Home » নব লোক ব্যবস্থাপনা (New Public Management)

নব লোক ব্যবস্থাপনা (New Public Management)

by TRI

নব লোক ব্যবস্থাপনার উৎপত্তি

লোকপ্রশাসনে আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগমালার উপর দাঁড়িয়ে আছে নব লোক ব্যবস্থাপনা এর ভিত্তি। সনাতনী আমলাতন্ত্রের জটিল পদসোপান, নিয়মতান্ত্রিক কাঠামো এবং উপর-নিচ পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া প্রভৃতি ক্রমশঃ আমলাতন্ত্রকে সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা থেকে অনেক দূরে ঠেলে দেয়।

আশির দশক থেকে বিগত দুই দশক ধরে সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, কর্মী এবং লোকপ্রশাসন চিন্তাবিদদের মধ্যে একটি উপলব্ধি হচ্ছিল যে, সরকারি আমলাতন্ত্রের দূর্বলতা অনেক। শিল্পোন্নত ইউরোপ ও আমেরিকা হতে শুরু করে পরবর্তীতে আফ্রিকা, এশিয়া এবং ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে দেখা যায় যে, আমলাতান্ত্রিক প্রাধান্য সবসময় লোকপ্রশাসনের সমস্যাবলীর সমাধান করতে পারে না বরং অনেক ক্ষেত্রে অনেক সমস্যার উৎস হিসেবে প্রতীয়মান হয়। এছাড়াও জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের বিকাশের সাথে সাথে, রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রের কার্যপরিধিও অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমলাতন্ত্রের ‘আত্ম কেন্দ্রিকতা’ ও বাজেট সংশ্লিষ্ট সমস্যাবলী সৃষ্টির কারণে, প্রশাসনে দক্ষতা, মিতব্যয়িতা ও কার্যকারিতা আনয়নের লক্ষ্যে আশির দশকে বিভিন্ন কমনওয়েলথ ও OECD রাষ্ট্রসমূহে নব লোক ব্যবস্থাপনার উদ্ভব ঘটে। অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, নিউজিল্যান্ড প্রভৃতি দেশসমূহ নব লোক ব্যবস্থাপনা সংস্কার কর্মসূচী গ্রহণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। নব লোক ব্যবস্থাপনার বিশ্লেষণী ভিত্তি ও যৌক্তিক কাঠামোর উৎপত্তি আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু এটির বাস্তবিক প্রয়োগ তার চেয়েও বেশি দেখা গেছে যুক্তরাজ্য, নিউজিল্যাণ্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে।

আরজ আলী সমীপে : আরিফ আজাদ - Aroj Ali Somipe : Arif Azad

TK. 300 TK. 210 You Save TK. 90 (30%)

 

 

মূলত: সনাতনী লোকপ্রশাসের কতকগুলি সমস্যা থেকেই নব লোক ব্যবস্থাপনার উৎপত্তি। এ ধরণের কতগুলো সমস্যার কথা উঠে এসেছে, “New Public Management: Lean State, Lean Government” শিরোনামে একটি সম্মেলনে যোগ দিতে আসা ১৭ টি দেশের ২২ জন অংশগ্রহণকারীর বক্তব্য থেকে। তাদের বক্তব্য থেকে সনাতনী লোকপ্রশাসনের যে সকল সমস্যাবলী বেরিয়ে এসেছে তা হলো:

  • লোকপ্রশাসনের সেবা খুবই ধীর গতির এবং ব্যয়বহুল;
  • সরকারি সেবার মান খুবই নিম্নমানের;
  • জনগণের পছন্দ বা ইচ্ছা অনুযায়ী সেবাসমূহকে শ্রেণীবিভাগ করতে লোকপ্রশাসন অক্ষম;
  • সরকারি প্রশাসন দূর্নীতিতে নিমজ্জিত; এবং
  • সরকারি প্রশাসন অদক্ষ ও অকার্যকর এবং এটি অর্থ ও মানব সম্পদের অপচয় করছে।

