিশনের সুপারিশ সম্পর্কে ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া
ইসলিংটন কমিশনের সুপারিশগুলো ছিল অত্যন্ত যুগোপযোগী। কর্মব্যবস্থার কাঠামো সম্পর্কে কমিশনের কিছু কিছু সুপারিশ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বেসামরিক প্রশাসন থেকে সামরিক কর্মকর্তাদের সরিয়ে রাখার প্রস্তাব ছিল অত্যন্ত আধুনিক। তা সত্ত্বেও ইসলিংটন কমিশনের সুপারিশ ভারতীয়দের সন্তুষ্ট করতে সক্ষম হয়নি। সিভিল সার্ভিসকে ভারতীয়করণের পদ্ধতি হিসেবে ইসলিংটন কমিশন মনোনয়ন পদ্ধতির সুপারিশ করেন যা তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়। কে. কে. চন্দ ইসলিংটন কমিশনের রিপোর্টকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অসুস্থ, নৈতিক দিক থেকে অন্যায় ও রাজনৈতিক দিক থেকে বিপজ্জনক বলে চিহ্নিত করেছেন। স্যার মোহাম্মদ সফিও বলেছিলেন, কমিশন যতটুকু সপারিশ করেছেন, প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ভারতীয়দের অংশগ্রহণ তার বহুগুণ বেশি হওয়া প্রয়োজন। ১৯১৮ সালের শাসনতান্ত্রিক সংস্কার রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইসলিংটন কমিশনের রিপোর্ট ভারতীয় জনগণকে সন্তুষ্ট না করে উত্তেজিত করেছিল মাত্র।
৬) ভারত শাসনতান্ত্রিক সংস্কার ( মন্টেগু-চেমসফোর্ড) রিপোর্ট,১৯১৮
ভারতবাসীগণের প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করা তথা ভারতে জাতীয়তাবাদের নতুন সুর অণুরণিত হবার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকার ভারতে উদারনৈতিক নীতির সূচনা করেন। ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে ভারতীয়দের অন্তর্ভূক্তির পরিপ্রেক্ষিতে মন্টেগু চেমসফোর্ড রিপোর্ট এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। নিম্নে এ রিপোর্টের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সম্পর্কে আলোচনা করা হল-
- সিভিল সার্ভিসের ভারতীয়করণ: মন্টেগু-চেমসফোর্ড রিপোর্টে বলা আছে. ভারতে দায়িত্বশীল সরকার গড়ে তোলবার জন্য প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ক্রমবর্ধমান হারে ভারতীয়দের অন্তর্ভূক্ত করা দরকার। প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ভারতীয়দের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে তারা শুধু বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হয়ে শাসন ব্যবস্থার সাথে একাত্মা প্রতিষ্ঠা করবে তাই নয়, প্রশাসনিক ক্ষেত্রে নৈপুন্য ও দক্ষতা অর্জন করবে ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় দক্ষ ব্যক্তির সংখ্যা ভারতে বৃদ্ধি পাবে।
- ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের নতুন ভূমিকা: এই রিপোর্টে সুপারিশ করা হয় যে, ভারতীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থার দক্ষতা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য ব্রিটিশ সরকারকে প্রাধান্য ও প্রভাব বজায় রাখা অপরিহার্য। আরও বলা হয় যে, ভারতে সুশাসন প্রতিষ্ঠান ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান গঠন করার ক্ষেত্রে ব্রিটিশদের ভূমিকা হবে অনন্য ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সাথে মন্ত্রীদের সম্পর্ক: এ রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, এখন থেকে উচ্চতর পর্যায়ের কর্মকর্তারা মন্ত্রীদের উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করবেন ও নীতি নির্ধারণে মন্ত্রীদের নিরপেক্ষভাবে সহায়তা করবেন।
- প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অধিকার সংরক্ষণ: ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনে ভারতীয় মন্ত্রীদের আংশিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষিতে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অধিকার সংরক্ষণের প্রয়োজন সর্ব প্রথম দেখা দেয়। মন্টেগু-চেমসফোর্ড রিপোর্টেও তাদের অধিকার রক্ষার সুপারিশ করা হয়।
মন্টেগু-চেমসফোর্ড রিপোর্টের মূল্যায়ণ
