কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের চিন্তাধারার মূল উপাদানগুলো মিশ্র এবং ভিন্নধর্মী (heterogenous)। তা সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা থেকে ক্যাথলিকদের রক্ষণশীলতা পর্যন্ত বিস্তৃত। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের চরিত্র হলো অর্থনৈতিক ও রাজনতিক আন্তঃশ্রেণীর সাথে আপোষহীনতা। প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক এরিষ্টটল থেকে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথ পর্যন্ত সবাই কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের কথা বলেছেন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে। সত্যিকার অর্থে, কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হলো আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার নামান্তর। এর ধারণাগুলো খুবই প্রাচীন হলেও মূলতঃ পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশসমূহে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই এ ধারণার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটে। এর ফলে দুটি লাভ হয়েছে।
এক, অপ্রতিরোধ্য এবং ব্যাপক অর্থনৈতিক বিস্ফোরণ।
দুই, শ্রেণীবৈষম্য ও শ্রেণীসংঘাতের বাড়ন্ত দূরত্বকে অনেকাংশে অর্থনৈতিককেন্দ্রিক, বিপণনকেন্দ্রিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক করা সম্ভব হয়েছে।
কল্যাণমূলক রাষ্ট্র কাকে বলে
কল্যাণমূলক রাষ্ট্র বলতে বুঝায় এমন এক রাষ্ট্রকে যা জনগণের সামগ্রিক কল্যাণে আত্মনিয়োগ করে। নিম্নে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের আরও বিভিন্ন ধরণের ধারণা ও সংজ্ঞা তুলে ধরা হল:
জাতিসংঘের এক ঘোষণা অনুসারে, “কোন রাষ্ট্রকে তখনই কল্যণমূলক রাষ্ট্র বলা যেতে পারে যখন রাষ্ট্র প্রতিটি নাগরিককে খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে এবং বেকারত্ব, অসুস্থতা, বৈধব্য অথবা অন্য কোন কারণে জীবিকার্জনের অক্ষমতায় সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করে।”
অর্থনীতিবিদ Pigou কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক দিকের উপর প্রাধান্য দিয়ে বলেন, “I shall speak of the welfare state as one that endeavors to promote the economic satisfaction of its citizens.”
অর্থনীতিবিদ Pound এর মতে, “যে রাষ্ট্র শান্তি শৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তামূলক কাজে নিজেকে আবদ্ধ না রেখে তার কর্মতৎপরতার আওতায় মানবকল্যাণের সকল ক্ষেত্রকেই অন্তর্ভূক্ত করে এবং তার প্রশাসনিক প্রয়াস দ্বারা অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাসমূহ দূর করার চেষ্টা করে তাকেই সেবামূলক বা কল্যাণমূলক রাষ্ট্র বলে।”
অতএব, কল্যাণমূলক রাষ্ট্র বলতে বুঝায়, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ন্যায় (সোভিয়েত ইউনিয়ন) সুবিধাসমূহ যেমন- চিকিৎসা, শিক্ষা, বাসস্থান ইত্যাদি বিনামূল্যে নাগরিকদের সরবরাহ করা। এককথায়, রাষ্ট্রের জনগণের সামাজিক, আর্থিক, রাজনৈতিক কল্যাণের জন্য করণীয় সবকিছু যে রাষ্ট্র করে বা করার চেষ্টা করে তাকে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র বলে।
কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ইতিহাস
কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণা খুবই প্রাচীন। বিসমার্ক কিছু কল্যাণমূলক কাজ বা পদক্ষেপের মাধ্যমে জার্মানীতে প্রথম এ ব্যবস্থা চালু করেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক এরিষ্টটল এবং আধুনিক অর্থশাস্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা এডামি স্মিথের লেখায় কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি রয়েছে। এডাম স্মিথ থেকে জন স্টুয়ার্ট মিলস পর্যন্ত ক্ল্যাসিক্যাল অর্থনীতির প্রতিষ্ঠাতাগণ ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে উনবিংশ শতাব্দীর শিল্প বিকাশের প্রভার পর্যবেক্ষণ করে অবাধ অর্থনীতির কঠোর ধারণা যথেষ্ট পরিবর্তন সাধন করেন। বিশেষ করে জন স্টুয়ার্ট মিলস এবং জেরেমী বেন্থাম শেষ পর্যন্ত এমন এক সামাজিক ও রাজনৈতিক দর্শন সৃষ্টি করেন যাকে বিংশ শতাব্দীর কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সমতুল্য বলা যেতে পারে।
