বাংলাদেশে নৃবিজ্ঞান পাঠের প্রয়োজনীয়তা অত্যধিক। এদেশে আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও জাতিগত সমস্যার প্রেক্ষিতে নৃবিজ্ঞান অধ্যয়নের প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এদেশে নৃবিজ্ঞান একটি সাম্প্রতিক কালের বিষয় হলেও যথেষ্ট গুরুত্বসহকারেই এটি আলোচিত হচ্ছে। নিম্নে বাংলাদেশে নৃবিজ্ঞান পাঠের প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা করা হলো:
১. ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন
বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য এদেশের গর্ব। এদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে হলে নৃবিজ্ঞান অধ্যয়ন করতে হবে। কেননা নৃবিজ্ঞানে ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। এ সংক্রান্ত জ্ঞান দেশের অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমানকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে সহায়তা করে।
নৃবিজ্ঞান পড়ে কি হবে? নৃবিজ্ঞান পাঠের প্রয়োজনীয়তা আলোচনা |
২. বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা
বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা সামাজিক সমস্যা সমাধানে অপরিহার্য। আমাদের দেশে সামাজিক সমস্যা অত্যধিক। সমস্যা থেকে সমাজকে মুক্ত করতে হলে প্রয়োজন বাস্তবধর্মী গবেষণা। আর বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা নৃবিজ্ঞান পাঠের মাধ্যমে করা যায়।
৩. সংস্কৃতি সম্পর্কে অবগত হওয়া
বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতি সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। এদেশের নিজস্ব সংস্কৃতির বিচিত্রতা আমাদের মুগ্ধ করে। সংস্কৃতির মূলভিত্তি হলো নৃবিজ্ঞান। কারণ নৃবিজ্ঞান সংস্কৃতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেয়।
৪. ক্ষুদ্র জাতিসত্তাদের জীবন ও আচরণ জানা
এদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাদের জীবনপ্রণালী সত্যিই বৈচিত্র্যে ভরপুর। এদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে হলে নৃবিজ্ঞান অধ্যয়ন করতে হবে। কারণ নৃবিজ্ঞান সকল জাতিসত্তার জীবনযাপন নিয়ে আলোচনা করে।
৫. জীবনের সঠিক নীতিমালা প্রণয়ন
জীবনের সঠিক নীতিমালা প্রণয়নের জন্য প্রয়োজন বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা। নৃবিজ্ঞানের আলোচ্যবিষয় সমাজের মানুষ। তাই মানুষের জন্য সঠিক পরিকল্পনা ও নীতিমালা প্রণয়নে নৃবিজ্ঞান পাঠ করা অত্যাবশ্যক।
৬. গোষ্ঠীভিত্তিক জ্ঞান অর্জন
গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের সমস্যা সমাধানের জন্য তাদের উপর ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করতে হয়। নৃবিজ্ঞান গোষ্ঠীর আচার আচরণ ও জীবনধারণ সম্পর্কে আলোচনা করে। তাই এদেশের নানা গোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে গোষ্ঠী সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জনে নৃবিজ্ঞান অধ্যয়ন করা প্রয়োজন।
৭. অর্থনীতি সম্পর্কে ধারণা
কোন সমাজের অর্থনৈতিক অবস্থা দেখে সে সমাজ সম্পর্কে ধারণা অর্জন করা যায়। নৃবিজ্ঞান সমাজের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা দিয়ে থাকে। ফলে এদেশের সমাজব্যবস্থার অর্থনৈতিক অবস্থা জানতে নৃবিজ্ঞান পাঠ করা দরকার।
৮. রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ
এদেশের রাজনৈতিক অবস্থা কেমন তা জানতে নৃবিজ্ঞানের সহায়তা নেয়া যেতে পারে। কেননা নৃবিজ্ঞান আদিম সমাজের রাজনীতি থেকে বর্তমান রাজনীতির প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করে। নৃবিজ্ঞান থেকে রাজনীতির অতীত অভিজ্ঞতা বর্তমান রাজনীতিতে কাজে লাগানো যেতে পারে।
