আমলাতন্ত্রের রাজনীতিকরণ:
রাজনীতিকরণ একটি বৈধ, সাংবিধানিক ও ধনাত্মক ধারণা। সরকার তার সকল কাজ ও নীতিমালা প্রণয়ন করে রাজনৈতিকভাবে; যেখানে কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য নয়। সরকার যে নীতি প্রণয়ন করে তা সকল নাগরিকের জন্য সমানভাবে বিবেচিত হয়। তেমনি প্রশাসনে রাজনীতিকরণ হয় কারণ প্রশাসন সরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় সরকারের সকল কাজের সাথে জড়িত থাকে।
হারুন-অর-রশিদ তার “রাজনীতি কোষ” গ্রন্থে বলেছেন, কোন ঘটনা বা প্রতিষ্ঠানকে রাজনীতি রুপ বা চরিত্র দান করাকে রাজনীতিকরণ বলা হয়।”
সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও সাংবিধানিক আইন দ্বারা যদি প্রশাসন তার স্ব স্ব কাজ করে যেতে পারে তাহলে সেই প্রশাসনে রাজনীতিকরণ হয়েছে বলা যায়। কেননা সরকারের নীতি প্রণয়নে সহায়তা ও বাস্তবায়ন করে প্রশাসন।
অর্থাৎ, যে আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক মন্ত্রী ও প্রশাসনিক আমলা একত্রে মিলিত হয়ে জনকল্যাণমূলক নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে, তাকেই আমলাতন্ত্রের রাজনীতিকরণ বলা হয়।
নিম্নে বাংলাদেশে আমলাতন্ত্রের রাজনীতিকরণের কারণ ও প্রভাব আলোচনা করা হল-
১) নীতি নির্ধারণ: বাংলাদেশে আমলাগণ সরকারি নীতি নির্ধারণের কাজে নিয়োজিত থাকেন। তারাই প্রশাসনের সকল প্রকার নীতি গ্রহণ করে থাকেন। মন্ত্রীগণ কেবল আমলাদের নীতিমালা ও সিদ্ধান্তসমূহে স্বাক্ষর করে থাকেন। সরকারি নীতিসমূহ অত্যন্ত জটিলতাপূর্ণ বিধায় সেগুলো সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে হলে কারিগরি জ্ঞানের একান্ত প্রয়োজন। আর আমলাগণই এক্ষত্রে প্রয়োজনীয় কারিগরি জ্ঞান ও দক্ষতার যোগান দিয়ে থাকেন।
২) আইন প্রণয়ন: বাংলাদেশে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও আমলাগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিল জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত করা হয় সেগুলোর অধিকাংশই প্রশাসনিক বিভাগ, সংস্থা ও সচিবালয়ে গৃহীত হয়ে থাকে।
৩) আইনসভাকে প্রভাবিতকরণ: বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি বিভাগ ও সংস্থা জাতীয় সংসদের কমিটির সদস্যদের প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সরবরাহ করে। অনেক সময় আমলাগণ তাদের নিজ নিজ বিভাগীয় বিষয়াদির ক্ষেত্রে উপদেশ প্রদানের জন্য জাতীয় সংসদের সভা কমিটিতে উপস্থিত থাকেন।
৪) সরকারের দৈনন্দিন কার্য পরিচালনা: আমলাতন্ত্র বাংলাদেশ সরকারের দৈনন্দিন কার্যাবলি পরিচালনা করে। এসব কাজের মধ্যে শিক্ষা, জনহিতকর কার্যাবলি, সামাজিক নিরাপত্তা, পুলিশ, বিচার ব্যবস্থা, কর, আইন-শৃঙ্খলা প্রভৃতি অন্তর্ভূক্ত।
৫) আইন ও নীতির বাস্তবায়ন: আমলাগণ কেবলমাত্র আইন ও নীতিসমূহ প্রণয়নই করেন না তারা এগুলো বাস্তবায়নও করে থাকেন। আসলে আইন ও নীতিসমূহ কার্যকর ও বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রেই আমলাদের প্রভাব অধিকমাত্রায় পরিলক্ষিত হয়। প্রয়োজনে তারা কোন আইনকে তাদের বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করে কার্যকর করে থাকেন।
আরও পড়ুন: সরকারি নীতি কি? সরকারি নীতি প্রণয়নে আমলাদের ভূমিকা।
৬) সরকার ও জনগণের মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী: বাংলাদেশে আমলাগণই সরকার ও জনগণের মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী হিসেবে কাজ করেন। সরকারি কর্মকান্ড সম্পর্কে তারা জনগণকে অবহিত করেন। জনগণও প্রয়োজনে আমলাদেরকে তাদের সমস্যা সম্পর্কে অবহিত করে এবং সেগুলোর সমাধান পেতে চায়।
৭) উন্নয়নমূলক কার্য: বাংলাদেশের বিভিন্নমুখী উন্নয়ন কর্মকান্ডের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন আমলাদের উপরই সর্বতোভাবে নির্ভরশীল। তারা বিভিন্ন প্রকার জাতিগঠনমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেন। সময়োপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নে আমলারা উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
৮) সামাজিক পরিবর্তন কার্যকরী করা: আমলাগণ বাংলাদেশের সামাজিক পরিবর্তন ত্বরান্বিত ও কার্যকর করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। বাংলাদেশের আমলাগণ দেশে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনকল্যাণ সাধন করতে আগ্রহী। আর গণতান্ত্রিক সরকারের সার্থকতা পরিবর্তনশীল সামাজিক চাহিদা উপলব্ধি করার উপর নির্ভর করে। এ কাজে আমলাগণই প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার যোগান দিয়ে থাকেন। এভাবে তারা আইন ও শাসন বিভাগের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করেন।
৯) প্রতিযোগীতামূলক স্বার্থের মূল্যায়ন: যেকোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে আমলাদেরকে অবশ্যই বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক স্বার্থের মূল্যায়ন কাজে নিয়োজিত হতে হয়। এ ক্ষেত্রে জনস্বার্থই হয়ে থাকে তাদের কর্ম ও সিদ্ধান্তের প্রকৃত ভিত্তি। কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থ নয়।
পরিশেষে একথা বলতে হয় যে, বাংলাদেশের ন্যায় উন্নয়নশীল দেশে আমলাদের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব এককথায় অনস্বীকার্য। এ দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এমনকি সামগ্রিক পরিবর্তনে আমলাগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাই বলা যায়, বাংলাদেশে আমলাতন্ত্র তার দায়িত্ব তথা সরকারি কার্যাবলি সম্পাদন করতে গিয়েই রাজনীতিকরণের শিকার।