বাংলাদেশে বর্তমান সংবিধানে সংসদীয় বা মন্ত্রীপরিষদ শাসিত সরকার প্রতিষ্ঠিত। জাতীয় সংসদ কর্তৃক নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান নামমাত্র শাসক প্রধান। প্রকৃত শাসন ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রীসভার হাতে। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থার মধ্যমণি এবং মন্ত্রীসভার মুখ্য ব্যক্তিত্ব। তিনি সরকার প্রধান এবং নির্বাহী ক্ষমতার মধ্যমণি। তাঁকে কন্দ্র করেই বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থা পরিচালত হয়। প্রধানমন্ত্রীই নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারি। সংবিধানের ৫৫ অনুচ্ছেদের (২) দফায় বলা হয়েছে যে, “প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বা তাঁহার কর্তৃত্বে এই সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হইবে। আজকের লেখায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কার্যাবলি তুলে ধরা হলো।
প্রধানমন্ত্রীর নিয়োগ পদ্ধতি
সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফায় বলা হয়েছে, “যে সংসদ সদস্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন বলিয়া রাষ্ট্রপতির নিকট প্রতীয়মান হইবেন, রাষ্ট্রপতি তাঁহাকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করিবেন।”
তবে এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। কেননা সংসদীয় রীতি অনুযায়ী সাধারণ নির্বাচনের পর জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ‘সংসদীয় নেতা’-কেই রাষ্ট্রপতি সংসদের আস্থাভাজন সদস্য বলে মনে করবেন। তবে যদি কোন দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয় তখন সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন ব্যক্তি খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি তাঁর সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন।
প্রধানমন্ত্রীর পদের মেয়াদ
সংবিধানে ৫৭ অনুচ্ছেদের (১) দফায় প্রধানমন্ত্রীর পদের মেয়াদ দেয়া আছে।
প্রধানমন্ত্রীর পদ শূণ্য হইবে যদি-
(ক) তিনি কোন সময়ে রাষ্ট্রপতির নিকট পদত্যাগপত্র প্রদান করেন, অথবা
(খ) তিনি সংসদ সদস্য না থাকেন।
৫৭ অনুচ্ছেদের (২) দফায় বলা হয়েছে, সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারালে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করবেন কিংবা সংসদ ভেঙে দিবার জন্য লিখিতভাবে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শদান করবেন। এবং তিনি অনুরুট পরামর্শদান করলে রাষ্ট্রপতি, অন্য কোন সংসদ সদস্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন হন এই মর্মে সন্তুষ্ঠ হলে, সংসদ ভেঙে দিবেন।
৫৭ অনচ্ছেদের (৩) দফায় আরও বলা হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই অযোগ্য করবে না।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কার্যাবলী
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী হলেন সরকার প্রধান। তিনি সমগ্র শাসন ব্যবস্থার মধ্যমণি। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কার্যাবলি নিম্নরূপ:
মন্ত্রীসভা গঠনে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা
সংবিধানের ৫৬ নং অনুচ্ছেদের (২) দফা অনুসারে, “প্রধানমন্ত্রী, অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদিগকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দান করিবেন।” তত্ত্বগতভাবে রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীসভার সদস্যদের নিয়োগ করতে পারলেও এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকাই মুখ্য। কার্যত প্রধানমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রীসভার সদস্যদের যে তালিকা রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করবেন তাঁরাই মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হবেন। সংবিধানের ৫৬ নং অনুচ্ছেদের (২) দফায় আরও বলা হয়েছে যে, তাঁদের সংখ্যার অন্যুন নয়-দশমাংশ সংসদ সদস্যগণের মধ্য হতে নিযুক্ত হবেন এবং অনধিক এক-দশমাংশ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবার যোগ্য ব্যক্তিগণের মধ্য হতে মনোনীত হতে পারবেন।
জাতীয় সংসদের নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী
জাতীয় সংসদের নেতা হলেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর পরামর্শ অনুসারে রাষ্ট্রপতি সংসদ অধিবেশন আহ্বান ও স্থগিত করেন। জাতীয় সংসদের বিতর্কে মন্ত্রীসভার সদস্যদেরকে তিনি সাহায্য করবেন।
জাতীয় সংসদের পবিত্রতা, শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা রক্ষার বিষয়ে তিনি স্পীকারকে সাহায্য ও সহযোগিতা করবেন। সংসদে হুইপদের সাহায্যে তিনি নিজ দলীয় সদস্যদের প্রয়োজনীয় আদেশ, নির্দেশ প্রদান করেন এবং তাঁদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করবেন।
রাষ্ট্রপতির পরামর্শদাতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রীসভার মধ্যে সংযোগ রক্ষা করবেন। মন্ত্রীসভার বক্তব্য রাষ্ট্রপতির নিকট উপস্থাপিত করা এবং প্রয়োজনবোধে সে সম্পর্কে ব্যাখ্যা প্রদান করার দায়িত্ব তাঁর উপরেই অর্পিত। এছাড়া রাষ্ট্রপতির বক্তব্য তিনি মন্ত্রীসভায় উপস্থাপন করবেন।
সংবিধানের ৪৮ নং অনুচ্ছেদের (৫) দফায় বলা হয়েছে, “প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় ও পররাষ্ট্রীয় নীতি সংক্রান্ত বিষয়াদি সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে অবহিত রাখবেন এবং রাষ্ট্রপতি অনুরোধ করলে যে কোন বিষয় মন্ত্রীসভায় বিবেচনার জন্য পেশ করবেন।
প্রধানমন্ত্রীর নিয়োগ সংক্রান্ত ক্ষমতা
তত্ত্বগতভাবে রাষ্ট্রপতি উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারি, বিচারক, রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করতে পারলেও কার্যত তিনি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমেই নিয়োগ সংক্রান্ত কার্যাবলি সম্পাদন করবেন।
সংসদীয় কমিটি গঠন
সংসদীয় সরকারে বিভিন্ন স্থায়ী কমিটির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসব কমিটির ভূমিকা যথাযথভাবে পালিত হওয়া না হওয়ার উপর সরকারের সফলতা ও ব্যর্থতা নির্ভর কর। প্রধানমন্ত্রী এইসব কমিটিতে তার দলীয় সংসদ সদস্যদের মনোনীত করেন।
প্রধান নির্বাহী কর্তা
দেশের সকল নির্বাহী ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির নামে চালিত হয়। কিন্তু এর বাস্তব প্রয়োগের কর্তৃত্ব প্রধানমন্ত্রীর হাতে। প্রধানমন্ত্রী নিজ মন্ত্রীপরিষদের মাধ্যমে অথবা সরকারি কর্মচারীদের মাধ্যমে তা প্রয়োগ করেন।
সুতরাং বলা যায়, প্রধানমন্ত্রী শুধু সংসদের নেতা, মন্ত্রীসভার মধ্যমণি, দলের নেতা, রাষ্ট্রপতির পরামর্শ দাতাই নন, তিনি হলেন জাতির নেতা ও পথপ্রদর্শক। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হবার পর দলীয় ক্ষুদ্র গন্ডী অতিক্রম করে তাঁকে জাতীয় নেতার বৃহত্তর ভাবমূর্তি ধারণ ও অর্জন করতে হয়। তিনি জাতীয় নিরাপত্তা ও জাতীয় সংহতির প্রতীক। প্রধানমন্ত্রীকে কেন্দ্র করে মন্ত্রীসভা কার্য পরিচালনা করে এবং তার পতন ঘটলে তাঁকে কেন্দ্র করেই ঘটে।