ভূমিকা:
আচার্য্য শান্তিদেব রচিত বোধিচর্যাবতার মানবতার সাধনা বিষয়ে অপূর্ব গ্রন্থ। এটি এতই প্রসিদ্ধ লাভ করেছে যে, নবম-একাদশ শতাব্দীর মধ্যে এই গ্রন্থের চীনা, তিব্বতী ও মঙ্গোলীয় ভাষায় অনুবাদ হয়। আধুনিককালে ইংরেজী, ফরাসি প্রভৃতি ভাষায় এটার একাধিক অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। যে সাধক ক্ষুদ্র স্বার্থপূর্ণ জীবনযাত্রা পরিত্যাগ করে বোধিচিত্ত পরিগ্রহ মানবতার দীক্ষা গ্রহণ করেন, আচার্য্য শান্তিদেবের বোধিচর্যাবতার গ্রন্থে তার মহিমা বর্ণনা করা হয়েছে। এটি একটি ত্রিপিটক বহির্ভূত মূল্যবান গ্রন্থ।
বৌদ্ধ শাস্ত্রে উক্ত হয়েছে যে, বোধি বা বুদ্ধত্ব লাভের নিমিত্তে প্রথমে বোধিচিত্ত উৎপাদন করতে হবে। সর্ব জগতের সর্ব প্রাণীর দুঃখ মোচন করার জন্য বুদ্ধ সংকল্পবদ্ধ থাকেন। সেই সংকল্প সাধনের জন্য যে প্রাণপণ প্রয়াস বোধিচিত্ত বলতে তাই বোঝায়। আচার্য শান্তিদেবের মতে- জগতের আদি বুদ্ধগণ কল্পান্তরের চিন্তা ও সাধনার দ্বারা এই বোধিচিত্তকে কল্যাণ পথ বলে গ্রহণ করেছেন। যারা জগতে শত দুঃখ হতে মুক্ত হতে চায় তাদের জন্য বোধিচিত্ত।
আচার্য শান্তিদেব বোধিচিত্তকে দুই ভাগে বিভাজন করেছেন। যেমন-
ক) বোধিপ্রণিধান চিত্ত, এবং খ) বোধি প্রস্থান চিত্ত।
বোধিচিত্ত উৎপত্তিতে স্বীয় চেতনায় একাগ্রতা সৃষ্টি করে এবং এর মাধ্যমে চিত্তাচার ও কায়োচারে যে যে ধর্মনীতি নিষ্ঠ সম্পন্ন স্বভাবের উদ্ভব হয় তাই বোধি প্রণিধান চিত্ত। আর বোধি প্রণিধান চিত্ত সবল ও সচল হলে চিত্তে যে বোধিময় বা প্রজ্ঞাশীল নৈতিক কর্ম চৈতন্যের স্থিতিশীল অবস্থার উদ্ভব হয় তাৈই বোধিপ্রস্থান চিত্ত।
আরও পড়তে পারেন: চার্বাক দর্শন কাকে বলে? চার্বাক দর্শনের জ্ঞানতত্ত্ব আলোচনা কর।
আচার্য শান্তিদেবের মতে- মানুষ সাধারণত ব্যক্তিগত স্বর্থ চিন্তায় মগ্ন। নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য অপরকে পীড়া দিতে সে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হয় না। স্বীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে পরার্থে আত্মদানের যে সংকল্প ও প্রয়াস এটাই মানবতার সাধনা। এই সাধনায় যে ব্যক্তি যতদূর অগ্রসর হতে পারে সে ততটা মনুষ্য পদবাচ্য স্বার্থপূর্ণ ক্ষুদ্রজীবনের চিন্তা পরিত্যাগ করে সর্বজীবের দুঃখ নিবারণের জন্য বৃত্তের জীবন-যাপনের সংকল্প গ্রহণ করতে পারে। বৌদ্ধশাস্ত্রে এটা “বোধিচিত্ত পরিগ্রহ” নামে অভিহিত করা হয়েছে। বোধিচিত্ত পরিগ্রহে আচার্য শান্তিদেবের অনুভূতি বিশ্লেষণ করা হল-১. বহুকাল নরক দুঃখ ভোগ করার পর অবকাশ লাভকে এবং সমস্ত প্রাণীর শুভকর্ম সম্পাদনকে আমি আনন্দের সাথে অনুমোদন করছি। দুঃখিত প্রাণীগণ সুখী হোক।২. দেহধারীর সংসার দুঃখ হতে মুক্তিলাভকে আমি অনুমোদন করছি। সৎপুরষগণের বোধিসত্ত্ব ও বুদ্ধত্ব প্রাপ্তিতে আমার পরমানন্দ বোধ হচ্ছে।৩. সর্বজীবের সুখবাহী এবং সর্বপ্রাণীর হিত-সাধনকারী শাসক বোধিসত্ত্বগণের অগাধ সমুদ্র তুল্য মহান চিত্তোৎপাদনকে অনুমোদন করছি।