৯. জীবনমান উন্নয়নের কৌশল জানা
নৃবিজ্ঞানীরা মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করেন। এদেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের কৌশল জানার জন্য নৃবিজ্ঞান অধ্যয়ন করা প্রয়োজন।
১০. ভূমি সম্পর্কে অবগত হওয়া
নৃবিজ্ঞানে ভূমি, ভূমির পরিবর্তন, ভূমিস্বত্ব প্রভৃতি বিষয়গুলো আলোচনা করা হয়। আমাদের দেশের অর্থনীতির মূলভিত্তি হলো ভূমি। এদেশের গ্রামীণ সমাজের সাথে ভূমির নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। ফলে ভূমি সম্পর্কে জানার জন্য নৃবিজ্ঞান পাঠ করা দরকার।
১১. জাতিভেদ প্রথা
জাতিভেদ প্রথা এদেশের হিন্দু-মুসলিম সবসমাজে কমবেশি লক্ষ্য করা যায়। একে কেন্দ্র করে সামাজিক অসমতা সৃষ্টি হয়। আর এটি নৃবিজ্ঞানের আলোচ্যবিষয়।
১২. পরিবেশের প্রভাব জানা
পরিবেশ মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। অনুকূল পরিবেশ মীনুষের জীবনের মানোন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখে। নৃবিজ্ঞানে পরিবেশের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। তাই এদেশের পরিবেশকে জানীর জন্য নৃবিজ্ঞান অধ্যয়ন করা দরকার।
১৩. উৎপাদন ক্ষেত্রে আধুনিকীকরণ
উৎপাদন ক্ষেত্রে আধুনিকীকরণ বিশেষ করে যান্ত্রিক পদ্ধতির চাষ ও অন্যান্য কৌশল অবলম্বনের জন্য উৎপাদন ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ দিক। নৃবিজ্ঞান আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই আমাদের দেশে উৎপাদন ক্ষেত্রে নৃবিজ্ঞানের অধ্যয়ন গুরুত্বপূর্ণ।
১৪. চিকিৎসা ব্যবস্থা
চিকিৎসা ব্যবস্থা বলতে মানুষের রোগসমূহ এবং চিকিৎসার ধরনকে বুঝায়। নৃবিজ্ঞানীরা এ সম্পর্কে গবেষণা করে থাকে। এছাড়া নৃবিজ্ঞান নানারকমের চিকিৎসার কৌশলও উদ্ভাবন করেন। তাই আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে জানার জন্য নৃবিজ্ঞান পাঠ করা প্রয়োজন।
১৫. সামাজিক পরিবর্তন
সমাজ গতিশীল বিধায় সামাজিক পরিবর্তন হবেই। সামাজিক পরিবর্তন এ প্রক্রিয়াকে আরো গতিশীল করে। পরিবর্তনের মাধ্যমেই সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। সামাজিক পরিবর্তন সম্পর্কিত ধারণা নৃবিজ্ঞান থেকে জানা যায়।
নৃবিজ্ঞানের পরিধি ও বিষয়বস্তু আলোচনা কর |
১৬. সুষ্ঠু প্রশাসন ব্যবস্থা
দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য নৃবিজ্ঞান পাঠ করা প্রয়োজন। নৃবিজ্ঞান থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান গবেষণার মাধ্যমে প্রশাসনিক কাজে লাগানো যায়। তাই প্রশাসনিক কার্যক্রম দ্রুত ও সুষ্ঠু করার জন্য নৃবিজ্ঞান পাঠ করা দরকার।
১৭. শ্রমিক সমাজের উন্নয়ন
শ্রমিকদের আর্থসামাজিক অবস্থা সম্পর্কে নৃবিজ্ঞানে আলোচনা করা হয়। এদেশের শ্রমিকরা বেশিরভাগই ভূমিহীন। তাই এদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে নৃবিজ্ঞানের জ্ঞান কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
১৮. ধর্মের আবির্ভাব ও বিকাশ
এদেশের ধর্মের আবির্ভাব, বিকাশ ও ধর্মচর্চার ইতিহাস নৃবিজ্ঞান অধ্যয়নের মাধ্যমে জানা যায়। এদেশের মানুষ ধর্মভীরু। তাই ধর্মের আদি ইতিহাস ও বিকাশ জানার জন্য নৃবিজ্ঞানের জ্ঞান অত্যাবশ্যক।
পরিশেষে বলা যায়, উপর্যুক্ত কারণে বাংলাদেশে নৃবিজ্ঞান অধ্যয়নের গুরুত্ব অপরিসীম। এদেশের আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক প্রভৃতি দিকের উন্নয়ন ও বিকাশে নৃবিজ্ঞানের জ্ঞান অত্যাবশ্যক।