সকল দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অল্প বিস্তর চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী এর অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। ভারতীয় উপমহাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য সকল দেশে এ ধরণের চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর অস্তিত্ব দেখা যায়। দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলো কখনো সমান তালে বিকাশ লাভ রকতে পারে নাই। যার ফলশ্রুতিতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বারবার বাধার সৃষ্টি হয়েছে। এ পর্যায়ে আলোচনা করব চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর অসম বিকাশ দেশ দুটোর অর্থনৈতিক উন্নয়নকে কিভাবে ব্যহত করেছে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলো বিভিন্নভাবে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। ফলে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নে তেমন ভূমিকা পালন করতে পারেনি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ক্যারিশমেটিক নেতৃত্বের মাধ্যমে সমাজকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে চেয়েছিলেন এবং বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক সংগঠনের উপর প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করা হয়েছিল। ফলে চাপসৃষ্টিকারী অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলো দূর্বল হয়ে পড়তে থাকে। শেখ মুজিব একদলীয় শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে সকল সংগঠনগুলো বিশেষ করে- ব্যবসায়িক সংগঠন ও অর্থনৈতিক সংগঠনগুলোকে সরকার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। এর পিছনে উদ্দেশ্য ছিল দেশকে একটি কর্পোরেট রাষ্ট্রে পরিণত করা। কিন্তু তাঁর এই চেষ্টা সফল হতে পারেনি কারণ এতে করে সমাজের প্রতিটি সেক্টর এককভাবে শোষিত হতে থাকে। এতে করে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী সক্রিয়ভাবে ভূমিকা পালন করতে পারে নি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যহত হয়। পরবর্তীতে জিয়া ও এরশাদের সামরিক-আমলাতান্ত্রিক সরকারের সময় বাংলাদেশ তার পূর্বপুরুষের ধারা বা চরিত্র থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। অর্থাৎ রাষ্ট্রপ্রধান এবং আমলাতন্ত্র সবসময় চেয়েছে এ সব গোষ্ঠীর উত্থানকে দমিয়ে রাখতে। সরকার সবসময় ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ের উপর আইনগত নিয়ন্ত্রণ পরিধি আরোপ করতে চেয়েছিল। এইসব নিয়ন্ত্রণ পরিধি আরোপের ফলে বিভিন্ন ধরণের সংগঠনের গতিশীলতা হ্রাস পায়। বাংলাদেশ সরকারের নীতি নির্ধারকেরা নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে একক কর্তৃত্ব প্রয়োগ করে। বিভিন্ন সময় সামাজিক অখন্ডতা, পৃষ্ঠপোষকতা ভিত্তিক সংস্কৃতি, ব্যক্তিকেন্দ্রিক নেতৃত্ব, অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে যার ফলে বিভিন্ন সময়ে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক সরকারগুলো ক্ষমতায় এসে তারাও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলোকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যায়। ফলে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলো তাদের দাবি আদায়ের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে সরকারকে চাপ দিতে ব্যর্থ হয়, যেটা দেশের অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এতে করে ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যহত হয়।
পাকিস্তানের চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন
পাকিস্তানের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, পূর্ব থেকে পাকিস্তানে সামরিক শাসন বলবৎ ছিল। পাকিস্তানের সামরিক আমলাতান্ত্রিক সরকার তাদের সুশীল সমাজ থেকে পৃথক ছিল এবং এই সুশীল সমাজ পাকিস্তানের সরকারের নীতি-নির্ধারণে খুবই কম প্রভাব বিস্তার করত কারণ তারা পুরোপুরি সরকারের উপর নির্ভরশীল ছিল। তৎকালীন সামরিক শাসক আইয়ুব খান চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলোকে আয়ত্তে রাখার জন্য একটি নিয়ন্ত্রণ কাঠামো তৈরি করেন। তার এই আইন কাঠামো অনুসারে শুধুমাত্র সরকার কর্তৃক অনুমোদিত সংগঠনগুলোই চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারতো।
চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর অসম বিকাশের আরও কতকগুলো কারণ দেখা যায়, যেমন- গোষ্ঠীগত দ্বন্ধ, দূর্বল সংগঠন ইত্যাদি। সংগঠনের নিম্নমুখী গতিশীলতার কারণে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলো সরকারের ইতিবাচন নীতি প্রণয়ন ও সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরকারের উপর কার্যকর প্রভাব বিস্তার করতে পারে নি। এভাবে পাকিস্তানের সামরিক সরকার বহু আইনগত কাঠামোর মাধ্যমে বিভিন্ন ধরণের সামাজিক সংগঠনগুলোকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল। এর কারণ ছিল এসব চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী সরকারের বিভিন্ন কার্যাবলীর মধ্যে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে না পারে।
আরও পড়ুন: চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী কি? চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর ভূমিকা কি?
উপরোক্ত আলোচনার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর অসম বিকাশের দরুণ দেশ দুটির অর্থনৈতিক উন্নয়নকে কিভাবে ব্যহত করছে তা নিম্নে আলোচনা করা হল-
প্রথমত, শিল্পায়ন ও নগরায়নের নিম্নমান এবং বিশাল সামাজিক অখন্ডতা বাংলাদেশ পাকিস্তান উভয় দেশেই পর্যাপ্ত দলীয় সাংগঠনিক গতিশীলতা হ্রাস করেছে। যেখানে শক্তিশালী চাপসৃষ্টিকারী দল গঠিত হওয়ার পরিবর্তে দূর্বল দল গঠিত হয়েছিল। যদিও আমরা জানি ব্যবসায়িক সম্প্রদায় যেকোন দেশের অর্থনৈতিক নীতি-নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, কিন্তু এ দুটি দেশে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী গুলোকে সরকারের নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর মধ্যে রাখা হয়েছে। এতে করে দেখা গেছে, দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যহত হয়েছে। যদি এসকল চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারত তাহলে জনকল্যাণমুখী নীতি-প্রণয়ন করতে বাধ্য হত।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক ব্যবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, এখানে সামরিক সরকার, একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছে। এতে করে বিরোধী বিভিন্ন সংগঠন, প্রভাব বিস্তারকারী বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সরকার কর্তৃক কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। এছাড়াও স্বার্থবাদী বিভিন্ন দলের প্রতি সরকারের অবিশ্বাস কাজ করেছিল। চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলো বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী হওয়ায় তারা সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। যেখানে তাদের ইতিবাচক ভূমিকা পালন করার কথা, সেখানে তারা অনেক ক্ষেত্রে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। ফলশ্রুতিতে এ দুটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যহত হয়েছে।