উপরোক্ত সমস্যাবলীর সমাধানে উন্নত দেশসমূহে নব লোক ব্যবস্থাপনার উদ্ভব হয়েছে। ১৯৭৯ সালে যুক্তরাজ্যে মার্গারেট থ্যাচার সরকারের আমলে বেশ কিছু প্রশাসনিক সংস্কার কর্মসূচী হাতে নেয়া হয় যা “ব্যবস্থাপনাবাদ” নামে পরিচিত ছিল। পরে যুক্তরাষ্ট্র, নিউজিল্যাণ্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার মত দেশসমূহের বেসরকারিকরণ, সরকারি সেবার বাজার যাচাই, প্রশাসনে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ, বিকেন্দ্রীকরণ, গ্রাহক কেন্দ্রিক মনোনিবেশ ইত্যাদি কৌশল প্রয়োগ করা হয় সনাতনী লোকপ্রশাসনের সমস্যাবলী দূর করার জন্য। পরবর্তীতে এসব কৌশলগুলো “নব লোক ব্যবস্থাপনা” নামে ব্যাপকভাবে উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

নব লোক ব্যবস্থাপনা (New Public Management)

OECD (Organization for Economic Cooperation and Development)- এর সদস্য রাষ্ট্রসমূহের মত নব লোক ব্যবস্থাপনা সারা বিশ্বে একটি বহুল আলোচিত প্রশাসনিক সংস্কার কর্মসূচী। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, এটি একটি সার্বজনীন প্রশাসনিক সংস্কার কর্মসূচী। কিন্তু বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপটে এটির ধরণ বিভিন্ন রকমের। এমনকি লোকপ্রশাসন গবেষক সমাজেও নব লোক ব্যবস্থাপনা আসলে কি ধরণের প্যারাডাইম তা নিয়ে মতৈক্য রয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, এ কর্মসূচীর উপাদানসমূহ সম্পূর্ণ নতুন নয়। এজন্য অনেকে একে “নতুন বোতলে পুরনো মদ” হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। নব লোক ব্যবস্থাপনাকে প্রশাসন বিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন নামে অভিহিত করেছেন। যেমন, Managerialism (Christopher Hood, 1991); Market Based Public Administration (Lan Rosenblum, 1992) ইত্যাদি। প্রশাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, এটা হচ্ছে পাশ্চাত্যের উন্নত দেশসমূহের সরকারের সকল পর্যায়ে “3Es” অর্থাৎ Economy (ব্যয় সংকোচন), Efficiency (দক্ষতা) ও Effectiveness (কার্যকারিতা) নিশ্চিতকরণের জন্য এক দৃঢ় উদ্যোগ। এমনকি, জাতিসংঘ সচিবালয়ে ‘প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা’ বিভাগের নাম পরিবর্তন করে ‘ব্যবস্থাপনা বিভাগ’ রাখা হয়েছে এবং ‘কর্মচারী ব্যবস্থাপনা’ অফিস হয়েছে ‘মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা’ অফিস। নব লোক ব্যবস্থাপনার সাথে পরিচিত হওয়ার আগে আমরা পরিচিত ছিলাম নব লোকপ্রশাসনের সাথে। দু’টি বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার মধ্যে। সহজ কথায় বলতে গেলে, নব লোক ব্যবস্থাপনা হচ্ছে লোকপ্রশাসনের গতানুগতিক আমলাতান্ত্রিক কাঠামো ও কার্যবিধিতে পরিবর্তন এনে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সমূহের আদলে ব্যবস্থাপনা কৌশল প্রয়োগ করা। তবে এর সাথে আরো বেশ কয়েকটি উপাদান জড়িত। মূলত: সরকারি সেবার বাজারজাতকরণে বেসরকারি সেবা দাতাদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য লোকপ্রশাসনে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও স্ববিবেচনা ক্ষমতার প্রয়োগ এবং বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে গ্রাহক সন্তুষ্টি অর্জনের ক্ষেত্রে তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেয়ার প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত একটি প্রশাসনিক সংস্কার কর্মসূচীর নাম হচ্ছে “নব লোক ব্যবস্থাপনা”। গতানুগতিক লোকপ্রশাসনে কিন্তু উপরোক্ত কৌশলগুলো অনুপস্থিত। বেসরকারি প্রশাসন তথা ব্যবস্থাপনা শাস্ত্র থেকে এগুলোর উদ্ভব হয়েছে। মোট কথা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের সেবাসমূহ বাজারজাতকরণের কৌশলগুলো লোকপ্রশাসনে প্রয়োগ করা হচ্ছে নব লোক ব্যবস্থাপনা।