অবাধ অর্থনীতি এবং পাশ্চাত্যের ক্ল্যাসিক্যাল উদারনৈতিকতাবাদ হতে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের জন্য আন্দোলনের পশ্চাতে যেসকল শক্তি বা কারণ কাজ করেছে সেগুলো প্রধানত অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক।
১৯৩০ এর দশকে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা এবং সাধারণ মানুষের জীবনে যে আর্থিক বিপর্যয় দেখা যায় তা থেকে পরিত্রাণের আকাঙ্ক্ষা কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের আবির্ভাবকে ত্বরান্বিত করে। এই মন্দা ও বিপর্যয় উত্তোরণের কর্মসূচী হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট ১৯৩৩ সালে ‘new noal’ নামক কর্মসূচী গ্রহণ করেন। অপরদিকে অনুরূপ আর্থিক বিপর্যয়ের উত্তোরণের লক্ষ্যে ১৯৪২ সালে ইংল্যান্ডের “বিভারিজ রিপোর্ট” বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মূলত এর মাধ্যমেই কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও অর্থব্যবস্থার একটি প্রক্রিয়া।
বিংশ শতাব্দীয় দ্বিতীয় দশক থেকে রাষ্ট্রের কার্যসীমা সম্পর্কে জনগণের মনোভাবের এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। যাতে বলা হয়, রাষ্ট্র শুধু প্রতিরোধ করবে না, এটি জনকল্যাণমূলক কাজও করবে। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের প্রথম সূচনা হয় বিসমার্কের জার্মানীতে। পরবর্তীতে ইংল্যান্ড ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান রাষ্ট্রগুলোতেও এটি ছড়িয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন: ক্রিটিক্যাল মডেলের বৈশিষ্ট্যসমূহ এবং লোকপ্রশাসনের সঙ্গে এর প্রাসঙ্গিকতা
কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য সমূহ
১) কল্যাণমূলক কাজ: জনসাধারণের জন্য বিভিন্ন ধরণের কল্যাণমূলক কাজ করা, কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান কাজ। তাই যে রাষ্ট্র এ ধরণের কাজ বেশি করবে, সে রাষ্ট্র তত বেশি কল্যাণমূলক। যেমন- শিক্ষব্যবস্থাকে গণমুখী করা, শিক্ষা ব্যয় হ্রাস করা, দরিদ্র জনগণের নিকট শিক্ষাকে সহজলভ্য করা, শিক্ষাব্যবস্থাকে জীবনের উপযোগী করা।
২) প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা: ব্যক্তির কল্যাণার্থে রাষ্ট্র জনগণের, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। এটি প্রণিধানযোগ্য যে, এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের একমাত্র মানদন্ড হলো জনগণের কল্যাণ।
৩) অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ: জনকল্যাণের স্বার্থে রাষ্ট্র অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করে। জীবনের প্রয়োজন মেটানোর জন্য দরিদ্র ও দুস্থদের জন্য মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করে একই উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র বেকারদের জন্য বেকার ভাতা, কর্মহীনদের কর্মসংস্থান না হওয়া পর্যন্ত সাহায্যদান, দরিদ্রদের জন্য স্বাস্থ্যবীমা, প্রবীণ ও বৃদ্ধ নাগরিকদের সংস্থান, দুর্ঘটনাকবলিতদের জন্য ভাতা, গৃহহীনদের জন্য সর্বনিম্নমানের বাসস্থানের ব্যবস্থা করে। এই লক্ষ্যে অর্থ আদায়ের জন্য সমাজের বিত্তবানদের ওপর করারোপ, শিল্প বাণিজ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং ক্ষুদ্র শিল্প মালিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে।
৪) সরকারি মালিকানার প্রসারণ: এ ধরণের রাষ্ট্রে ব্যক্তি মালিকানা নিয়ন্ত্রিত হয়। সরকারি মালিকানা প্রসারিত ও জাতীয়করণ নীতি গৃহীত হয়। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের অর্থনীতি মূলত মিশ্র চরিত্রের। বিনিয়োগের সীমারেখা না থাকলেও আয়ের ক্ষেত্রে সীমারেখা থাকে।
৫) আত্মপ্রত্যয় ও আত্মবিশ্বাসের প্রতি গুরুত্বারোপ: কল্যাণমূলক রাষ্ট্র জনগণের আত্মবিশ্বাস ও আত্মপ্রত্যয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করে। এই উদ্দেশ্যে শিল্পকলা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশে রাষ্ট্র মনোযোগী হয় এবং গণমনে নতুন চেতনা সৃষ্টির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয় সর্বাধিক।
৬) লক্ষ্য নির্ধারণ: কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে নাগরিকদের পূর্ণ কর্মসংস্থানকে লক্ষ্য হিসেবে ধরা হয় এবং জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের মৌলিক চাহিদা মেটানোর প্রচেষ্টা গৃহীত হয়। শ্রেণীস্বার্থের পরিবর্তে এধরণের রাষ্ট্রে গণস্বার্থ প্রাধান্য লাভ করে।
