মানব সম্পদ পরিকল্পনা
প্রতিষ্ঠানের কাজের প্রকৃতি ও পরিমাণের ভিত্তিতে ভবিষ্যতে কি ধরনের যোগ্যতাসম্পন্ন কতসংখ্যক কর্মী কেন এবং কখন প্রয়োজন তা নির্ধারণকল্পে অগ্রিম পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণকে মানব সম্পদ পরিকল্পনা বলে। এটি সফল মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ মানব সম্পদের চাহিদা নিরূপণের লক্ষ্যে সুস্পষ্ট মানব সম্পদ পরিকল্পনা অপরিহার্য। সংগঠনের সামগ্রিক কৌশল প্রণয়ণের সাথে এটি সম্পর্কিত। মানব সম্পদ পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনাকে উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় কর্মীর সংখ্যায় রূপান্তর করে। এটি সঠিক কর্মীকে সঠিক সময়ে সঠিক কাজে নিয়োগ করতে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনাকে সহায়তা করে।
বিশেষজ্ঞরা মানব সম্পদ পরিকল্পনাকে নিম্নোক্তভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন-
Decenzo ও Robbins এর ভাষায়, Human resource planning is the process by which an organization ensure that it has the right number and kinds of people, at the right places, at the right time, capable of effectively and efficiently completing those tasks that will help the organization achieve its overall objectives. “অর্থাৎ, মানব সম্পদ পরিকল্পনা হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যা দ্বারা একটি প্রতিষ্ঠানে ফলপ্রসূ ও দক্ষতার সাথে কার্য-সম্পাদনে সমর্থ সঠিক ধরনের সঠিক সংখ্যক লোক সঠিক স্থানে ও সময়ে স্থাপনের নিশ্চয়তা প্রদান করে, যা প্রতিষ্ঠানকে সামগ্রিক উদ্দেশ্য অর্জনে সহায়তা করে।”
Bartol ও Martin এর ভাষায়, “Human resource planning is the process of determining future human resource needs relative to an organization’s strategic plan and devising the steps necessary to meet those needs.” অর্থাৎ, মানব সম্পদ পরিকল্পনা হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া, যা একটি প্রতিষ্ঠানের কৌশলিক পরিকল্পনার সাথে সংগতি রেখে ভবিষ্যৎ মানব সম্পদের চাহিদা নির্ধারণ করে এবং উক্ত চাহিদা পূরণের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের পথ নির্দেশ দেয়।”
অতএব বলা যায় যে, মানব সম্পদ পরিকল্পনা হচ্ছে একটি প্রক্রিয়া, যা প্রতিষ্ঠানের কাজের প্রকৃতি অনুযায়ী ভবিষ্যৎ মানব সম্পদের চাহিদার ভিত্তিতে সংখ্যা নির্ধারণ করে কর্মীকে সঠিক সময়ে সঠিক স্থানে কাজে লাগানোর অগ্রিম পরিকল্পনা গ্রহণ করে, যাতে তারা সর্বাধিক দক্ষতা ও কার্যকারিতার সঙ্গে কার্য সম্পাদনে সমর্থ হয়।
আরও পড়ুন: মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা কাকে বলে? মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব আলোচনা কর।
মানব সম্পদ পরিকল্পনার গুরুত্ব/প্রয়োজনীয়তা
প্রতিষ্ঠানের সফলতা অর্জনের সবচয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে মানব সম্পদ। প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখা এবং সুষ্ঠু কার্যক্রম পরিচালনায় এটি অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ। প্রতিষ্ঠানের সুষ্ঠু পরিচালনা ও লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্য মানব সম্পদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চাহিদা নিরূপণসহ সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় বিষয়ে অগ্রিম সিদ্ধান্ত গ্রহণর জন্য মানব সম্পদ পরিকল্পনা অত্যাবশ্যক। বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানব সম্পদ পরিকল্পনার গুরুত্ব ও প্রয়াজনীয়তা নিম্নে আলোচনা করা হলো-
১) মানব সম্পদের সরবরাহ
প্রতিষ্ঠানের কাজের প্রকৃতি অনুসারে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা, দক্ষতা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানব সম্পদের প্রয়োজন। এরুপ মানব সম্পদ সরবরাহে কার্যকর মানব সম্পদ পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ কর্মীর সংখ্যা নিরূপণ করে এর সরবরাহ নিশ্চিত করতে মানব সম্পদ পরিকল্পনার গুরুত্ব অপরিসীম।
২) মানব সম্পদের ভবিষ্যৎ চাহিদা নিরূপণ
প্রতিষ্ঠানে মানব সম্পদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চাহিদা নিরূপণের লক্ষ্যে কার্যকর মানব সম্পদ পরিকল্পনা অপরিহার্য। সুষ্ঠু মানব সম্পদ পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ প্রয়োজনীয় মানব সম্পদের রূপরেখা নির্ধারণ করে। প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ কর্মধারা বিশ্লেষণ করে কর্মী সংগ্রহের পন্থা নিরূপণ এবং বিভিন্ন বিভাগে প্রয়োজনীয় কর্মীর পরিমাণ নির্ধারণ করা এর আওতাভুক্ত।
৩) কার্য পরিচালনার সহায়ক