আবার নব লোক ব্যবস্থাপনাকে এভাবেও সংজ্ঞায়িত করা যায় যে, নব লোক ব্যবস্থাপনা হচ্ছে ব্যাপকভাবে কতকগুলো ধারণা ও পদ্ধতির সমষ্টি যাদের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে লোকপ্রশাসনে দক্ষতা ও জবাবদিহিতাকে একীভূত করা। মূলতঃ এক্ষেত্রে দক্ষতা নিশ্চিত করা হয় বিভিন্ন কর্তৃপক্ষকে প্রযুক্তিগত স্তরে বিকেন্দ্রীভূত করে। এতে করে ব্যাপকহারে সমাজের কাজে জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়। সত্যি কথা বলতে কি, “ধারণা ও পদ্ধতি” সমূহের কোন একীভূত সংজ্ঞা নেই। তবে ধারণা করা হয় যে, NPM ব্যাপকহারে জনগণের কাছে সেবা এবং সমাজের কাছে জবাবদিহিতা- এ দুই কাজের প্রতিনিধিত্ব করে।

বিভিন্ন প্রশাসনিক চিন্তাবিদদের আলোচনা থেকে নব লোক ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য উঠে আসলেও যে সকল মূল উপাদানের উপর ভিত্তি করে নব লোক ব্যবস্থাপনা আন্দোলন পরিচালিত, সেগুলো সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা নিম্নে দেওয়া হল:

ক)  সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহকে বেসরকারি পর্যায়ে ছেড়ে দেওয়া: প্রথম কথা হচ্ছে সরকারি সেবাদানকারী সকল প্রতিষ্ঠানকে ক্রমান্বয়ে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিতে হবে। এর ফলে একদিকে খরচ যেমন কমবে, তেমনি সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রেও স্বচ্ছতা ফিরে আসবে। উপরন্তু, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের সাথে প্রতিযোগিতার ফলে সরকারি সেবার মানও বৃদ্ধি পাবে।

খ) কেন্দ্রীভূত প্রশাসন হতে বের হয়ে আসতে হবে: নব লোক ব্যবস্থাপনার অন্যতম মূল বক্তব্য হচ্ছে, বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে সরকারি প্রশাসনকে যথসম্ভব জনগণের দোর গোঁড়ায় পৌঁছে দিতে হবে। এতে জনগণ সহজে সেবা পাবে। যে প্রশাসন অধিক কেন্দ্রীভূত, তা অদক্ষ ও দূর্নীতিযুক্ত। সুতরাং গতিশীল ও অংশগ্রহণমূলক প্রশাসনের জন্য লোকপ্রশাসনকে মাঠ পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে হবে।

গ) দক্ষতাই হবে মূল্যায়নের একমাত্র মাপকাঠি: নব লোক ব্যবস্থাপনায় কর্মীরা দক্ষতা ও কার্যকারিতার মাধ্যমে মূল্যায়িত হবে। প্রশাসনের লক্ষ্য নির্ধারিত থাকবে। সংশ্লিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম কর্মীরাই পুরস্কৃত হবেন। সংশ্লিষ্ট কর্মী সেবা প্রদানে কি ভূমিকা রাখছেন তাই হবে বিবেচ্য বিষয়।

