4.1K
চার্বাক দর্শন
পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায় যে, কোন একটি দার্শনিক মতবাদ কিছুদিন ধরে সকলের স্বীকৃতি ও সমাদর লাভ করলেও পরে নিজের প্রভাব ও প্রাধান্য হারিয়ে নতুন কোন দার্শনিক মতবাদকে তার জায়গাটি ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু ভারতীয় দর্শন আলোচনা করলে দেখা যায় যে, বিভিন্ন ভারতীয় দর্শনগুলি বিভিন্ন সময়ে উদ্ভূত হয়েও সুদীর্ঘ কাল ধরে নিজ নিজ প্রভাব প্রতিপত্তি বজায় রেখে বিভিন্ন দর্শনের সাথে সহ-অবস্থান ও দীর্ঘকাল সমানভাবে বিকাশ লাভ করেছে। এটাই ভারতীয় দর্শনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
ভারতীয় ইতিহাসে চার্বাক দর্শন বিশুদ্ধ জড়বাদী দর্শন। জড়বাদ বলতে সাধারণত সেই দার্শনিক মতবাদকেই বোঝায়, যে মতবাদ অনুযায়ী অচেতন জড় পদার্থই একমাত্র সত্তা ও তত্ত্ব। চার্বাক দর্শনের মতে, এই জগতের সবকিছুই জড় থেকে উদ্ভূত; এমনকি অ-জড়াত্মক প্রাণ এবং মনও। চার্বাক দর্শন জড়বাদী বলে আত্মা ও ঈশ্বরকে বিশ্বাস করে না।
দর্শন
“দৃশ” ধাতু থেকে দর্শন শব্দের উৎপত্তি। যার শব্দগত অর্থ হল “দেখা”, ব্যাপক অর্থে “দেখানো”, “দেখতে সাহায্য করা”। দর্শন মানে তত্ত্ব দর্শন, জগৎ এবং জীবের স্বরুপ উপলব্ধি। সত্যের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি বা পরমতত্ত্ব সাক্ষাৎকারই দর্শন। অর্থাৎ যে শাস্ত্র পরম তত্ত্বকে দেখতে এবং পরমতত্ত্ব সম্বন্ধীয় সত্যকে উপলব্ধি করতে পথের নির্দেশ দেয় তাকে দর্শন বলে।
“দর্শন” ইংরেজি “Philosophy” শব্দের প্রতিশব্দরুপে ব্যবহৃত হয়। ইংরেজি “Philosophy” এবং “Philosopher” শব্দ দুটি গ্রীক শব্দ থেকে উদ্ভত হয়েছে। গ্রীক শব্দ “Philos” মানে হল জ্ঞান এর অনুরাগ এবং “Sophia” মানে হল জ্ঞান(Knowledge)। সুতরাং “Philosophy” শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ (Love for Knowledge)। পাশ্চাত্য দার্শনিক মারভিন(Marvin) দর্শন সম্পর্কে বলেন- “দর্শন হল সত্যের প্রতি অনুরাগ, সব সত্য যার অন্তর্ভূক্ত এমন জ্ঞানের পূর্ণ ভান্ডার, যাতে সব সত্য এক স্থানে মহান অখন্ডতার মধ্যে সুবিন্যস্ত”। ওয়েবার(Weber) বলেন- “দর্শন হল প্রকৃতি বিষয়ক এক সামগ্রিক দৃষ্টিলাভের অনুসন্ধান, বস্তুর সার্বিক ব্যাখ্যা দেবার প্রচেষ্টা।
চার্বাক দর্শন
ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে চার্বাক দর্শন এক উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছে। চার্বাক দর্শন অতি প্রাচীন একটি দর্শন। ভারতীয় দর্শনে বিশুদ্ধ জড়বাদী দর্শনকে চার্বাক দর্শন বলা হয়। চার্বাক দর্শনের মতে, অচেতন জড় পদার্থই একমাত্র সত্তা ও তত্ত্ব। এই জড় উপাদান থেকেই এ জগতের সবকিছুর উৎপত্তি। দেহের অতিরিক্ত কোন আত্মা বা ঈশ্বর নেই।
