Home » মুর্শিদকুলি খান এর রাজস্ব ব্যবস্থা পর্যালোচনা কর

মুর্শিদকুলি খান এর রাজস্ব ব্যবস্থা পর্যালোচনা কর

by TRI

সুবাদার ও দীউয়ান মুর্শিদকুলি খান বাংলায় মোগল শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার (১৬০৮-১৬১৩) প্রায় এক শতাব্দী পর (১৭০০ খ্রিঃ) রাজস্ব ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসেন। তার বাংলায় নিযুক্তির পূর্বে রাজস্ব ব্যবস্থা মোটেই যথার্থ ছিল না। মুর্শিকুলী খান রাজস্ব প্রশাসনের ক্ষেত্রে বিরাজমান সকল অবস্থা ও অনিয়মের অবসান ঘটিয়ে রাজস্ব সংস্কারের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সুনিশ্চিত করেন।

মুর্শিদকুলি খান এর রাজস্ব ব্যবস্থা

মুর্শিদকুলি খানের দীউয়ান নিযুক্তির পূর্বে বাংলার রাজস্ব ব্যবস্থার যথেষ্ট অবনতি ঘটেছিল। আকবরের রাজত্বকালে টোডরমল উত্তর ভারতীয় রাজস্বনীতি বাংলায় চালু করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। আওরঙ্গজেবের আমলের খ্যাতনামা সুবাদার মীর জুমলা ও শায়েস্তা খানও রাজস্ব ক্ষেত্রে তেমন কোন কৃতিত্বের পরিচয় দিতে পারেনি। দীউয়ান লাভ করেই মুর্শিদকুলি খান লক্ষ্য করেন যে, প্রায় সমগ্র প্রদেশ কর্মচারীদের মধ্যে জায়গীর হিসেবে বণ্টিত। এর ফলেই, ভূমি রাজস্ব হতে সরকারের অর্থাগম ছিল না বললেই চলে। বাণিজ্যশুল্কই রাজকোষের আয়ের প্রধান উৎস থাকায় বণিক সম্প্রদায়ের উপর প্রচন্ড চাপ পড়ত। তাছাড়া মোগল শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পরও পুরাতন ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার পরিবর্তন এনে নিয়মিত জরিপ ব্যবস্থা প্রচলন করা হয়নি। জমিদাররা প্রজাদের কাছ থেকে নির্ধারিত হারে খাজনা আদায় করত, কিন্তু সরকারকে নির্দিষ্ট রাজস্বই জমা দিত। রাজস্ব ব্যবস্থায় এ ধরণের অনিয়ম হতে উদ্ভূত রাষ্ট্রীয় ক্ষয়ক্ষতির কারণে মুর্শিদকুলি খান রাজস্ব সংস্কারের প্রয়োজন অনুভব করেন। রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য তিনি দু’ধরণের পন্থা অবলম্বন করেন।

প্রথমত: কর্মচারীদের জায়গীর গুলোকে সরকারের খাস জমিতে পরিণত করেন। এবং তাদের অনেককে উড়িষ্যার মত অনুন্নত ও জঙ্গলাকৃত অঞ্চল জায়গীর হিসেবে প্রদান করা হয়।

দ্বিতীয়ত: রাজস্ব আদায়ের ভার জমিদারদের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ইজারাদারদের হাতে ন্যস্ত করেন।

এছাড়া মুর্শিদকুলি খান তাঁর নিজস্ব রাজস্ব ব্যবস্থায় আরও যেসব পদক্ষেপ নেন সেগুলো হলো-

১) ইজারাদার নিযুক্তি: পুরাতন জমিদারগণ বিলাসিতা, অমিতব্যয়িতা ইত্যাদির কারণে নিয়মিত রাজস্ব দিতে পারত না। এ কারণে মুর্শিদকুলি ভূমি রাজস্ব ইজারা দেন। রাজস্ব আদায়ের কর্তৃত্ব নামমাত্র জমিদারদের হাতে বহাল রেখে ইজারাদারদের সাথে চুক্তিপত্রের মাধ্যমে তাদের উপর রাজস্ব আদায়ের প্রকৃত দায়িত্ব অর্পণ করেন। ইজারাদাররা নিয়মিতভাবে সরকারের রাজকোষে নির্দিষ্ট রাজস্ব জমা দেবে- এই শর্তে তাদের সাথে জমির বন্দোবস্ত করেন। তাঁর প্রবর্তিত নতুন ব্যবস্থা ”মাল জামিনি” নামে পরিচিত। প্রাচীন জমিদারদের মধ্যে যারা নতুন রাজস্ব ব্যবস্থা ও রাজস্ব আদায়ের চুক্তি গ্রহণে রাজী ছিল তাদেরকে ইজারাদার হিসেবে নিয়োগ করা হত।

