রাজা মিলিন্দ কে ছিলেন? তার জীবন সম্পর্কে সম্যক ধারণা দাও।
প্রারম্ভিকা:
বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শন সম্পর্কে জটিল তত্ত্বগুলির বিচার বিশ্লেষণ ও সমাধান “মিলিন্দ প্রশ্ন” গ্রন্থের প্রতিপাদ্য বিষয়। “মিলিন্দ প্রশ্ন” গ্রন্থটি গ্রীকরাজ মিলিন্দ ও স্থবির নাগসেনর প্রশ্নোত্তর বা কথোপকথনের ধারায় আলোচিত হয়েছে। এই গ্রন্থে দুই নায়ক – রাজা মিলিন্দ ও ভিক্ষু নাগসেন। রাজা মিলিন্দ প্রশ্নের পর প্রশ্ন করেন, আর প্রধান নায়ক নাগসেন প্রশান্ত চিত্তে স্থিরভাবে নানা উপমা, গল্প, উদাহরণ দিয়ে জটিল তত্ত্বগুলি বুঝিয়ে দিচ্ছেন এবং রাজাও সদুত্তর পেয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
রাজা মিলিন্দের জীবন:
মিলিন্দ হলেন ইতিহাস বিখ্যাত ইন্দো-গ্রীক সম্রাট মিনান্ডার বা মেনান্ডার। চীনা অনুবাদে মিলন, তিব্বতীয় তাঞ্জুর সংকলনে মিলিন্দ নামে অভিহিত। মিলিন্দ শব্দটি Menander শব্দের পরিবর্তিত রুপ। দীর্ঘ ছত্রিশ বছর রাজত্বের পর ১৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে সম্রাট পৃষ্যমিত্রের মৃত্যু হয়। তখন উত্তর ভারতর শাসনকর্তা ব্যাকট্রিয়ার গ্রীকরাজাদের মধ্যে মিলিন্দ বেশ প্রতিপত্তি হয়েছিলেন। তার রাজ্যসীমা পাঞ্জাবের এক অংশ থেক আরম্ভ করে গান্ধার (বর্তমান পেশোয়ার), উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের প্রত্যন্তবাসীদের দেশ, সিন্ধুর কিয়দংশ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে কিছুদূর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল। তার রাজধানী ছিল সাগল নগর, বর্তমান মধ্য পাঞ্জাবের শিয়ালকোট। জানা যায় রাজা মিলিন্দ অলসন্দা দ্বীপের কলসী নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এই অলসন্দা ভারতবর্ষের সিন্ধুনদীর দ্বীপন্থিত আলেকজান্দ্রিয়া রুপে স্বীকৃত হয়েছে। তাঁর জন্মভূমি কলসী গ্রাম সম্ভবত Karsi। মিলিন্দের রাজধানী সাগল (সং শাকল) নগর গ্রীকদের Euthumedia থেকে অভিন্ন। এই ইউথুমিডিয়া পশ্চিম ভারতের ককেশাস পর্বতের মধ্যে অবস্থিত। বর্তমানে এটা চারিকার গ্রাম নামে পরিচিত এবং কাবুল ও পম্জসের নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত। মিলিন্দ নরপতি খ্রীষ্টপূর্ব ১৪০ থেকে ১১০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। মিলিন্দের রাজত্বের মধ্যেভাগে তিনি আচার্য নাগসেনের সঙ্গে মিলিত হন এবং এই সকল প্রশ্ন করেন। আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব ১২৫ অব্দে স্থবির নাগসেন এই “মিলিন্দ প্রশ্ন” রচনা করেন। স্ট্রাবো ও প্লরিয়সের লেখা থেকে জানা যায়, পশ্চিম ভারতে ও সিন্ধুদেশে ডিমিট্রিয়াসের সৈন্য পরিচালনার ভার ছিল রাজা মিলিন্দের উপর। সুতরাং, যেীবনে তিনি সৈন্য পরিচালনার বৃত্তি গ্রহণ করেছিলেন, মনে করা হয়।
আরও পড়ুন: গান্ধার শিল্পের সংক্ষিপ্ত ধারণা দাও। বৌদ্ধ শিল্পকলার ইতিহাসে এর গুরুত্ব মূল্যায়ণ কর।
মিলিন্দের সৈন্য পরিচালনার নৈপুণ্যে সম্রাট ডিমিট্রিয়াস এত মুগ্ধ হলেন যে, অবশেষে তিনি তাঁর কন্যা আগাথোক্লিয়াকে মিলিন্দের হাতে সমর্পণ করে তাঁকে জামাতা করেন। অতঃপর মিলিন্দের সেীভাগ্য আরও অধিক বৃদ্ধি পায়। আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব ১৬৫ অব্দে ডিমিট্রিয়াসের মৃত্যু হয়। ডিমিট্রিয়াসের মৃত্যুর পরই ভারতে মিলিন্দের রাজত্ব আরম্ভ হয়। এই সময় অ্যাপোলোডোটাসের সাথে সংঘর্ষ হয়। তিনি দক্ষিণে রাজপুতানা ও পূর্বে