চার্বাক দর্শনের উৎপত্তি
চার্বাক দর্শনের কোন প্রামাণ্য গ্রন্থ না পাওয়ায় চার্বাক শব্দের মূল অর্থকে কেন্দ্র করে মতভেদ রয়েছে। কারও মতে. চার্বাক নামে একজন ঋষি ছিলেন। তিনিই চার্বাক দর্শনের প্রবর্তক এবং তাঁর নামানুসারে চার্বাক দর্শন নাম হয়েছে। কারও মতে, “চার্বাক” কথাটির অর্থ চারু+বাক্ বা মধুর কথা। চার্বাক দর্শনের একটি কথা হলো- “যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ; ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ।” অর্থাৎ যতদিন বাঁচ সুখে বাঁচ; ঋণ করেও ঘি খাও। এসব মধুর কথা চার্বাক দর্শন সাধারণের কাছে প্রচার করে বলে এর নাম চার্বাক দর্শন। কারও মতে “চর্ব” ধাতু থেকে চার্বাক এসেছে। কোন কোন গ্রন্থে বৃহস্পতিকে চার্বাক দর্শনের প্রবর্তকরুপে অভিহিত করা হয়। এজন্য এর অপর নাম “বার্হস্পত্য দর্শন”।
চার্বাক জ্ঞানতত্ত্ব
চার্বাক জ্ঞানতত্ত্বের উপরই চার্বাক দর্শন দাঁড়িয়ে অছে। জ্ঞানের উৎপত্তির সমস্যাটি জ্ঞানতত্ত্বের অন্যতম আলোচ্যবিষয়। এই সমস্যার আলোচনার সঙ্গে জড়িত রয়েছে একটি প্রশ্ন, সেটি হল জ্ঞানের বিভিন্ন উৎসগুলি কি কি। ভারতীয় দর্শনে যথার্থ জ্ঞানকে বলা হয় “প্রমা” এবং যথার্থ জ্ঞানলাভের প্রণালীকে বলা হয় “প্রমাণ”। চার্বাকদের মতে, ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ। যা প্রত্যক্ষ করা যায় তাই সত্য, যা প্রত্যক্ষ করা যায় না তা সত্য নয়। যে বস্তু কোন কালেও কোনভাবে প্রত্যক্ষগোচর হয় না তা নেহাতই অলীক। চার্বাকরা অনুমান(Inference) এবং শব্দকে (Testimony) প্রমাণরুপে গ্রহণ করার বিরুদ্ধে নিম্নোক্ত যুক্তিগুলো প্রদর্শন করেন।
ক) অনুমান প্রমাণ নয়
১) অনুমান ব্যাপ্তি জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল কিন্তু ব্যাপ্তজ্ঞান প্রত্যক্ষ নয়:
অনুমানলব্ধ জ্ঞান সম্ভাব্য মাত্র, সুনিশ্চিত নয়। অনুমান হল নিছক অন্ধকারে ঝাঁপ দেওয়া (a mere leap in the dark)। অনুমানের ক্ষেত্রে আমরা জানা সত্য থেকে অজানা সত্যে উপনীত হই এবং অজানা সত্য সম্পর্কে আমাদের অনুমান যে সুনিশ্চিত হবেই এমন কথা নেই, যদিও আকস্মিকভাবে কোন কোন অনুমান সত্য হয়।
অবরোহ অনুমান চক্রকদোষে দুষ্ট। কেননা অবরোহ অনুমানে সিদ্ধান্তটিকে পূর্ব থেকেই সাধ্য আশ্রয় বাক্যে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে, যে সাধ্য আশ্রয় বাক্যের যাথার্থ্য প্রমাণিত হয়নি। আরোহ অনুমান, অবরোহ অনুমানের সাধ্যে আশ্রয়বাক্যের যাথার্থ্য প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু আরোহ অনুমানও অনিশ্চিত, কেননা আরোহ অনুমান জানা থেকে অজানাতে উপনীত হতে চায়, যা করার অধিকার তার নেই। এর উত্তরে একথা বলা যায় য়ে, আরোহ অনুমানের