৭) সুযোগের সমতা: কল্যাণকর রাষ্ট্রে কারো একচেটিয়া সুযোগ থাকে না। সকলে যাতে সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারে এর জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থা করে।
৮) সুবিধাজনক অবস্থান: এ ধরণের রাষ্ট্র পুঁজিবাদী এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মাঝামাঝিতে অবস্থান করে। জনগণ যেন অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে শোষিত না হয়, তার জন্য এ দু’য়ের মাঝামাঝি অবস্থান বাঞ্চনীয়।
৯) উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ভাবধারা: টি. এইচ. মার্শালের মতে, কল্যাণকর রাষ্ট্র সর্বহারা শ্রেনীর একনায়নকতন্ত্র যেমন নয়, তেমনি এটি ধনীক শ্রেণীর অবসানের জন্যও নয়। উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ভাবধারার প্রতি এটি অধিক বিশ্বাসী। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠা, প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, নিরপেক্ষ আদালত স্থাপন এসবের প্রতি এটি বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করে।
এক নজরে কল্যণমূলক রাষ্ট্র
- মৌলিক ও মানবাধিকার সংরক্ষণ করা
- মিশ্র অর্থব্যবস্থা
- সামাজিক ন্যায়বিচার
- সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা
- মৌলিক চাহিদা পূরণ
- অশিক্ষা, দরিদ্র ও বেকার সমস্যা দূরীকরণ
- রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অধিকার সংরক্ষণ করা
- আয়ের বৈষম্য দূরীকরণ ও সম্পদের সুষ্ঠু বন্টন করে
- মৌলিক চাহিদা নিশ্চিতকরণ
- একচেটিয়া বাণিজ্যরোধ
কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের কার্যাবলী
কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের অসংখ্য ও বহুমুখী কার্যাবলীর পূর্ণ তালিকা দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ জনগণের সার্বিক কল্যাণের জন্য এমন কোন কাজ নেই যা এ ধরণের রাষ্ট্র করে না। নিম্নে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের কার্যাবলীর প্রধান কার্যসমূহ তুলে ধরা হলো-
১) আইন রক্ষণাবেক্ষণ ও কর সংগ্রহ
জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের প্রধান ২টি কাজ হলো- ক) আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং খ) কর সংগ্রহ করা। রাষ্ট্র এক্ষেত্র পুলিশ বা অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় দেশে বিদ্যমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ও আইনশৃঙ্খলা জনিত সমস্যা মোকাবেলার মাধ্যমে সমাজের স্থিতিশীলতা বজায় রাখে। পাশাপাশি কর হলো সরকারের রাজস্ব খাতে আয়ের প্রধান উৎস। তাছাড়া মূল্যস্ফীতি কমাতে কর সংগ্রহ একটি হাতিয়ার। অতএব সরকারের ব্যয়ভার বহন ও অর্থনৈতিক মন্দা দূরীকরণে রাষ্ট্র জনগণের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কর সংগ্রহ করে থাকে।
২) জাগতিক কল্যাণ বা বৈষয়িক উন্নতি
মানুষের বৈষয়িক উন্নতি আনয়নে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র দায়িত্বশীলতার সাথে কাজ করে যায়। মানুষের বস্তুগত উন্নয়ন, যেমন- মাসলোর চাহিদা সোপানের নিম্নস্তরের চাহিদা- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদির উন্নয়নে রাষ্ট্র দায়িত্বশীলতার পরিচয় বহন করবে। আর কল্যাণমূলক রাষ্ট্র এক্ষেত্রে সফলতার সাথে বৈষয়িক উন্নয়নে মনোনিবেশ করতে পারে।
৩) জনস্বাস্থ্য, কল্যাণ ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা
জনস্বাস্থ্য রক্ষা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও কল্যাণে এটি দায়িত্ব গ্রহণ করে। জনগণের স্বাস্থ্যের মানোন্নয়ন, দুঃস্থ দরিদ্রদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করবে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র। অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ বলতে বুঝানো যায়- দেশের অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনয়ন, অর্থনৈদিত মন্দাভাব রোধ, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের গতিশীলতা বৃদ্ধি এবং রাষ্ট্রের কল্যাণে অর্থনীতির চাকা সচল রাখা ইত্যাদি।
৪) অশিক্ষা, দারিদ্র্য ও বেকার সমস্যা দূরীকরণ
