Home » গান্ধার শিল্পের সংক্ষিপ্ত ধারণা দাও। বৌদ্ধ শিল্পকলার ইতিহাসে এর গুরুত্ব মূল্যায়ণ কর।

গান্ধার শিল্পের সংক্ষিপ্ত ধারণা দাও। বৌদ্ধ শিল্পকলার ইতিহাসে এর গুরুত্ব মূল্যায়ণ কর।

by TRI
প্রারম্ভিকা:

কুষাণযুগ ভারত শিল্পে সুবর্ণ যুগের প্রস্তুতির যুগ। এ যুগে ভারতীয় শিল্পীরা স্থাপত্য ও ভাস্কর্য নির্মাণে গ্রীকদের অনুকরণ করতে শুরু করে। ভারত শিল্পের ইতিহাসে এই যুগটি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূ্র্ণ। কারণ এই সময়ে ভারতীয় শিল্পধারার সঙ্গে বহিরাগত শিল্পধারার একটি ঘনিষ্ট সংযোগ স্থাপিত হয়েছিল। স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শিল্পে বহুমুখী পরীক্ষা-নিরীক্ষার যুগও এটি। আর এ সময়েই ভারতশিল্প তার নিজস্বরুপ ও ভাব প্রকাশের সহজ ও স্বাভাবিক পথের সন্ধান লাভ করে। ফলে চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে জগতে অতুলনীয় গুপ্ত শিল্প ধারা তার সমস্ত মহিমা ও গেীরব নিয়ে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়ে ওঠে।

গান্ধার শিল্প:

মৌর্য সাম্রাজ্যের পরবর্তীকাল থেকেই বর্তমান আফগানিস্তানের ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে গ্রীক নরপতিদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য স্থাপিত হয়। এর পূর্ব হতেই গ্রীক দেশবাসীরা উত্তর ভারতের নানা অংশে ‘যবন’ নামে পরিচিত ছিলেন। এসব গ্রীক রাজ্যেদের মধ্যে রাজা মিনান্ডার বা মিলিন্দ ছিলেন বিশেষ খ্যাতিমান। তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষু স্থবির নাগসেনের সাথে প্রশ্নোত্তরে সন্তোষ্ট হয়ে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে একেবারে ভারতীয় রাজায় পরিণত হন। এভাবে গ্রীকদের রাজ্য স্থাপন ও ভারতীয়দের সঙ্গে একত্রে বসবাসের ফলে গ্রীক শিল্পধারা ক্রমশঃ এদেশে প্রচলিত হতে থাকে। এই ধারার সঙ্গে ভারতীয় শিল্প পদ্ধতি মিশে এক অভিনব শিল্পকলার সৃষ্টি হয়। এই শিল্পশৈলী গান্ধার শিল্প নামে পরিচিত।

আরও পড়ুন:  গান্ধার শিল্পরীতি ও তার বৈশিষ্ট্য
গ্রীক গান্ধার শিল্প বিকাশের ক্ষেত্র:

উত্তর-পশ্চিম ভারতে পুরুষপুর, পুস্কলাবতী, কপিশা, তক্ষশিলা, প্রভৃতি নগর ও তার নিকটবর্তী আফগানিস্তানের মধ্য ও পূর্বাঞ্চলের ভাস্কর্য, স্থাপত্য ও কারুশিল্প – যা ‘গান্ধার শিল্প’ নামে পরিচিত।

বৌদ্ধ শিল্পকলার ইতিহাসে গান্ধার শিল্পের গুরুত্ব:

গান্ধার শিল্প ধারায় রচিত শিল্পবস্তুগুলি পূর্ব আফগানিস্তান ও পশ্চিম পাঞ্জাবেই বিশেষ করে পাওয়া গেছে। গান্ধার শিল্প ভারতীয় শিল্পক্ষেসত্রে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। এ সম্বন্ধে আমাদের দেশে পরস্পর বিরোধী দুটি মত প্রচলিত। একদল মনে করেন এতে আমাদের প্রভূত কল্যাণ সাধিত হয়েছে।  আর এক দলের মত সম্পূর্ণ বিপরীত। তবে ভারতীয় তথা বৌদ্ধ শিল্পকলায় গান্ধার গ্রীক শিল্প এক বিশেষ গুরুত্ব দখল করে আছে। নিম্নে বৌদ্ধ শিল্পকলার ইতিহাসে গ্রীক গান্ধার শিল্পের গুরুত্ব মূল্যায়ণ করা হল-

বৌদ্ধ শিল্পকে অলংকরণ:

আলংকারিক ধারাতে শিল্প সৃষ্টি করা হল ভারতের বৈশিষ্ট্য। জগতে যা কিছু দেখা যায়, ভারত কখনই তার হুবহু অনুকরণ করে শিল্প সৃষ্টি করেনি। রুপের সঙ্গে রুপের সাদৃশ্য সৃষ্টি করা তার লক্ষ্য নয়, উপলক্ষ্য মাত্র। ভিতরের ভাবকে প্রকাশ করতে গিয়ে বাইরের রুপকে সে করেছে কাল্পনিক বা আলংকারিক। এজন্যই অনেক ক্ষেত্রে শিল্প সৃষ্টিগুলি এ জগতে কেউ না হয়ে ভাব জগতের অধিবাসী হয়ে দেখা দিয়েছে।  আর বৌদ্ধ শিল্পকে অলংকরণে গান্ধার শিল্পের বড় অবদান এখানেই।

বুদ্ধ মূর্তিকে মহামানবে মণ্ডিতকরণ:

ভারতীয় শিল্পীরা বুদ্ধদেবের যে ধ্যান মূর্তি রচনা করেছেন, তা ভাবে, লাবণ্যে ও গাম্ভির্য্যে অতুলনীয় হয়ে ফুটে উঠেছে। সেখানে বুদ্ধদেবের ধ্যান স্তিমিত লোচন আকর্ণ বিস্তৃত, কান দুটি প্রায় কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে। মাথার চুলগুলো মালার মত সাজানো এবং দেহের প্রতিটি অঙ্গ অতিমানবের শ্রীতে মণ্ডি হয়ে মহান হয়ে উঠেছে।

শিল্পে পার্থিব সৌন্দর্য সৃষ্টকরণ:

গ্রীক শিল্পীরা পার্থিব সৌন্দর্যকেই তাদের শিল্পরচনার মূল উপাদান হিসেবে গ্রহণ করে, দৈহিক সৌন্দর্য ও পেলবতা কতখানি উন্নত হতে পারে তার পরিচয় ‍দিয়েছে পূর্ণমাত্রায়। কাজেই তাঁদের সঙ্গে যখন ভারতের শিল্পীদের যোগসূত্র তৈরি হল তখন দু’টি পৃথক ভাবধারাও একত্রে মিশল। গ্রীকরা নিয়ে এলেন পার্থিব সৌন্দর্যকে শিল্পে ফুটিরয় তোলার পদ্ধতি আর ভারতীয় শিল্পীরা তার সঙ্গে দেখালেন কিভাবে ভিতরের ভাবকেও শিল্পে প্রকাশ করা যায়।

আরও পড়তে পারেন:  রাজা মিলিন্দ কে ছিলেন? তার জীবন সম্পর্কে সম্যক ধারণা দাও।
বৌদ্ধ গুপ্ত শিল্পকে মহিমান্বিত করণ:

একটু বিচার করলেই দেখা যাবে যদি গান্ধার শিল্পের সাথে আমাদের যোগাযোগ না হত, তবে মহিমান্বিত গুপ্ত শিল্পধারা এতখানি লাবণ্যে, ভাবে ও গাম্ভির্য্যে পরিপূর্ণ হয়ে দেখা দিত না। এর পরবর্তীকালে অর্থাৎ কুষাণযুগের শেষভাগের ও গুপ্ত যুগের ভারতীয় শিল্পীরা গ্রীক রোমক প্রভৃতি শিল্পধারাকে সম্পূর্ণ আত্মসাৎ করে আদর্শবাদী শিল্পরীতিকেই প্রাধান্য দিয়ে জয়যাত্রার পথে অগ্রসর হয়েছেন।

দেশীয় শিল্পধারাকে প্রভাবিতকরণ:

গ্রীক রাজাদের রাজত্বকালের শেষভাগে মধ্য এশিয়ার শক জাতি ভারতে প্রবেশ করে। ইহাদেরই কুষাণ শাখার রাজারা খৃষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে যুদ্ধ বিগ্রহহীন বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপনে সফলকাম হয়। কুষাণ বংশের তৃতীয় রাজা মহারাজ কণিষ্কের আমলে কুষাণ সাম্রাজ্য পূর্বভারতে মগধ হতে মধ্য এশিয়ার খোরাসান প্রদেশ ও উত্তরে খোটান হতে দক্ষিণে খোঙ্কণ উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বিখ্যাত বৌদ্ধ মণীষী অশ্বঘোষ, নাগার্জুন ও বসুমিত্র কণিষ্কের রাজসভা অলংকৃত করতেন। কণিষ্ক মৌর্য সম্রাট অশোকের পদাঙ্ক অনুসরণ করে নিজ সাম্রাজ্যের মধ্যে বৌদ্ধধর্ম ও ভারতীয় ভাবধারার প্রচার ও প্রসার করেন। বুদ্ধদেবের দেহাবশেষের উপর কণিষ্ক পেশোয়ারে একটি বিশাল স্তুপ নির্মাণ করেন। এই স্তুপের অপূর্ব গঠন ও শিল্প নৈপুণ্য দেখত দেশ বিদেশ হতে জন সমাগম হত। এই সময়ে উত্তর পশ্চিম দিকে ভারতীয় পুরাণকথা ও বৌদ্ধধর্মে অনুপ্রাণিত মানুষেরা প্রথমে আলেকজান্ডারেরর পরবর্তীকালের গ্রীক শিল্পধারা ও অপেক্ষাকৃত পরবর্তীযুগের রোমক শিল্পধারা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল।