এই অধিকার আছে, কেননা আরোহ অনুমান ব্যাপ্তিজ্ঞান নির্ভর। পর্বতে ধূম দেখে যখন আমরা অনুমান করি যে, পর্বতে বহ্নি আছে, তখন এই অনুমানের ভিত্তি হল ধূম এবং বহ্নির মধ্যে নিয়ত অব্যভিচারী সম্বন্ধ। ধম ও বহ্নি অর্থাৎ অনুমানের হেতু ও সাধ্যের মধ্যে এই নিয়ত অব্যভিচারী সম্বন্ধকেই ব্যাপ্তি সম্বন্ধ বলে। ধূম ও বহ্নির এক অধিকরণে থাকার সম্বন্ধই ব্যাপ্তি। চার্বাকরা ব্যাপ্তি সম্বন্ধকে নিছক আন্দাজের ব্যাপার বলে মনে করেন। ব্যাপ্তিজ্ঞান বিশেষ সংখ্যক দৃষ্টান্তের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাদের মতো এই ব্যাপ্তি সম্বন্ধ প্রত্যক্ষের বিষয় হতে পারে না।
আরও পড়তে পারেন: গান্ধার শিল্পের সংক্ষিপ্ত ধারণা দাও। বৌদ্ধ শিল্পকলার ইতিহাসে এর গুরুত্ব মূল্যায়ন কর। |
২) দুটি বস্তু পাশাপশি থাকলেই তাদের মধ্যে নিয়ত সম্বন্ধ আছে, এই কথা প্রমাণিত হয় না:
চার্বাকগণ আরও বলেন, দুটি বস্তু পাশাপাশি অবস্থান করলেই তাদের মধ্যে নিয়ত সম্বন্ধ আছে, এই কথা প্রমাণিত হয় না। কারণ, বস্তু দুটি প্রত্যক্ষ করা যায় বটে, কিন্তু তাদের সম্বন্ধকে তো প্রত্যক্ষ করা যায় না। যেমন- ধূম ও অগ্নি পাশঅপাশি থাকলে তাদের মধ্যে নিয়ত সম্বন্ধ আছে এরুপ প্রমাণিত হয় না। কারণ তাদের প্রত্যক্ষ করা চলে, তাদের সম্বন্ধকে প্রত্যক্ষ করা চলে না। সুতরাং এই সম্বন্ধ সন্দেহাত্মক।
৩) দুটি বস্তুর মধ্যে বর্তমানে প্রত্যক্ষগোচর কোন নিয়ত সম্বন্ধ সাব সময় যে সত্য হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই:
চার্বাকগণের আপত্তি হচ্ছে- কোন নিয়ত সম্বন্ধ বর্তমানে প্রত্যক্ষগোচর হলেও অতীতে বা ভবিষ্যতে সেই সম্বন্ধ সত্য নাও হতে পারে। যেমন- বর্তমানে ধূমের সঙ্গে অগ্নির নিয়ত সম্বন্ধ প্রত্যক্ষগোচর হলেও অতীতে সে সম্বন্ধ ছিল না এবং ভবিষ্যতেও যে সত্য হবে, তার কোন নিশ্চয়তা নেই।
৪) ব্যাপ্তিজ্ঞান অনুমান নির্ভরও হতে পারে না:
চার্বাকগণের মতে, ব্যাপ্তিজ্ঞান কোন অনুমান নির্ভর হতে পারে না। কারণ যদি কোন অনুমানের উপর নির্ভর করে, তবে সেই অনুমানের ব্যাপ্তিকে আবার আর একটি অনুমানের উপর নির্ভর করতে হয়ে। এইভাবে অনুমানের অনুমান করতে থাকলে অনবস্থা (Infinite Regress) দোষ ঘটবে। চার্বাকরা বলেন, অনুমান যথার্থ হল কিনা সেটাই বিচার্য বিষয়। সুতরাং অনুমানের উপর ভিত্তি করে ব্যাপ্তিজ্ঞান প্রমাণিত হয় না।
৫) ব্যাপ্তিজ্ঞান কোন বিশ্বাসযোগ্য ব্যাক্তির বাক্যের উপর নির্ভর করলেও অনুমান সিদ্ধ হয় না:
ব্যাপ্তিজ্ঞান যদি কোন বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তির বাক্যের উপর নির্ভর করে, তবে সেই ব্যাপ্তিজ্ঞান সন্দেহাতীত নয়, কারণ বক্তা যে বিশ্বাসযোগ্য আপ্তপুরুষ সেই জ্ঞান অনুমানলব্ধ, তাই সন্দেহপূর্ণ। আর সন্দেহের উপর যা নির্ভর করে তা সন্দেহাতীত হয় না।