ঘ) অতিরিক্ত জনবল হ্রাস ও স্থায়ী আমলাতন্ত্রের অবসান: নব লোক ব্যবস্থাপনা স্থায়ী আমলাতান্ত্রিক কাঠামোতে বিশ্বাস করে না। এ ধরনের সংস্কার কর্মসূচী প্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগকে উৎসাহিত করে। এটি প্রশাসনের জনবলকে যথসম্ভব ছোট রাখার উপদেশ দেয়।

ঙ) গ্রাহক সন্তুষ্টি: সরকারি সেবা বিতরণের ক্ষেত্রে এর গ্রাহক তথা সাধারণ জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও মতামতকে গুরুত্ব প্রদানের উপর জোর দেয় নব লোক ব্যবস্থাপনা।

চ) বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কৌশল গ্রহণ: নব লোক ব্যবস্থাপনা সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কৌশল প্রয়োগের উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করে।

ছ) ইনপুট অপেক্ষা আউটপুটের উপর গুরুত্বারোপ: নব লোক ব্যবস্থাপনায় ইনপুট ও সাংগঠনিক নিয়ম-কানুনের চাইতে আউটপুট তথা ফলাফলের উপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়।

জ) খরচ নিয়ন্ত্রণ ও বাজার পরীক্ষা: নব লোক ব্যবস্থাপনায় সরকারি সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে যথাসম্ভব খরচ কমানো এবং সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হয়। সরকারি সেবাকে সবসময় প্রতিযোগিতামূলক বাজারে যাচাই করতে হবে।

নব লোক ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠিত কোন তত্ত্ব নয়। Osamu Koike- এর মতে, এটি একটি “সালাদের বাটির” মতো যেখানে প্রশাসনিক সংস্কারের বিভিন্ন উপাদান একীভূত হয়েছে। নব লোক ব্যবস্থাপনার উপাদানগুলোকে দু’টি ভাগে ভাগ করা যায়। এই দু’ধরণের সংস্কার কর্মসূচী নব লোক ব্যবস্থাপনায় একীভূত হওয়াকে Christopher Hood, “A marriage of opposites” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। প্রথমে, নব লোক ব্যবস্থাপনা চেষ্টা করে সরকারি কাঠামোকে পরিবর্তন করতে। বিশেষ করে কেন্দ্রীভূত এবং পদসোপান ভিত্তিক আমলাতন্ত্রকে বিকেন্দ্রীভূত করে বিভিন্ন এককে পরিণত করা, যেগুলো হবে গ্রাহক কেন্দ্রিক। এক্ষেত্রে যে সকল কর্মসূচী অন্তর্ভূক্ত থাকবে সেগুলো হচ্ছে, বাজার পরীক্ষা, চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ, নীতি নির্ধারণী এককে পরিণত করা, সংস্থা সমূহের কার্য মূল্যায়ন করা ইত্যাদি। Koike এর মতে, এ ধরনের কৌশলগুলি আনা হয়েছে মূলত: “Neo Classical Economics” ও “New Institutional Economics” হতে।

পরবর্তীভাগের সংস্কার কর্মসূচীসমূহ সরকারি খাতের সাংগঠনিক পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত। এগুলো সনাতনী ওয়েবারিয়ান আমলাতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। এ ধরনের কর্মসূচীগুলো এসেছে আশির দশকের ব্যবসা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনা কাঠামো থেকে। কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে (TQM) টোটাল কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট, সরল রৈখিক সংগঠন, কর্মসূচী মূল্যায়ন, কর্মদক্ষতার ভিত্তিত পুরস্কারের ব্যবস্থা এবং এমবিও বা ম্যানেজমেন্ট বাই অবজেকটিভসৃ ইত্যাদি।

Related Posts