ভারতীয় সিভিল সার্ভিস সংগঠনে ভারতীয় কর্মকর্তাদের অধিক স্বার্থ সংরক্ষণ পরিপ্রেক্ষিতে মন্টেগু-চেমসফোর্ড রিপোর্টের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনে সর্ব প্রথম প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা সংকোচিত করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়। এই আইনে ভারতে সর্বপ্রথম আংশিকভাবে স্বায়ত্তশাসন মঞ্জুর করা হয় ও দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারতীয় মন্ত্রীদের হাতে কিছুটা নীতি নির্ধারণের ক্ষমতা ন্যাস্ত করা হয়। মন্টেগু-চেমসফোর্ড রিপোর্টের আর একটি দিক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ রিপোর্টে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের সদস্য ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের স্বার্থ ও অন্যান্য অধিকার রক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থার সুপারিশ করা হয়। ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনে তা বাস্তবায়নের ব্যবস্থাও সম্পূর্ণ হয়।
- কল্যাণমূলক রাষ্ট্র কাকে বলে? কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যগুলো কি কি? কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের কার্যাবলীগুলো লিখ।
- সমাজবিজ্ঞানের ক্রিটিক্যাল মডেলের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর। লোকপ্রশাসনের সঙ্গে এর প্রাসঙ্গিকতা পরীক্ষা কর।
৭) ভারতের উচ্চতর কর্মব্যবস্থা রাজকীয় কমিশন (লী কমিশন),১৯২৪
১৯২৩ সালে ফেয়ারহ্যাম লর্ড লী কে সভাপতি করে একটি রাজকীয় কমিশন গঠন করা হয়। সিভিল সার্ভিসে নিয়োগ, চাকরির উপর নিয়ন্ত্রণ ও ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী সরকারি কর্ম কমিশন গঠন প্রভৃতি বিষয়ে পর্যালোচনার দায়িত্ব ছিল এ কমিশনের। লী কমিশনের প্রধান সুপারিশগুলো নিম্নে তুলে ধরা হল-
- কর্মব্যবস্থার শ্রেণীবিভাগ: লী কমিশন ভারতের কর্মব্যবস্থাকে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেন। এগুলো হলো- (ক) রক্ষিত বিষয়ে কর্মরত বিভাগ, (খ) হস্তান্তরিত বিষয়ে কর্মরত বিভাগ, এবং (গ) কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন কর্মরত প্রশাসনিক বিভাগ।
- প্রশাসনিক ব্যবস্থার ভারতীয়করণ: প্রশাসনিক ব্যবস্থার ভারতীয়করণের ব্যাপারে লী কমিশনের যে সুপারিশ ছিল তা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই কমিশন প্রশাসনকে দ্রুতহারে ভারতীয়করণের জন্য ও ভারতীয়দের উপস্থিতির হার বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
- চাকরির শর্তাবলি: লী কমিশনের উল্লেখযোগ্য সুপারিশ ছিল প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের চাকরির শর্তাবলির উন্নতি সাধন। এই কমিশন বেতন বৃদ্ধিসহ কর্মকর্তাদের বিভিন্ন প্রকার ভাতা, পেনশন ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধার জন্য সুপারিশ করেন।
- পাবলিক সার্ভিস কমিশন: লী কমিশনের আর একটি উল্লেখযোগ্য সুপারিশ হলো ভারতে পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন। প্রশাসনিক কর্মকর্তা বাছাইয়ের মান নির্ধারণ, প্রয়োজনবোধে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ, তাদের চাকরির শর্তাবলি নিয়ন্ত্রণ ও কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ হবে এর মৌল দায়িত্ব।
লী কমিশনের মূল্যায়ণ
লী কমিশনের সুপারিশ ছিল এক দিক থেকে অত্যন্ত প্রগতিবাদী। কেননা এ কমিশনের সুপারিশের ফলে ভারতের সিভিল সার্ভিসগুলোর ভারতীয়করণের পথ প্রশস্ত হয়ে উঠে। ভারতীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ভারতীয়দের অন্তর্ভূক্তির প্রশ্নে এরপর থেকে সকল প্রতিবন্ধকতা ও যুক্তি দূর্বলতর হয়ে আসে। ভারতে দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষিতে এ পদক্ষেপ বেশ যুক্তিযুক্ত। কিন্তু লী কমিশনের সুপারিশ তখন কোন পক্ষকেই খুশি করতে পারেনি। ইউরোপীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তারা এ রিপোর্টে খুশি হয়নি। কেননা লী কমিশনের অধিকতর ভারতীয়করণের সুপারিশকে তারা অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি বলে মনে করেছে।
৮) সাইমন কমিশন
লী কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়িত হবার পরও ভারতীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা সম্পর্কে নতুন নতুন প্রশ্নের প্রেক্ষিতে জন সাইমনের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করা হয়। ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের সংগঠনের ক্ষেত্রে এ কমিশনের অবদান উল্লেখযোগ্য। সাইমন কমিশনের সুপারিশগুলো হলো-