৬) অনুমানলব্ধ জ্ঞান সম্ভাবনামূলক, নিশ্চিত নয়:
অনুমানের বিরুদ্ধে চার্বাকদের আর একটি আপত্তি হল- অনুমানলব্ধ জ্ঞান প্রত্যক্ষের মতো এতটা সুস্পষ্ট নয়, তাই এই জ্ঞান সম্ভাবনামূলক, সুনিশ্চিত নয়। অনুমান হল অন্ধকারে ঢিল মারার মত। আমাদের অনুমান যে সুনিশ্চিত হবেই এমন কোন কথা নেই, যদিও আকস্মিকভাবে কোন কোন অনুমান সত্য হয়। যে সব দৃষ্টান্ত প্রত্যক্ষ করা হচ্ছে সেগুলির ক্ষেত্রে একটি সামান্য বচন সত্য হতে পারে, কিন্তু যে সব দৃষ্টান্ত প্রত্যক্ষ করা হচ্ছে না সেগুলির ক্ষেত্রেও সেই সামান্য বচনটি সত্য হবে সেই সম্পর্কে কোন নিশ্চয়তা নেই।
৭) অনুমানলব্ধ জ্ঞান বস্তু হতে সরাসরি আসে না, তাই তাকে যথার্থ জ্ঞান বলা চলে না:
চার্বাকগণ বলেন- অনুমানলব্ধ জ্ঞান বস্তু হতে সরাসরি আসে না, এটা আসে অন্য জ্ঞানের মাধ্যমে। তাই অনুমানলব্ধ জ্ঞানকে “যথার্থ জ্ঞান” বলা চলে না। সুতরাং অনুমানকেও যথার্থ প্রমাণরুপে গ্রহণ করা যায় না।
খ) শব্দ বা আপ্তবাক্য কোন প্রমাণ নয়
১) আপ্তবাক্য নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নয়:
ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায় এর অনেক শব্দ বা আপ্তবাক্যকে একটি যথার্থ প্রমাণ হিসাবে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু চার্বাকগণের মতে শব্দ নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নয়, কারণ শব্দ হল বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তির বচন মাত্র। কোন ব্যক্তি বিশ্বাসযোগ্য কিনা তা অনুমান করা হয় তার চরিত্রের উপর নির্ভর করে। অনুমান সেখানে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ নয়, সেখানে অনুমান নির্ভর শব্দকেও যথার্থ প্রমাণরুপে গ্রহণ করা যায় না।
২) বেদ বাক্যকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা যায় না:
চার্বাকগণের মতে বেদ-বাক্যও প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। কারণ বেদে এমন অনেক কথা আছে যা দুর্বোধ্য। এমনকি বোধগম্য অনেক কথাও আছে যেগুলি পরস্পর বিরোধী এবং বহু অর্থজ্ঞাপক। চার্বাকগণ বলেন- ভন্ড,ধূর্ত ও নিশাচর এই তিন রকম লোকের দ্বারা বেদ রচিত হয়েছে। অতএব, চার্বাক মতে, প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ, অনুমান ও শব্দ কোনটাই যথার্থ প্রমাণ নয়।
সমালোচনা
ভারতীয় দর্শনের অন্যান্য সব দর্শন সম্প্রদায়ই চার্বাক দর্শনের উপরিউক্ত অভিমতের কঠোর সমালোচনা করেছেন। এই সব দর্শন সম্প্রদায় কমপক্ষে প্রত্যক্ষ ও অনুমানের যথার্থ্য স্বীকার করেছেন। তাঁদের যুক্তিগুলো এইরুপ:
প্রথমত:
ব্যবহারিক দিক থেকে অনুমানের যাথার্থ্য অস্বীকার করা। সব চিন্তা, সব আলোচনা, সব স্বীকৃতি এবং অস্বীকৃতি, সব প্রমাণ এবং অ-প্রমাণ, সব মতবাদ অনুমানের সাহায্যেই সম্ভব হয়।