আরও পড়ুন:  চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা কর

২) ভূমি জরিপের ব্যবস্থা: ইজারাদারদের সাথে বন্দোবস্তের পূর্বে মুর্শিদকুলি সমস্ত ভূমি বিঘাপ্রতি পরিমাপ করেন। মাপের ব্যাপারে ইজারাদার বা জমিদাররা যাতে হস্তক্ষেপ করতে না পারে, সে জন্য তাদেরকে আটক রাখা হত। ‘তারিখ-ই-বাংলার’ রচয়িতা সলিমুল্লাহ বলেন, “জমির পরিমাপ সঠিকভাবে নির্ধারণ করার জন্য তিনি সমস্ত খাজনা আদায়কারী ও আমিলগণকে ভূমি জরিপের নির্দেশ দেন।।”

৩) ভূমিকর নির্ধারণ: টোডরমলের রাজস্ব ব্যবস্থার মত মুর্শিদকুলি খান জমির উৎপাদন শক্তি কয়েক বছরের উৎপন্ন শস্যের বাৎসরিক গড় ইত্যাদি বিবেচনা করে ‘মোট উৎপাদিত’ শস্যের এক-তৃতীয়াংশ ভূমিকর নির্ধারণ করেন। প্রজারা টাকায় বা শস্যে ভূমিকর দিতে পারত। জমিদার অথবা ইজারাদার প্রজাদের কাছ থেকে নির্ধারিত হারের বেশি ভূমিকর দাবি করতে পারত না। 

৪) রাজস্ব আদায় ও হিসাব রক্ষণ: মুর্শিদকুলি খান রাজস্ব আদায় ও হিসাব রাখার ক্ষেত্রে কঠোর নীতি অবলম্বন করেন। মাসের শেষ দিনটিতে তিনি পাওনা আদায় করতেন। ইজারাদাররা কিস্তিতে রাজস্ব পরিশোধ করতে পারত। রাজস্ব আদায়ের কোনরূপ শৈথিল্য প্রদর্শন করলে তিনি জমিদার, আমিল ও কানুনগোদের শাস্তি দিতেন। রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য মুর্শিদকুলি খান সমগ্র বাংলাকে ১৩ টি এলাকায় বিভক্ত করেন।

৫) নানবার প্রবর্তন: মুর্শিদকুলি খান, প্রাচীন জমিদারদের অনেককে উচ্ছেদ করলেও তাদের ভরণ পোষণের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, যা ‘নানবার’ নামে পরিচিত।

৬) ইংরেজদের কাছ থেকে শুল্ক আদায়: মুর্শিদকুলি খানের বাংলায় আগমনের অনেক আগে থেকেই ইংরেজরা মোগল সম্রাটের ফরমান অনুসারে বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অধিকার ভোগ করছিল। ফলে সরকার আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল এবং দেশীয় বণিকরাও প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছিলো। ১৭১৩ খ্রিস্টাব্দে মুর্শিদকুলি ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ‘দস্তক’ বা ছাড়পত্র উঠিয়ে দিয়ে তাদের নিকট থেকে প্রচলিত হারে শুল্ক আদায়ের ব্যবস্থা করেন। ইংরেজরা অবশ্য প্রতিবাদ জানিয়ে সম্রাটের কাছ থেকে বাৎসরিক তিন হাজার টাকার বিনিময়ে বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার অধিকার পায়।

মুর্শিদকুলি খানের রাজস্ব ব্যবস্থার ফলাফল

মুর্শিদকুলি খানের রাজস্ব ব্যবস্থার উন্নতির ফলে বাংলার রাজস্বের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। নিম্নে এর ফলাফল আলোচনা করা হলো-