প্রতিষ্ঠানের কার্যাদির সুষ্ঠু পরিচালনা দক্ষ মানব সম্পদের উপর নির্ভরশীল। তাই দক্ষ মানব সম্পদ সংগ্রহ ও তাদের উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর মানব সম্পদ পরিকল্পনার গুরুত্ব অপরিসীম। একটি উত্তম মানব সম্পদ পরিকল্পনার মাধ্যমে সঠিক কর্মীকে বাছাইপূর্বক সঠিক কাজে ও সময়ে নিয়োগদান করে ফলপ্রসূতা ও দক্ষতার সাথে প্রতিষ্ঠানের কার্যাদি পরিচালনা সম্ভব।
৪) পরিবর্তনশীলতার সাথে সামঞ্জস্য বিধান
বিশ্বায়নের প্রভাবে প্রাতিষ্ঠানিক ও পারিপার্শ্বিক যে কোন অবস্থার পরিবর্তনের সাথে প্রতিষ্ঠানের মানব সম্পদকে খাপ-খাওয়ানোর উপযোগী করে তোলার উদ্দেশ্যে মানব সম্পদ পরিকল্পনার গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে।
৫) প্রযুক্তি ব্যবহার
আধুনিক উন্নত প্রযুক্তি ও কারিগরি জ্ঞানে প্রতিষ্ঠানের মানব শক্তিকে দক্ষ করে তোলার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও উন্নয়নসহ দক্ষ কর্মশক্তি সংগ্রহ করার জন্য কার্যকর মানব সম্পদ পরিকল্পনার গুরুত্ব অত্যধিক। এটি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সাথে উৎপাদনের নব নব কৌশলের সাথে মানব সম্পদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে সমন্বয় করে।
৬) মানব সম্পদের ক্ষেত্র চিহ্নতকরণ
প্রতিষ্ঠানের কোন কোন ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কর্মী অবস্থান করেছে অথবা কোন কোন ক্ষেত্রে কর্মীর স্বল্পতা রয়েছে তা নির্ধারণ করে সঠিক কর্মীর অবস্থা নির্ণয়ে মানব সম্পদ পরিকল্পনার গুরুত্ব অত্যধিক।
৭) কৌশলিক চাহিদার সমন্বয়
জনসংখ্যার বিস্ফোরণজনিত কারণে নতুন নতুন পণ্য ও সেবাকর্মাদির চাহিদা ও সরবরাহ অবিরাম গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরুপ অবস্থায় কৌশলিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে চাহিদার সমন্বয় ঘটানোর লক্ষ্যে মানব সম্পদ পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা আবশ্যক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কৌশলিক পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
৮) প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতার উন্নয়ন
পরিকল্পনা মোতবেক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় মানব সম্পদের সংগ্রহ, উন্নয়ন ও এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করে প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জন ও মুনাফা অর্জনের হার বৃদ্ধিকরণে কার্যকর মানব সম্পদ পরিকল্পনার গুরুত্ব অপরিসীম। এর দ্বারা প্রাতিষ্ঠানিক সার্বিক দক্ষতার উন্নয়ন ঘটিয়ে প্রতিষ্ঠানকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে উপনীত করে।
৯) শ্রম ঘূর্ণায়মানতা ও অনুপস্থিতির হার হ্রাস
প্রতিষ্ঠানে মানব সম্পদের কার্যসন্তুষ্টি আনয়ন ও মনোবল উন্নত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে শ্রম ঘূর্ণায়মানতার হার হ্রাসে এবং কার্যে অনুপস্থিতির হার কমিয়ে আনতে ফলপ্রসূ মানব সম্পদ পরিকল্পনার ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ।
১০) সাংগঠনিক কাঠামোর উন্নয়ন
মানব সম্পদ পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক কাঠামোর গঠন ও উন্নয়নে সহায়তা করে। প্রতিষ্ঠানের সংগৃহীত মানব সম্পদের দক্ষতার ও যোগ্যতার ভিত্তিতে কাঠামো গঠন ও উন্নয়ন করা হয়। এটি প্রতিষ্ঠানের মানব সম্পদ বিভাগের কার্যাবলির নকশা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
১১) অপচয় নিরসন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি
মানব সম্পদ পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠানে মানব সম্পদের দক্ষতা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করে। এর ফলে উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকার অপচয় নিরসন করা সম্ভব হয় এবং কার্যক্ষেত্রে কর্মীর উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। ফলে অধিক মুনাফা অর্জন সম্ভব হয়।
১২) মানব সম্পদ সম্পর্কিত ব্যয় হ্রাসকরণ
মানব সম্পদ পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানে যথাসময়ে মানব সম্পদের যথাযথ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করে এ সম্পর্কিত বাড়তি ব্যয় কমানো সম্ভব। তদুপরি মানব সম্পদের কার্যদক্ষতা ও কার্যকারিতা এবং সফলতা প্রতিষ্ঠানের এতদসংক্রান্ত ব্যয় সংকোচনের সহায়ক। এরূপ ব্যয় সংকোচন প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতাকে সুনিশ্চিত করতে সাহায্য করে।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটিই প্রতীয়মান হয় যে, প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনের পথকে সুগম করে প্রাতিষ্ঠানিক সাফল্যকে সুনিশ্চিত করার জন্য উত্তম মানব সম্পদ পরিকল্পনার প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন অপরিহার্য।