বংস সাহিত্য একটি প্রাচীন সাহিত্য। এই সাহিত্যের বিস্তৃতি কেবলমাত্র বৌদ্ধধর্ম ও সংঘের ইতিহাস ও থের পরম্পরার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। রাজনৈতিক ইতিহাস, সামাজিক ভৌগলিক অবস্থার বিবরণ, গল্প, কাহিণী প্রভৃতি বিবিধ বিষয় এর অন্তর্ভূক্ত ছিল। পাক-ভারতীয় সংস্কৃতির দেশের মধ্যে সিংহল ও ব্রক্ষ্মদেশের নাম বেশ উল্লেখযোগ্য। যুগ যুগ ধরে এই দেশের পন্ডিত ভিক্ষুগণ, গৃহী ও শিক্ষিত জনসাধারণ পালি ভাষার চর্চা ও গবেষণা করেছে। সিংহলের পন্ডিত ভিক্ষুগণ শুধুর বৌদ্ধধর্ম ও দার্শনিক তত্ত্বের পর্যালোচনা ও ব্যাখ্যা করে ক্ষান্ত ছিলেন না। বৌদ্ধধর্ম ও সংঘের ইতিবৃত্ত রচনার দিকেও তাঁদের লক্ষ্য ছিল। প্রথম দিকে সিংহলের ভিক্ষুগণ কতকগুলি ইতিহাস আশ্রয়ী কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। এইগুলিই বংস সাহিত্য নামে পরিচিত।
বংস সাহিত্যের পরিচয়
বংশ শব্দের পালিরূপ “বংস”। পালি “বংস” শব্দের অর্থ ধারা, বংশক্রম, ইতিহাস ইত্যাদি বোঝায়। গৌতম বুদ্ধের বংশক্রম অর্থাৎ পূর্বাপূর্ব বুদ্ধগণের ধারা নিয়েই খুদ্দক নিকায়ের বুদ্ধবংস রচিত হয়েছে। সম্ভবত এটিই পরবর্তীকালে বংস সাহিত্য রচনার প্রেরণার উৎস। পালি বংস সাহিত্যের মধ্যে দীপবংস, মহবংস, থূপবংস, দাঠাবংস, হত্থবনগলবিহার-বংস, ছকেসাধাতু বংস, অনাগতবংস, গন্ধবংস, সাসনবংস প্রভৃতি গ্রন্থের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বংস সাহিত্যের ঐতিহাসিক গুরুত্ব
বংস সাহিত্যের ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। কোন কোন পন্ডিত মনে করেন এর ঐতিহাসিক গুরত্ব খুবই সামান্য। কারণ অধিকাংশ গ্রন্থেরই বিষয়বস্তু ধর্মীয় সাহিত্যের ইতিকথা। ইতিকথা যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন, স্বভাবতই অতিরঞ্জিত ও পুরনুক্তি দোষে দুষ্ট। কিন্তু আধুনিক চিন্তাশীল ও জ্ঞানান্বেষী ব্যক্তিরা এর মধ্য থেকে ঐতিহাসিক তথ্য খুঁজে পান। বংস সাহিত্য ধর্মীয় ভাব প্রবণতা ও পুনরুক্তি দোষে দুষ্ট হলেও এর ঘটনা সমাবেশ, কল্পনার ঐশ্বর্যে, অভিনবতায়, ভাবের প্রাচুর্যে এবং রচনার বৈচিত্র্যে অসাধারণ ও অপরূপ। অতএব, সত্য কল্পনার আবেগে ও ভাবের আতিশায্যে নিহিত হলেও বংস সাহিত্যের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। নিম্নে বংস সাহিত্যের ঐতিহাসিক গুরুত্বের আরও কয়েকটি বিবরণ দেয়া হলো-
১) ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়
অন্যান্য গল্প সাহিত্যের ন্যায় দীপবংস ও মহাবংসের ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহ অদ্ভূত কাহিনী ও রোমাঞ্চকর গল্প নিয়ে রচিত হলেও এর ঐতিহাসিক গুরুত্বকে অবহেলা করা যায় না। এর মধ্যে বহু দরকারি ও প্রয়োজনীয় ঐতিহাসিক উপকরণও লুকিয়ে আছে। বুদ্ধিমান লেখক ও বিচ্ক্ষণ সমালোচক মাত্রই এসব গল্প ও রোমাঞ্চকর কাহিনীর মধ্য হতে আসল সত্য উদ্ধার করে নিতে পারেন।
আরও পড়ুন: চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা কর
২) ভারতীয় উপমহাদেশের রাজন্যবর্গের ইতিহাস
মহাবংস ও দীপবংস গ্রন্থে প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশের রাজন্যবর্গের ইতিহাস পাওয়া যায়। গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িক রাজা যেমন বিম্বিসার, অজাতশত্রু, প্রসেনজিত প্রভৃতি রাজা ও তাদের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়। বংস সাহিত্যে রাজা বিম্বিসার হতে সম্রাট অশোক পর্যন্ত যে সমস্ত ভারতীয় রাজন্যবর্গের নামের তালিকা পাওয়া যায় তা ঐতিহাসিকভাবে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। নন্দ বংশের নয়জন রাজা, অশোকের পূর্ব পুরুষ চন্দ্রগুপ্ত, বিন্দুসার প্রভৃতি ঐতিহাসিক ব্যক্তির ইতিহাস পাওয়া যায় বংস সাহিত্যে। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের ২৪ বৎসরের রাজত্বকালের কথা জানা যায় এসব সাহিত্যে। বিম্বিসার ও অশোকের রাজত্বকালের নির্দিষ্ট সন তারিখ নিয়ে মতদ্বৈততা থাকলেও তেমন যে পার্থক্য নেই তা বুঝা যায়। এছাড়া চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের ব্রাক্ষ্মণ মন্ত্রী চাণক্যর কথাও জানা যায় দীপবংস ও মহাবংসে।
