দেবপালের কৃতিত্ব ও চরিত্র মূল্যায়ন
দেবপালের রাজত্বকালকে পালবংশের ইতিহাসে উত্থানের যুগ বলা হয়। দেবপালের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলা ও বিহারে পাল সাম্রাজ্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং উত্তর ভারতীয় রাজনীতিতে বলিষ্ঠ অবদান রাখার মতো শক্তি সঞ্চারিত হয়েছিল। মধ্যদেশে প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টায় পাল সাম্রাজ্য এক ত্রিশক্তির সংঘর্ষের সম্মুখীন হয়। অল্পকালের জন্য হলেও মধ্যদেশে তাদের প্রভুত্ব স্থাপিত হয়েছিল। এটিই বোধয় বাংলার প্রথম সাফল্য। পার্শ্ববর্তী রাজ্যসমূহে তাঁদের বিজয়াভিযানও সাফল্যমন্ডিত হয়েছিল। এক কথায় বলা যেতে পারে যে, দেবপালের অধীনে পাল সাম্রাজ্য স্বীয় ক্ষমতা উত্তর ভারতীয় রাজনীতিতে প্রদর্শন করার মতো শক্তিশালী হয়েছিল।
মহারাজাধিরাজ দেবপাল
ধর্মপালের মৃত্যুর পর দেবপাল পাল সাম্রাজ্যের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ধর্মপাল এবং রন্নাদেবীর পুত্র ছিলেন। তবে জৈষ্ঠ্যপুত্র ছিলেন না। ধর্মপালের খলিমপুর তাম্রশাসনটি যুবরাজ ত্রিভূবন পালের নির্দেশে প্রচারিত হয়েছিল। সম্ভবত পিতার জীবিতাবস্থায় ত্রিভূবন পালের মৃত্যু হলে দেবপাল পৈত্রিক সিংহাসনে বসেন। তার সিংহাসন প্রাপ্তি নিরূপদ্রবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তিনি পরমসৌগত পরমেশ্বর পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ পদবিযুক্ত ছিলেন। তাঁর পুত্রদ্বয় মহেন্ডপাল এবং শূরপালের তাম্রশাসনানুযায়ী চাহমান বংশের শ্রেষ্ঠ নরপতি দুর্লভ রাজের কন্যা সম্রাট দেবপালের পত্নী ছিলেন। গরুড় স্তম্ভলিপি অনুসারে গর্গের পুত্র দর্ভপাণি ছিলেন তাঁর মন্ত্রী।
দেবপালের কৃতিত্ব
পরমেশ্বর, পরম ভট্টারক, মহারাজাধিরাজ দেবপাল পাল সাম্রাজ্য অক্ষুণ্ণ রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন। পাল রাজাদের লিপিমালায় দেবপালের কৃতিত্বের গুণগান অতীব উচ্চস্বরে করা হয়েছে। মনে করা হয় যে, দেবপাল পিতা কর্তৃক অনুসৃত নীতি অবলম্বন করে সাম্রাজ্য বিস্তারে সচেষ্ট হয়েছিলেন এবং তাঁর সাফল্য সভাকবিগণকে প্রশস্তি রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল।
নাগভট্টের পর প্রতীহার সাম্রাজ্য দুর্বল উত্তরাধিকারী ও যুবক রাষ্ট্রকূটরাজা অমোঘবর্ষের নিষ্প্রভতা দেবপালকে রাজ্য বিস্তারের জন্য পূর্ণ সুযোগ দিয়েছিল। দেবপালের মুঙ্গের তাম্রশাসনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাজ্যজয় উপলক্ষে তাঁর সৈন্যদল বিন্ধ্যাপর্বত ও কম্বোজ (উত্তর পশ্চিম সীমান্ত) অঞ্চলে বিচরণ করেছিল এবং তিনি উত্তর হিমালয় থেকে রামেশ্বর সেতুবন্ধ পর্যন্ত এবং পূর্বে ও পশ্চিমে সমুদ্রবেষ্টিত সমগ্র ভূভাগ শত্রুমুক্ত করে শাসন করেছিলেন। তার মন্ত্রী দর্ভপাণি ও কেদারমিশ্রের বংশের ষাদলা শিলালিপিতে দেবপালের রাজ্যজয়ের প্রায় একই রকম বিবরণ রয়েছে। কেবলমাত্র দক্ষিণের রাজ্যসীমা সেতুবন্ধের পরিবর্তে বিন্ধ্যপর্বত পর্যন্ত বলা হয়েছে।
এই লিপিতে আরো বলা হয়েছে যে, দেবপাল উৎকলকুল ধ্বংস, হুণ, গর্ব, খর্ব এবং দ্রবিড় ও গুর্জর রাজাদের দর্প চূর্ণ করে দীর্ঘকাল আসমুদ্র পৃথিবী ভোগ করেছিলেন। নারায়ণপালের ভাগলপুর তাম্রশাসনেও দেবপালের রাজ্যজয়ের বিবরণ রয়েছে।
দেবপাল কর্তৃক উড়িষ্যা জয়ের উল্লেখ বাদললিপি ও ভাগলপুর তাম্রশাসনে আছে। তারনাথও এর উল্লেখ করেছেন। সামার্বতী রাজ্যে বিজয়াভিযান প্রেরণ খুবই স্বাভাবিক। ভঞ্জ বংশীয় রাজা রণভঞ্জের পরবর্তী কোনো সময়ে দেবপাল উড়িষ্যা অধিকার করে থাকবেন। এই সাফল্যের পর তার সৈন্যদল বিন্ধ্যপর্বত অঞ্চলেও অগ্রসর হতে পারে। এমনকি আরো দক্ষিণে অগ্রসর হয়ে পান্ড্য রাজার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া খুব অস্বাভাবিক নয়। পাললিপিমালায় বিন্ধ্যপর্বত অঞ্চলে সৈন্যদলের বিচরণ এবং দ্রবিড় রাজার দর্পচূর্ণের কথা বলা হয়েছে। সাধারণভাবে ঐতিহাসিকগণ দ্রবিড় রাজ্য বলতে রাষ্ট্রকূট রাজ্য মনে করেছেন এবং দেবপালর সঙ্গে রাষ্ট্রকূটরাজের সংঘর্ষের কথা চিন্তা করেছেন। কিন্তু দ্রবিড় বলতে সাধারণত দাক্ষিণাত্য বুঝায় না। সুতরাং লিপিতে উল্লেখিত দ্রবিড় রাজা পান্ড্যরাজা হওয়া খুব অস্বাভাবিক নয় এবং উড়িষ্যা জয়ের পর আরও দক্ষিণে সৈন্যদলের অগ্রসর ও পান্ড্য রাজার সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটাও সম্ভব।
