ভাষা আন্দোলনের পটভূমি
নিম্নে ভাষা আন্দোলনের পটভূমি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
১) অফিস-আদালতে উর্দু ভাষার ব্যবহার
পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই মুসলিম লীগ সরকার বাঙালি জাতির উপর নানাভাবে অত্যাচার, উৎপীড়ন শুরু করে। ৫৬ ভাগ লোকের মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও অফিস-আদালতে ইংরেজি ও উর্দু ব্যবহারের পাশাপাশি খাম, পোস্টকার্ড প্রভৃতির মত ছোটখাটো জিনিসেও উর্দু ব্যবহার হতে থাকে। এভাবে সরকার বাঙালিদের অনুভূতিতে আঘাত হানে। ১৯৪৭ সালের ১লা সেপ্টেম্বর গঠিত ‘তমুদ্দিন মজলিস’ সর্বপ্রথম বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করে।
২) গণপরিষদে ইংরেজি ও উর্দুর ব্যবহার
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হওয়ার পূর্বেই স্থির হয় যে, কেবল ইংরেজি ও উর্দু হবে গণপরিষদের ভাষা। গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও গণপরিষদে ব্যবহার করার অধিকার দাবি করেন। কিন্তু তার এ দাবি অগ্রাহ্য করা হয়। এর প্রতিবাদে ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ প্রদেশব্যাপী সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালন করা হয় এবং সর্বত্র বিক্ষোভ ও শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়।
৩) জিন্নাহর ঘোষণা
পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় ঘোষণা দেন, “Urdu and Urdu, shall be the state language of Pakistan.” ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি আরো জোর দিয়ে বলেন, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। আর অন্য কোনো ভাষা নয়।” জিন্নার এ সদম্ভ উক্তি বুদ্ধিজীবি ও ছাত্র মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গণপরিষদে পেশকৃত মূলনীতি রিপোর্টেও উল্লেখ করা হয়, “উর্দুই পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হবে।” এর প্রতিবাদে পূর্ব বাংলায় তুমুল বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
আরও পড়ুন: বাংলা বানান সংস্কারের প্রেক্ষাপট আলোচনা কর
৪) আরবি হরফে বাংলা লেখার ব্যবহার
বাংলা ভাষাকে বিভিন্নভাবে পর্যুদস্ত করা ছাড়াও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষাকে বিকৃত করার উদ্দেশ্যে আরবি হরফে বাংলা লেখার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এতে বাঙালি জনসাধারণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
৫) খাজা নাজিমুদ্দিনের ঘোষণা
১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পল্টন ময়দানের জনসভায় পাকিস্তানের তদানিন্তন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেন যে, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা।” ঐ ঘোষণার প্রতিবাদে ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় প্রতিবাদ দিবস পালিত হয়। ৩১শে জানুয়ারি “সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ” গঠিত হয়।
৬) ভাষা আন্দোলনের ঘটনাবলি
উপরিউক্ত কারণসমূহের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী ‘রাষ্ট ভাষা দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত হয়। ইতোমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের নুরুল আমীনের সরকার ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্য রাত হতে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি এবং সকল প্রকার সভা, শোভাযাত্রা নিষেধ করেন। কিন্তু, ছাত্র সমাজ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পূর্ব নির্ধারিত ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে “রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই” শ্লোগান তুলে ঢাকার রাজপথে মিছিল বের করে। পুলিশ মিছিলের উপর গুলিবর্ষণ করলে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ অনেকে শহীদ হন। অনেকে গ্রেফতার হয়। এতে করে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে দেশের আপামর জনসাধারণ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। পরে ১৯৫৬ সালের সংবিধানে পাকিস্তানি সরকার উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।
আন্দোলনের গুরুত্ব ও ফলাফল
বাঙালির জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। নিম্নে তা আলোচনা করা হলো-
১) জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাঙালিদের মনে জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি করে। কাজেই, বাঙালি জাতীয়তাবোধ বিকাশে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
২) দাবি আদায়ের শিক্ষা
ভাষা আন্দোল বাঙালির মধ্যে দাবি আদায়ের শিক্ষা দেয়। তাই এদেশের জনগণ তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৭১ সালে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম দেয়।
৩) সাম্প্রদায়িকতার অবসান
ভাষা আন্দোলন বাঙালির মধ্য থেকে সাম্প্রদায়িকতা দূর করে সকল ধর্ম-বর্ণ ও গোত্রের মধ্যে একতা ও সম্প্রীতি সৃষ্টি করে।
৪) মুসলিম লীগের পরাজয়
ভাষা আন্দোলনের ফলে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের কাছে মুসলিম লীগ সরকারের শোচনীয় পরাজয় ঘটে।
৫) সকল আন্দোলনের প্রেরণার উৎস
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন সকল আন্দোলনের প্রেরণার উৎস ছিল। ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ছয়দফা, ছাত্রদের ১১ দফা, ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থান ও ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ এ ভাষা আন্দোলনেরই প্রেরণার উৎস।
৬) বাঙালি এলিট শ্রেণির উদ্ভব
ভাষা আন্দোলন বাঙালির এলিট শ্রেণির উদ্ভব ঘটায়। বাঙালি কবি, সাহিত্যিকরা ছাত্র জনতার পাশে এসে দাঁড়ায়।
৭) পারস্পরিক সন্দেহের সৃষ্টি
ভাষা আন্দোলনের ফলে পাকিস্তানের দুটো অংশের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহের সৃষ্টি করে।
৮) ছাত্র রাজনীতির প্রসার
ভাষা আন্দোলন ছাত্র রাজনীতির প্রসার ঘটায়। ছাত্ররা বুঝতে পারে যে, দাবি আদায়ের জন্য এক্যবদ্ধ হতে হবে।
উপসংহার
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। মূলত এ আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবোধ বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এ আন্দোলন সাংস্কৃতি আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও এটি ছিল রাজনৈতিক আন্দোলন। এ আন্দোলন বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ হতে শিখিয়েছে। পরবর্তীতে ১৯৫২ সালের এ ভাষা আন্দোলন সকল আন্দোলনের প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করে।
3 comments
whoah this blog is wonderful i really like reading your articles. Keep up the great paintings! You realize, a lot of people are hunting round for this info, you could help them greatly.
I have read so many posts about the blogger lovers however this post is really a good piece of writing, keep it up
Excellent
Comments are closed.