- ভারতীয় সিভিল সার্ভিস ও ভারতীয় পুলিশ সার্ভিসের ক্ষেত্রে ভারত সচিব কর্তৃক সর্ব ভারতীয় পর্যায়ে নিয়োগ: সাইমন কমিশন সুপারিশ করে যে, ভারতীয় সিভিল সার্ভিস ও ভারতীয় পুলিশ সার্ভিসের নিয়োগ ও পরিচালনার দায়িত্ব ন্যাস্ত হওয়া উচিৎ ভারত সচিবের উপর এবং এই দুই সার্ভিসের নিয়োগ হওয়া উচিৎ সর্বভার্তীয় পর্যায়ে।
- কর্মব্যবস্থায় অধিক হারে ভারতীয় নিয়োগ: ভারতের কর্মব্যবস্থায় অধিক হারে ভারতীয় নিয়োগের প্রশ্নে সাইমন কমিশন লী কমিশনের সিদ্ধান্তকে যুক্তিযুক্ত বলে গ্রহণ করে এবং ভারতীয় সিভিল সার্ভিস ও ভারতীয় পুলিশ সার্ভিসে ভারতীয় ও ইউরোপীয়দের নিয়োগের হার ৫০:৫০ অপরিবর্তিত রাখা হয়।
- সর্বভারতীয় সার্ভিসগুলোতে নিয়োগ ব্যবস্থা: এই কমিশনের সুপারিশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সর্বভারতীয় সার্ভিসগুলোতে নিয়োগ ব্যবস্থার জন্য সুপারিশ ও বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ।
- সর্বভারতীয় কর্মকর্তাদের অধিকার সংরক্ষণ: সাইমন কমিশন শুধুমাত্র নবাগত কর্মকর্তাদের সুযোগ-সুবিধার জন্য সুপারিশ করেছিল তাই নয়, কর্মরত কর্মকর্তাদের সকল স্বার্থ ও অধিকার সংরক্ষণের জন্য বিশেষভাবে সুপারিশ করেছিল।
- প্রদেশের জন্য পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন: প্রাদেশিক পাবলিক সার্ভিস কমিশনের কর্মকর্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ, কর্মকর্তাদের নিয়োগের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি, সাম্প্রদায়িক স্বার্থ বা পারিবারিক স্বার্থে স্বজনপ্রীতি বা অনুরুপ অভিযোগ যেন না আসে এসব কারণে প্রাদেশিক পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠনের সুপারিশ।
৯) প্রথম গোল টেবিল বৈঠকের সার্ভিস সাব-কমিটি, (১৯৩০-১৯৩১)
প্রথম গোল টেবিল বৈঠকের সার্ভিস সংক্রান্ত সাব-কমিটি চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সুপারিশ করেন-
- সর্বভারতীয় সার্ভিসের গুরুত্ব: ভারতীয় সিভিল সার্ভিস ও ভারতীয় পুলিশ সার্ভিসে সর্বভারতীয় ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান করা, ভারতীয় প্রকৌশলী সার্ভিসের সেচ বিভাগ ও ভারতীয় বন বিভাগের প্রাদেশীকীকরণের সুপারিশ।
- ভারতীয়করণ: ভারতীয় কর্মব্যবস্থায় ভারতীয়করণ সম্পর্কে গোল টেবিল বৈঠকের সাব-কমিটির সুপারিশ ছিল অনেকটা সাইমন কমিশনেরই অনুরুপ।
- কর্মব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িকভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব: সাব-কমিটি প্রশাসনিক ব্যবস্থায় নিরপেক্ষতা ও দক্ষতা আনয়নের জন্য বিভিন্ন সম্প্রদায়ের যথোপযুক্ত প্রতিনিধিত্বের সুপারিশ করে।
- কর্মকর্তাদের অধিকার সংরক্ষণ: বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ন্যায্য অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য সাব কমিটি ভবিষ্যতের সংবিধানে পর্যাপ্ত রক্ষাকবচের সুপারিশ করেন।
১০) যুক্ত বাছাই কমিটি (১৯৩৩-১৯৩৪)
গোল টেবিল বৈঠকের সাব-কমিটির ন্যায় ব্রিটিশ পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত যুক্ত বাছাই কমিটিও ভারতের কর্মব্যবস্থার বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে ও নিম্নলিখিত সুপারিশগুলো করে-
- সর্বভারতীয় সার্ভিস: যুক্ত বাছাই কমিটি সুপারিশ করে যে, কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও নিয়ন্ত্রণের তথা কর্মকর্তারেদ চাকরির শর্তাবলি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব থাকবে ভারত সচিবের উপর। কয়েক বছর পরপর সার্ভিসের নিরীক্ষণ করতে হবে।
- কর্মব্যবস্থায় ভারতীয়করণ: ভারতীয় কর্ম ব্যবস্থার ভারতীয়করণ সম্পর্কে কমিটির সুপারিশগুলো ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় সিভিল সার্ভিস ও পুলিশ সার্ভিসে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ইউরোপীয়দের উপস্থিতি ও কর্মব্যবস্থার অন্যান্য শাখায় অনতিবিলম্বে ভারতীয়দের জন্য জায়গা করে দেওয়ার মত প্রকাশ করে।
- প্রাদেশিক পাবলিক সার্ভিস কমিশন: সাইমন কমিশনের মত যুক্ত বাছাই কমিটিও সরকারি কর্মকর্তাদের সততা, দক্ষতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে প্রাদেশিক পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠনের সুপারিশ করেন।