৪. সর্বদিকে বিদ্যমান বুদ্ধমান বুদ্ধগণের নিকট কৃতঞ্জলি ফুটে প্রার্থনা করছি যে, যারা মোহধ্বংসে দুঃখ প্রপাতে পতিত, তাদের জন্য ধর্ম প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করুন।৫. পরিনির্বাণগামী বুদ্ধগণের নিকট আমি কৃতঞ্জলি ফুটে প্রার্থনা করছি যে, তারা যেন অনন্তকাল পর্যন্ত জগতে অবস্থান কনের এবং জগত যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন না হয়।৬. এইরুপে সমস্ত কর্ম সম্পাদন করে আমি যে পূণ্য উপার্জন করলাম, তা দ্বারা সমস্ত প্রাণীর সর্ব দুঃখ উপশমিত হোক।৭. অন্ন-পানীয় বর্ষণ দ্বারা ক্ষুধা পিপাসার ব্যথা যেন মিটাতে পারি এবং কল্পান্তরে দুর্ভিক্ষের সময় আমি যেন জনগণের পানভোজনের কারণ হই।
৮. ব্যধি উপশম না হওয়া পর্যন্ত আমি যেন রোগীদের ঔষধ হই, আমি যেন বৈদ্য হই এবং আমি যেন সেবক হই।
৯. দরিদ্র প্রাণীগণের জন্য আমি যেন অক্ষয় ধন ভান্ডার হই এবং নানা প্রকার ব্যবহার্য উপকরণ রুপে যেন আমি তাদের সম্মুখে উপস্থিত থাকি।
১০. আমার দেহ, ভোগ সম্পদ এবং অতীত অনাগত বর্তমান সর্বকালের শুভ কর্মের ফল আমি জীব-জগতের স্বার্থসিদ্ধির জন্য নিঃস্বার্থ নিরাসক্ত ভাবে উৎসর্গ করছি।
১১. সর্ব ত্যাগই নির্বাণ। আমি নির্বাণ প্রার্থী। অতএব আমার যখন সমস্ত ত্যাগ করা প্রয়োজন সমস্ত প্রাণিগণকে দান করা শ্রেয়।
১২. সর্বদেহধারী জীবের যাতে সকল সুখের উদ্রেক হয় তজ্জন্য আমার এই দেহ আমি উৎসর্গ করলাম। তারা ইচ্ছে করলে এই দেহ হত্যা করতে, নিন্দা করতে কিংবা এতে ধূলি নিক্ষেপ করতে পারে।
১৩. ক্রীড়া, হাস্য, বিলাস ইত্যাদি যা সুখী যা তাদের সুখকর তাই করুক; সমাপ্তি এই কার্যের চিন্তায় আমার আর কি প্রয়োজন।
১৪. যারা আমাকে মিথ্যা নিন্দায় নিন্দিত করবে, যারা আমার অপকার করবে, যারা আমাকে উপহাস করবে তারা এবং অন্যান্য সকলেই যেন সম্বোধি লাভে সক্ষম হয়।
১৫. আমি অনাথের নাথ, পথিকগণের পথ-প্রদর্শক পরপারে গমনকারী নৌকা, সেতু, ভেলা, দীপান্বেষীর দীপ, শয্যাভিলাষীর শয্যা হতে পারি।
১৬. যে যে কার্য দ্বারা তাদের সুখ লাভ হয়, আমার এই সমর্পিত কায় দ্বারা সেই কার্য করে নিও। আমাকে উপলক্ষ করে যেন কখনো কারো অনর্থ না ঘটে।
১৭. যেমন অতীত বুদ্ধগণ বোধিচিত্ত গ্রহণ করেছিলেন তারা যেরুপভাবে বোধিসত্ত্বগণের শিক্ষা ক্রমশঃ পালন করেছিলেন তেমনি জগত কল্যাণের জন্য আমি বোধিচিত্ত গ্রহণ পূর্বক সেইরুপভাবেই যথাক্রমে শিক্ষার অনুশীলন করতে পারি।
১৮. আমার জন্ম আজ সফল হয়েছে। মানুষ্য কূলে জন্মলাভ সার্থক হয়েছে। বুদ্ধবংশ আমি আজ জন্ম পরিগ্রজ করলাম, আজ হতে আমি বুদ্ধ পুত্র।
১৯. অন্ধ যেভাবে আবর্জনা স্তুপ হতে রত্নলাভ করে সেভাবে কোনো রকমে আমার মধ্যে এই বোধিচিত্ত উদিত হয়েছে।
২০. এই বোধিচিত্ত এক রসায়ন বিশেষ, জগতের মৃত্যুরোধের জন্য এর উৎপত্তি। সমগ্র জাতকের দরিদ্রতা মোচনের জন্য এটা অক্ষয় নিধি।
২১. ভবমার্গের যাত্রী সর্বতোভাবে ত্রাতাগণের সম্মুখে সমগ্র প্রাণি জগতকে আজ আমি আমন্ত্রণ করছি। সুর, অসুর প্রভৃতি সকলেই এর অভিনন্দন করুক।