গান্ধার শিল্পীরা প্রথম বুদ্ধমূর্তির সৃষ্টা:

বেদে দেব-দেবী ধ্যান-রুপের কথঅ আছে সত্য। কিন্তু তাঁদের কোন মূর্তি আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। যে কয়টি দেবমূর্তি পাওয়া গেঝে তা বৈদিক যুগের বহু পূর্বে সিন্ধু সভ্যতার আমলের। বুদ্ধদেবের পরিনির্বাণের পর বহুদিন পর্যন্ত তাঁর কোন মূর্তি রচিত হয়নি। ভারহুত, বুদ্ধগয়া ও সাঁচীতে রাজকুমার সিদ্ধার্থের বুদ্ধত্ব লাভের পূর্বের ঘটনা, জাতকের কাহিণী, বোধিদ্রুম পূজা, পদচিহ্ন পূজার বহুচিত্র ও মূর্তি আছে বটে কিন্তু ধ্যানময় প্রশান্ত বুদ্ধমূর্তির সৃষ্টি তখনো হয়নি। এই বুদ্ধমূর্তির উৎপত্তির ব্যাপারেও পণ্ডিতদের মধ্যে ব্যাপক মতদ্বৈততা বর্তমান। কারো কারো মতে গান্ধার শিল্পেই সর্বপ্রথম বুদ্ধদেবের কাল্পনিক মূর্তি রচিত হয়। এ হিসাবে গান্ধার শিল্পীরাই হলেন বুদ্ধমূর্তির প্রথম সৃষ্টা।

গান্ধার শিল্পে মূর্তি নির্মাণে গ্রীক বৈশিষ্ট্য:

গান্ধার শিল্পে গ্রীক শিল্পীরা যেসব বুদ্ধমূর্তি গঠন করেছিলেন, সেগুলি তাঁদের গ্রীক দেবতার আদর্শে রচিত হওয়ায় অনেকটা গ্রীক ভাবাপন্ন হয়ে উঠেছিল। যেমন দেখা যায়- বোধিসত্ত্ব মূর্তির একটি মস্তক এর নাক, মুখ, চোখ প্রভৃতি সবই গ্রীক প্রথায় নির্মিত। এমনকি মাথার মুকুটটিও গ্রীক ‘হেলমেটের’ মত দেখতে। অন্য একটি বুদ্ধ মূর্তিতে দেখা যায় – মাথায় বিচিত্র পাগড়ী গলায় হারও উপবীত। কাপড় ও চাদরের ভাঁজগুলি গ্রীক মূর্তির মত। পায়ের স্যান্ডেল অভারতীয়, সর্বোপরি মূর্তিখানি বেঁটে ও মুখখানি দেবভাবের বিশেষ অভাব থাকায় এটি একটি সাধারণ মানুষের মূর্তিতে পরিণত হয়েছে।

বুদ্ধমূর্তির বৈশিষ্ট্য মূল্যায়ণ:

বুদ্ধমূর্তির ক্ষেত্রেও গান্ধারে গ্রীক শিল্পীরা ভিন্ন বৈশিষ্ট্য প্রদান করেছিল। যেমন একটি বুদ্ধমূর্তির মস্তকে দেখা যায় – মূর্তিখাসির কুঞ্চিত কেশ ও নাক মুখের ডৌলে গ্রীক প্রভাব সুস্পষ্ট তবুও মূর্তির মুখে একটি স্নিগ্ধ শ্রী থাকায় এটি রমনীয় হয়ে উঠেছে। ভারতীয় দেবমূর্তি গড়ার নিয়মকানুন এখানে প্রতিপালিত হয়নি। কারণ ভারতের দেবমূর্তি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ভক্তকে দৃষ্টি আশর্বিাদে ধন্য করে থাকেন। এখানে মূর্তিটির ঘাড় একটু বাঁকানো।

উপসংহার:

পরিশেষে বলা যায় – গান্ধার শিল্প বৌদ্ধ শিল্পকলায় এক দৃষ্টান্তমূলক উৎকর্ষ সাধন করে। গ্রীকদের সংস্পর্শে ভারতীয় ললিতকলা পেয়েছিল নতুন প্রাণ। গ্রীকদর অনুকরণ গান্ধারে গড়ে উঠেছিল নতুন স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলা।

Related Posts