অশিক্ষা দূরীকরণ, দারিদ্র্য ও বেকার সমস্যা দূরীকরণে এটি পদক্ষেপ নেয়। অশিক্ষা, দারিদ্র্য ও বেকার সমস্যা যে কোন দেশের প্রধান সমস্যা। অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে এগুলো নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই প্রতিটি কল্যাণমূলক ধারণার রাষ্ট্রের উচিত অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মাঝে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আর দারিদ্র্য দূরীকরণে সম্পদের সুষ্ঠু বন্টনের নীতি গ্রহণ ও অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে এবং বেকারত্বের অভিশাপ থেকে যুব সমাজকে রক্ষা করতে হবে। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যুবগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করতে মিল-কারখানা, ব্যাংক বীমা ইত্যাদি সৃষ্টি করে যুবকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৫) সকলের অধিকার রক্ষা করা
জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রই মূলত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের মৌলিক অধিকার, ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার, বাক স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, নারী-পুরুষ সমতা,সুষ্ঠুভাবে বেঁচে থাকার অধিকার, কর্মে অংশগ্রহণের অধিকার, বিচার পাওয়ার অধিকার ইত্যাদি বিষয়গুলো জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেয়। আর জনগনের এসকল অধিকার কেবল রাষ্ট্রই প্রদান করতে পারে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
৬) বৃহত্তর স্বার্থে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য কার্যাবলী পরিচালনা
সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে রাষ্ট্র জনগণের অর্থনৈতিক ও অন্যান্য কার্যাবলী পরিচালনা করে। এক্ষেত্রে জাতীয় আয় ও অর্থনৈতিক উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে জীবন ধারণের মান নিশ্চিত করা জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। মানুষের আয় বৈষম্য দূরীকরণ ও সম্পদের সুষম বন্টন ও এক্ষেত্রে বিবেচনায় আসতে পারে।
তাছাড়া জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র নিম্নোক্ত কার্যাবলী সম্পাদন করে থাকে-
মানুষের জীবন ধারণের পূর্ণ নিরাপত্তা বিধানের জন্য কল্যাণমূলক রাষ্ট্র পূর্ণসামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে।
একচেটিয়া ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ করা, শ্রম ও জনগণকে পুঁজিবাদী শোষণ ও নির্যাতনের কবল থেকে রক্ষা করা, শিল্পে অবাঞ্চিত ও অপচয়মূলক প্রতিযোগিতা বন্ধ করা, শ্রমিকের ন্যায়সঙ্গতমজুরী প্রদান, পঙ্গুঁ, অসহায় ও অনাথদের পুনর্বাসন করা ইত্যাদি সব জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের অন্তর্ভূক্ত।
গণতান্ত্রিক ধারণার সম্প্রসারণ থেকে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের উৎপত্তি। কাজেই কল্যাণমূলক রাষ্ট্র জনগণের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার, স্বাধীনতা ও সুযোগ-সুবিধার শাসনতান্ত্রিক নিশ্চয়তা গ্রহণ করে থাকে। কারণ মৌলিক অধিকার ভোগের নিশ্চয়তা ব্যতিত জনগণ আত্মপ্রকাশের সুযোগ ও পরিবেশ পায় না।
বিনোদন: কল্যাণমূলক রাষ্ট জনগণের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এজন্য রাষ্ট্র এর কর্মাচারিদের প্রচুর অবসর দান করে এবং চিত্ত বিনোদনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
উৎপাদন-উপকরণ নিয়ন্ত্রণ: দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদনের উপকরণসমূহ রাষ্ট্র এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে যেন ব্যক্তিমালিকানায় উৎপাদন একচেটিয়া কারবোরের সৃষ্টি করতে না পারে। এবং রাষ্ট্র এক্ষেত্রে সরকারি মালিকানা প্রতিষ্ঠার উপর জোর দেয়।
বহিঃশত্রুর হাত থেকে রাষ্ট্রকে রক্ষা করা: এটিও জনকল্যাণমূক রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক দৃঢ় করার মাধ্যমে, নৌ-সেনা ও বিমান বাহিনীর সৃদৃঢ়করণ ও জাতীয় শক্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে।
ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষা করা: ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষা করা জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের অন্যতম কার্য বলে বিবেচিত । ব্যক্তি যাতে স্বীয় সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত না হয় তার জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এজন্য রাষ্ট্র সামগ্রিক স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে কোন কোন সংস্থা ও ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করে।