৩) সিংহলে বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস
ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস বাদেও সিংহলে বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস জানা যায় বংস সাহিত্য থেকে। বিজয় হতে দেবনমপিয় তিস্স পর্যন্ত সিংহলি রাজাদের নামের তালিকা নিয়ে কোনো রকম মতদ্বৈততা নেই। এছাড়া রাজা পান্ডুকাভয়ের যুদ্ধাভিযানের কথাও জানা যায় বংস সাহিত্য থেকে। এ কারণে বংস সাহিত্যকে সম্পূর্ণ ঐতিহাসিক গ্রন্থ রূপে গ্রহণ না করা হলেও একে ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের ভিত্তিমূল বলে ধরে নেওয়া হয়, যা ভারত ও সিংহলের ইতিহাস রচনায় অভূতপূর্ব অবদান রেখেছে।
৪) ভারতীয় ধর্মীয় ইতিহাস রচনা
সিংহল ও ভারতীয় ইতিহাস রচনার জন্য বংস সাহিত্যের ভূমিকা অনন্য সাধারণ। বংস সাহিত্যের মধ্যে এমন কতকগুলি সন, তারিখ ও ঘটনার উল্লেখ আছে যার উপর শুধুমাত্র ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস নয় দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসও জড়িত। মহাংবংসে উল্লেখ আছে, বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের ১২৮ বৎসর পরে অশোকের অভিষেক ক্রিয়া সম্পাদিত হয়। বংস সাহিত্যে উল্লেখিত সন, তারিখ ভারতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে জটিল প্রশ্নগুলো সমাধানেও সাহায্য করে।
৫) সংগীতির বিবরণের উল্লেখ
বংস সাহিত্যে তিনটি সংগীতির বিবরণের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রথম সংগীতির ব্যাপারে থেরবাদী ও মহাযানীদের মধ্যে কোন মতদ্বৈততা নেই। উভয় পক্ষই একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, বুদ্ধের পরিনির্বাণের অব্যবহিত পরে সপ্তপর্নী গুহায় মহাকাশ্যপের সভাপতিত্বে প্রথম সংগীতির অধিবেশন বসে। সংগীতির প্রধান কারণ, সময় ও ভিক্ষুর সংখ্যার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। দ্বিতীয় সংগীতির ব্যাপারেও উভয় পক্ষ প্রায় একরূপ মত পোষণ করেন। উভয় পক্ষই বলেন, রাজা কালাশোকের রাজত্বকালে বৈশালীতে দ্বিতীয় সংগীতির অধিবেশন বসে। উভয় পক্ষেই মহাসাঙ্গিকদের পৃথক সংগীতির বিষয়ে একমত। থেরবাদীদের মতে, রাজা ধর্মাশোকের রাজত্বকালে ২৪৭ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে পাটলিপুত্র নগরে তৃতীয় সংগীতি সংঘটিত হয়েছিল। এতে বিজ্ঞবাদীদের জয় হয়েছিল। মহাযানপন্থীরা এর অস্তিত্ব স্বীকার করে না। সম্ভবত তারা কালাশোক ও ধর্মাশোককে রাজা বলে ধরে নেয়াতে এই গরমিলের সৃষ্টি হয়। তবে বর্তমানে, অশোকের শিলালিপি আবিষ্কৃত হওয়ায় এর ঐতিহাসিকত্ব সম্পর্কে সমস্ত সন্দেহের অবসান হয়েছে।
উপসংহার
উপরোক্ত আলোচনা আলোকে বলা যায় যে, ধর্মীয় ভাব প্রবণতা ও পুনরুক্তি দোষে দুষ্ট হলেও এর ঘটনা সমাবেশ, কল্পনার ঐশ্বর্য, অভিনবতা, ভাবের প্রাচুর্য এবং রচনার বৈচিত্র্যে বংস সাহিত্য অসাধারণ। তাই ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে “বংস সাহিত্য” গ্রন্থটি বৌদ্ধধর্মের প্রচার ও প্রসারের ইতিহাস জানার জন্য একান্ত অপরিহার্য। এজন্যই গ্রন্থটি বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে এক অনবদ্য স্থান দখল করে আছে।