অযোধ্যার ভিতরে বেশ কিছু অংশে আধিপত্য বিস্তার করেন। তিনি অন্তত ত্রিশ বৎসর রাজত্ব করেছিলেন। খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর আরম্ভের পূর্বে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। ইতিহাসে বিভিন্নভাবে তার নাম জানা যায়, কিন্তু সম্যক পরিচয় জানা যায় না। রাজা মিলিন্দ সম্পর্কে সর্বাপেক্ষা প্রমাণিত বিষয় হল তাঁর প্রচলিত মুদ্রা। আজ পর্যন্ত তাঁর রাজত্ব কালের বত্রিশটি মুদ্রা আবিস্কৃত হয়েছে। তার মধ্যে অধিকাংশ রজত ও তাম্র নির্মিত। এগুলো উত্তর ভারতের পশ্চিমে কাবুল থেকে পূর্বে মথুরা, উত্তরে কাশ্মীর পর্যন্ত বিস্তৃত ভূ-ভাগের মধ্যেই পাওয়া গেছে। এগুলো দ্বারা অনুমান করা যায় তাঁর রাজ্যসীমা বেশ প্রসারিত ছিল।
- Smith- এর “ Early History of Indian” গ্রন্থে মিলিন্দের একটি মুদ্রা প্রদর্শিত হয়েছে। এটার একদিকে তাঁর গ্রীক পর্যন্ত মূর্তি অঙ্কিত আছে। এই মুদ্রার উপর রাজার প্রতিকৃতি অতি চমৎকার: আয়ত নাসিকা, সুন্দর চেহারা, ছবি অতিশয় সজীব মনে হয়। কোন কোন মুদ্রার প্রতিকৃতি তরুণ বয়সের, আর কিছু কিছু প্রেীঢ় ও বৃদ্ধাবস্থার। একে প্রমাণিত হয় মিলিন্দের রাজত্বকাল বেশ দীর্ঘস্থায়ী ছিল। মুদ্রাগুলোর এক পৃষ্ঠে গ্রীকভাষায় এবং অপর পৃষ্ঠে তদানীন্তন পালি ভাষায় লেখা আছে। রাজা মিলিন্দ বিদ্যোৎসাহী, ন্যায়-পরায়ণ, ও জনপ্রিয় ছিলেন। বেদ, পুরাণ, দর্শন প্রভূতি ঊনবিংশতি শাস্ত্রে তিনি সুপন্ডিত ছিলেন।
ইতিহাসে নানাভাবে রাজা মিলিন্দের নাম পাওয়া যায়। কিন্তু তাঁর মাতা-পিতার পরিচয় জানা যায় না। ”মিলিন্দ প্রশ্ন”- এর নিগমনে উল্লেখ আছে যে, রাজা মিলিন্দ মহাপন্ডিত নাগসেনের আচার-আচরণ, বুদ্ধি-নৈপুণ্য ও প্রত্যুতপন্নমতিতে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি অবশেষে ঘোষণা করলেন – “প্রভু নাগসেন, আজ থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমাকে শরণাগত উপাসক রুপে গ্রহণ করুন।” ভন্তে নাগসেনের প্রশ্নোত্তরে সন্তুষ্ট হয়ে রাজা তাঁকে শত সহস্র মূল্যের কম্বল পূজা করেন এবং প্রতিদিন রাজপ্রাসাদ থেকে আটশত ভিক্ষুর জন্য খাদ্য-ভোজ্য পাঠাতেন। শুধু তাই নয়, রাজা ”মিলিন্দ বিহার” নামে এক সংঘারাম বিহার নির্মাণ করে তাঁর পাত্র-মিত্রসহ সম্মিলিতভাবে স্থবির সাগসেন প্রমুখ ভিক্ষুসংঘকে সমর্পণ করেছিলেন।
”পালি মিলিন্দ প্রশ্ন”- এর নিগমনে আরও দেখা যায়, তিনি পুত্রের হাতে রাজ্যভার অর্পণ করে ভিক্ষুব্রত অবলম্বন করেছিলেন এবং বিদর্শন ভাবনা করে অর্হৎ হয়েছিলেন। ধর্ম জীবনে এইরুপ উন্নত হয়েছিলেন বলে মৃত্যুর পর তাঁর দেহাবশেষ নিয়ে নিমিত্ত প্রজাদের মধ্যে অত্যন্ত চাঞ্চল্য ও সংঘর্ষ দেখা দিয়েছিল। লোকেরা তাঁর ভস্মাবশেষের উপর স্তুপ নির্মাণ করেছিলেন। দেহাবশেষের উপর স্তুপ নির্মাণ বেীদ্ধদের প্রচলিত প্রথা। এতেও প্রমাণিত হয় রাজা মিলিন্দ নিশ্চয় বেীদ্ধধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন।
উপসংহার:
টার্ণ – এর বিবরণে জানা যায়, আগাথোক্লিয়া হলেন ডিমিট্রিয়াসের কন্যা এবং আগাথোকলসের ভগিনী। চতুষ্কোণ তাম্রমুদ্রায় দেখা যায়- আগাথোক্লিয়া ও তাঁর নাবালক পুত্র প্রথম ট্রাবোর নামে মুদ্রিত হয়েছে। তাতে আগাথোক্লিয়ার মস্তক শিরস্ত্রাণমন্ডিত, কিন্তু মুকুট পরিহিত নয়। এই মুদ্রাগুলোর সাহায্যে বুঝা যায়, আগাথোক্লিয়া তাঁর নাবালক পুত্রের প্রতিনিধিরুপে কিছুকাল রাজত্ব করেন। প্রথম ট্রাবোর এই নাবালকত্ব মিলিন্দের অকালমৃত্যু বা সংসার ত্যাগের ইঙ্গিত দেয়।