১) সরকারের আয় বৃদ্ধি: মুর্শিদকুলি খানের সংস্কারের ফলে রাজস্বের পরিমাণ বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। তার ‘মাল জামিনি’ ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে পূর্বেকার রাজস্ব ঘাটতি দূর হয়ে বার্ষিক ১ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা উদ্বৃত্ত থাকে। যা থেকে তিনি ১ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা সম্রাটকে পাঠাতেন। তাঁর প্রবর্তিত রাজস্ব নীতির জন্য সরকারের আয় সুনির্দিষ্ট হয়, যার ফলে পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিষয়ে সরকারের পক্ষে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী গ্রহণ করা সহজ হয়।

২) ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নতি: অতিরিক্ত শুল্ক বন্ধ করে দিয়ে মুর্শিদকুলি বণিকদের নির্বিঘ্নে মালামাল আনা নেওয়ার জন্য দেশে আইন প্রতিষ্ঠা করেন। যার ফলে ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়।

৩) কৃষির উন্নতি: মুর্শিদকুলি খানের রাজস্ব সংস্কারের ফলে জমিদার, ইজারাদার ও মোগল কর্মচারীদের হাত থেকে দরিদ্র কৃষকরা রক্ষা পায়। কৃষকদের দুরবস্থার কথা বিবেচনা করে ঋণদানের ব্যবস্থা করেন। ফলে কৃষির যথেষ্ট উন্নতি হয়।

৪) নতুন জমিদার শ্রেণীর উদ্ভব: মুর্শিদকুলির মাল জামিনি ব্যবস্থার ফলে অনেক পুরাতন জমিদার বিশেষতঃ মুসলমান পরিবার জমিদারি হারায়। কেননা সে সময় মুসলমানদের রাজস্ব বাকি পড়ত এবং তাদের কর্মচারীরাও অনেকসময় রাজস্বের টাকা আত্মসাৎ করত। এছাড়া ইজারাদারদের প্রতিপত্তি ও নিজেদের আর্থিক দৈন্যের কারণে অন্যান্য জমিদাররাও কিছুদিনের মধ্যে অস্তিত্ববিহীন হয়ে পড়ে। ইজারাদাররা পর্যায়ক্রমে ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা বংশগত করে নেয় এবং পরে জমিদারে পরিণত হয়ে রাজা-মহারাজা উপাধি গ্রহণ করে।

সমালোচনা

মুর্শিদকুলি খানের রাজস্ব সংস্কার ব্যবস্থা যথেষ্ট সমালোচিতও হয়েছে। সমসাময়িক ইতিহাস লেখক সলিমুল্লাহর মতে, মুর্শিদকুলি রাজস্ব আদায় ও হিসাব রাখার ব্যাপারে খুবিই কড়াকড়ি করতেন। যদি রাজস্ব বাকি পড়ত, তাহলে জমিদার, আমিল, কানুনগো, মুৎসুদ্দিকে দীউয়ান খানায় আটকে রাখা হত। টাকার জন্য বোর্ড জামিন হলে তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হত।প্রকৃতপক্ষে তার বিরুদ্ধে এ অভিযোগের কোন ভিত্তি ছিল না। এ ধরনের কঠোর বর্বরোচিত শাস্তি দেওয়া হলে কোন জমিদার, ইজারাদার ও আমীল রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব নিতে সম্মত হত না, এবং সম্রাট আওরঙ্গজেবও তাঁকে পূর্ণ সমর্থন জানাত না। 

উপসংহার

পরিশেষে বলা যায় যে, মুর্শিদকুলি খানের রাজস্ব ব্যবস্থা বাংলাকে আর্থিকভাবে সমৃদ্ধশালী একটি জনপদে পরিণত করে। দূর্নীতি পরায়ণ সরকারি কর্মচারী দমন করে আইনের কঠোর অনুশাসনে তিনি রাজস্ব ব্যবস্থাকে নিরাপদ করেন, যার জন্য সরকার ও প্রজা সাধারণ ব্যাপকভাবে উপকৃত হয। তাঁর রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার নীতি ছিল রাষ্ট্র ও জনসাধারণের স্বার্থের পরিপূরক। তাঁর উদ্যোগে বাংলার সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পেয়েছিল বলেই পরবর্তী সুবাদার সুজাউদ্দীনের আমলে দ্রব্যমূল হ্রাস পায় এবং জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়। 

Related Posts