আরও পড়ুন: শশাঙ্ক কে ছিলেন? বাংলার প্রথম নরপতি হিসাবে শশাঙ্কের কৃতিত্ব মূল্যায়ন
দেবপালের রাজ্য বিস্তৃতি সম্বন্ধে নারায়ণপালের শাসনামলে উৎকীর্ণ বাদল স্তম্ভলিপির বিবরণ অন্যান্য সকল সূত্রকে ছাড়িয়া গেছে। স্তম্ভলিপিকার লিখেছে,
“উৎকিলিতোৎকলকুলম হৃতহুনগর্বম
খর্বিকৃত দ্রবিড়-গুর্জর-নাথ দর্পম।”
অর্থাৎ সম্রাট দেবপাল উৎকল জয় করেছিল, হুনদের গর্ব খর্ব করেছিল। দ্রাবিড় এবং গুর্জরপতির দর্প হরণ করেছিল।
দেবপালের নালন্দা তাম্রশাসনে পাঁচটি গ্রাম দানের উল্লেখ আছে। জাভা ও সুমাত্রার শৈলেন্দ্র রাজ নালন্দায় মঠ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি এর ব্যয় নির্বাহের জন্য পাঁচটি গ্রাম প্রার্থনা কেরন। দেবপালের নালন্দা তাম্রশাসনে এই দানই লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এই ঘটনা থেকে বাংলা ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দ্বীপপুঞ্জের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রমাণ পাওয়া যায়। এটি আরও প্রমাণ করে যে বিখ্যাত বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্র নালন্দার খ্যাতি নবম শতাব্দী পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল এবং ভারতের বাইরেও এটি সুপরিচিত ছিল।
নালন্দা বিহারের প্রতি যে দেবপাল যত্নবান ছিলেন তার প্রমাণ অন্য আর একটি লিপিতে পাওয়া যায়। বীরদেব নালন্দার পরিচালনার ভার প্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং তিনি দেবপালের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন বলে ঘোসরাওয়া লিপিতে ঘোষণা করা হয়েছে।
দেবপালের রাজত্বকালও ছিল দীর্ঘ। নালন্দা তাম্রশাসন তার ৩৫ রাজ্যাঙ্কে উৎকীর্ণ হয়েছিল। বাদল শিলালিপিতে দেখা যায় যে, গুরবমিশ্রের বংশের তিন পুরুষের তিনজন মন্ত্রী তার অধীনে কার্যরত ছিলেন। সুতরাং দেবপালের সুদীর্ঘ রাজত্বকাল সম্বন্ধে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। আনুমানিক ৮২১ থেকে ৮৬১ খৃষ্টাব্দের মধ্যে তার রাজত্বকাল নির্দিষ্ট করা যেতে পারে।
দেবপালের চরিত্র
দেবপাল পিতার উপযুক্ত পুত্র ছিলেন বলা যায়। পালযুগের তাম্রশাসনসমূহে তাঁর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়েছে। এই প্রশংসায় অতিরঞ্জন আছে এইটা ঠিক, কিন্তু বাস্তব ঘটনারও অভাব নাই। তাঁর শাসনামলে পাল সাম্রাজ্য সমগ্র ভারতের শক্তিশালী রাজ্যসমূহের মধ্যে অন্যতম ছিল।
সমসাময়িককালের লিপিসমূহ পাঠে মনে হয়, তিনি একজন স্বধর্মনিষ্ঠ রাজা ছিলেন। মুঙ্গের তাম্রলিপির প্রশস্তিকারের বর্ণনায় তিনি নির্মলচেতা, সংযতবাক,পবিত্রকায় কর্মনিরত ছিলেন। তাঁর পুত্র প্রথম শূরপালের মির্জাপুর তাম্রশাসনে তাঁর চারিত্রিক গুণাবলির প্রশংসা করা হয়েছে। বিহারের একটি শিলালিপি হতে জানা যায় যে, তিনি তৎকালের খ্যাতনামা বৌদ্ধ পন্ডিত বীরদেবকে শ্রদ্ধাঞ্জলী জানিয়েছিলেন।
উপসংহার
অরাজকতার যুগের অবসান ঘটিয়ে গোপাল পাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং দেবপাল সাম্রাজ্যের জন্য অধিকতর গৌরব অর্জন করেন। প্রায় ৪০ বছর (৮২১ থেকে ৮৬১ খৃষ্টাব্দে) রাজত্বকাল নিঃসন্দেহে পাল বংশের ও বাংলার ইতিহাসে গৌরবময় যুগের সূচনা করেছিল। তবে সভাকবিদের বর্ণনায় সেই গৌরব যতখানি উজ্জ্বলভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে ততখানি সাফল্য অবশ্যই বিশ্বাসযোগ্য নয়।