দ্বিতীয়ত:
প্রত্যক্ষ যথার্থ এবং অনুমান অযথার্থ, চার্বাকদের এই অভিমতই অনুমানের ফলস্বরুপ।
তৃতীয়ত:
কেবলমাত্র অনুমানের সাহায্যেই চার্বাকরা অপরের বক্তব্যকে বুঝতে পারে এবং নিজের বক্তব্যকে অপরের কাছে বোধ্যগম্য করে তুলতে পারে। বৌদ্ধ দার্শনিকদের মতে, চার্বাকরা অনুমানের সাহায্যেই জানে যে অন্যান্য দর্শন সম্প্রদায় অনুমানে বিশ্বাসী। চিন্তন এবং ধারণা জড়বস্তু নয়, সেহেতু তাঁদের প্রত্যক্ষ করা যায় না। তাদের কেবল অনুমানই করা যেতে পারে।
চতুর্থ:
যে প্রত্যক্ষকে চার্বাকরা যথার্থ মনে করে, অনেক সময়ই তা ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়। আমাদের মনে হয় পৃথিবী সমতল, কিন্তু আসলে পৃথিবী গোলাকার, মনে হয় পৃথিবী স্থির, কিন্তু পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘূর্ণায়মান। এই সব ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ লব্ধ জ্ঞান অনুমানের দ্বারাই ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়।
পঞ্চমত:
বিশুদ্ধ প্রত্যক্ষ অর্থে যদি নিছক সংবেদনকে বুঝতে হয় তা কখনও প্রমাণরুপে গণ্য হতে পারে না, যদি না ঐ সংবেদনকেই চিন্তনের সাহায্যে সুবিন্যস্ত, সুসংগঠিত ও সুশৃঙ্খল করে নেওয়া হয়।
ষষ্ঠত:
অনুমানের আযাথার্থ্য প্রমাণ করতে গিয়ে চার্বাকদের একাধিক যুক্তি উপস্থাপিত করতে হয়েছে। বস্তুত: চার্বাকরা যুক্তি ছাড়া নিজেদের মতবাদকে সমর্থন করতে পারে না এবং সেটা করা মানেই অনুমান বা যুক্তির যাথার্থ্য স্বীকার।
উপসংহার
চার্বাক দর্শন সংশয়বাদী, জড়বাদী, উচ্ছেদবাদী, দৃষ্টবাদী, হেতুবাদী, বিতন্ডাবাদী, মন-আত্মবাদী, ভূতচতুষ্টয়বাদী, স্বভাববাদী, সুখবাদী। চার্বাকরা নাস্তিক, ঈশ্বরের বিশ্বাস করে না, বেদকে প্রামাণ্য বলে গ্রহণ করে না। পাপপূণ্য কর্মফল মানে না, তারা স্বর্গ-নরক, ইহলোকের পর যে পরলোক আছে তা তারা স্বীকার করে না, জন্ম-জন্মান্তরবাদ, ধর্মাধর্ম কোন কিছুতেই স্বীকার করে না। তাদের মতে, প্রত্যক্ষের বাইরে কোন কিছুর অস্তিত্ত্ব নেই। অর্থাৎ চার্বাক দর্শন লোকায়ত দর্শন। চার্বাক দর্শন মানবিক মূল্যকে স্বীকৃতি দেয়নি। অপরদিকে চার্বাক দর্শন স্বাধীন চিন্তাধারার পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে। সুশিক্ষিত চার্বাকরা উচ্চস্তরের সুখভোগের উপর গুরুত্ব দিয়েছে। চার্বাক দেহাত্মবাদ প্রচার করে আমাদের দৃষ্টি অসীম থেকে সসীমের দিকে, আধ্যাত্মিকতা হতে মনুষ্যদেহের দিকে, অস্পষ্টের দিক হতে স্পষ্টের দিকে, স্বর্গ, পরলোক ও জন্মান্তর হতে এই পৃথিবী, ইহলোক, সংসার ও সুদুর্লভ মনুষ্যজন্ম, বাস্তবের দিকে আকৃষ্ট করতে চেষ্টা করেছেন।
লেখা সম্পাদক: নমরত্ন চাকমা