রাজনৈতিক দলের প্রকারভেদ
আধুনিক বিশ্বের সকল রাষ্ট্রে দলীয় ব্যবস্থা বিদ্যমান। তবে সকল রাষ্ট্রের দলীয় ব্যবস্থা একরূপ নয়। সমাজ ব্যবস্থাভেদে এবং প্রতিটি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে বিভিন্ন রাষ্ট্রের দলীয় ব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক দল কত প্রকার সে সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে ভিন্নতা দেখা যায়। নিম্নে রাজনৈতিক দলের প্রকারভেদ সম্পর্কে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হলো-
(ক) মরিস দুভারজার (Maurice Duverger)
মরিস দুভারজার রাজনৈতিক দলগুলোর শক্তির ভিত্তিতে দল বা দলব্যবস্থাকে মোট ৪টি শ্রেণিতে বিভক্ত করেন। যথা-
১. Parties with a majority bent.
২. Major Parties.
৩. Minor Parties.
৪. Medium Parties.
রাজনৈতিক দল কি, কাকে বলে ও সংজ্ঞা |
১. সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে গঠিত দলসমূহ (Parties with a majority bent)
মরিস দুভারজার সেই সকল দলকেই ‘Parties with a majority bent’ নামে অভিহিত করেছেন যেগুলো সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অধিকারী, অথবা প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যে দলগুলো কোনো একদিন সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভে নিশ্চিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পর্যায়ে Democratic Party এবং Republican Party এই উভয় দলকেই ‘Parties with a majority bent’ নামে অভিহিত করা হয়।
২. বৃহত্তর দলসমূহ (Major Parties)
মরিস দুভারজারের মতে, ‘Major Parties’ হচ্ছে সেই সকল দল যেগুলো এককভাবে কোনো দিনই ক্ষমতাসীন হতে পারে না এবং ব্যতিক্রমধর্মী কোনো পরিস্থিতির সুযোগে ক্ষমতাসীন হলেও অন্য কোনো দলের সাহায্য ও সমর্থন নিয়ে শাসন করতে হয়।
৩. গৌণ দলসমূহ (Minor Parties)
যে দলগুলো গুরুত্বহীন এবং খুবই দুর্বল, দুভারজার সেগুলোকেই ‘Minor Parties’ নামে আখ্যায়িত করেন। সংসদে এ জাতীয় দলগুলোর আসন সংখ্যা খুবই কম থাকে, যার জন্য সরকারের শরিক দল হিসেবে এবং বিরোধী দল হিসেবেও উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকাই পালন করতে পারে না।
৪. মধ্যম দলসমূহ (Medium Parties)
‘Minor Parties’ এর তুলনায় ‘Medium Parties’ এর গুরুত্ব অনেক বেশি, কিন্তু ‘Major Parties’ এর প্রভাব ও গুরুত্বের তুলনায় সুনির্দিষ্টভাবেই কম। এদের সংসদীয় শক্তি Minor Parties-এর তুলনায় বেশি। সরকারের শরিক দল হিসেবে Minor Parties-র ন্যায় এদেরকে তৃতীয় শ্রেণির মন্ত্রিত্ব নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয় না। এরা মন্ত্রিসভার এক বা একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রিত্ব লাভ করে থাকে।
(খ) অ্যালমন্ডের শ্রেণিবিভাগ
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক গ্যাব্রিয়েল অ্যালমন্ড (Gabriel Almond) দলীয় ব্যবস্থাকে নিম্নলিখিত ৭ ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা-
১. অস্পষ্ট দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা। যেমন- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, আয়ারল্যান্ড।
২. সুস্পষ্ট দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা। যেমন- গ্রেট ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়া।
৩. কার্যকর বহুদলীয় ব্যবস্থা। যেমন- নরওয়ে ও সুইডেন।
৪. অস্থায়ী বহুদলীয় ব্যবস্থা। যেমন- ভারতবর্ষ ও মালয়।
৫. প্রভুত্বকারী দলীয় ব্যবস্থা। যেমন- ইতালি ও ফ্রান্স।
৬. এক দলীয় ব্যবস্থা। যেমন- উত্তর কোরিয়া ও কিউবা। ৭. সর্বাত্মক এক দলীয় ব্যবস্থা। যেমন- গণপ্রজাতন্ত্রী চীন।
(গ) বুরলাটস্কির শ্রেণিবিভাগ
বুরলাটস্কি (Burlatsky) শ্রেণিগত ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলকে বুর্জোয়া, পেটি বুর্জোয়া, প্রলেতারিয়ান এবং আধা-প্রলেতারিয়ান ব্যবস্থায় বিভক্ত করেছেন। মতাদর্শগত দিক থেকে রাজনৈতিক দলকে চরম দক্ষিণ-পন্থি দল (ফ্যাসিস্ট), রক্ষণশীল, বুর্জোয়া উদারপন্থি, বুর্জোয়া সংস্কারপন্থি, সমাজবাদী গণতান্ত্রিক, বাম সমাজতন্ত্রী, কমিউনিস্ট দলে বিভক্ত করেছেন। আবার দলের অভ্যন্তরীণ কাঠামোর দিক থেকে এদেরকে জঙ্গিবাদী, স্বৈরতান্ত্রিক এবং গণতান্ত্রিক দলীয় ব্যবস্থায় ভাগ করেছেন।
রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্য গুলো কি কি? |
(ঘ) সংখ্যার ভিত্তিতে শ্রেণিবিভাগ
সংখ্যার ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
১. একদলীয় ব্যবস্থা (One Party System)
২. দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা (Bi-Party System)
১. একদলীয় ব্যবস্থা (One party system)
রাষ্ট্রের মধ্যে যখন সাংবিধানিকভাবে একটিমাত্র রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকে এবং তাদের মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালিত হয়, তখন তাকে একদলীয় ব্যবস্থা বলে অভিহিত করা হয়। এ ব্যবস্থায় একটি দলই সকল ক্ষমতার উৎস। রাষ্ট্রের মধ্যে একটি দলই তার দলীয় আদর্শ, নীতি ও কর্মসূচি অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করে। এ ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন দল ব্যতীত অন্যান্য সকল দলকে নিষিদ্ধ করা হয়। একদলীয় ব্যবস্থায় দলীয় শৃঙ্খলা কঠোরভাবে মেনে চলা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে জার্মানিতে হিটলার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘নাৎসি দল’ এবং ইতালিতে মুসোলিনী কর্তৃক, প্রতিষ্ঠিত ‘ফ্যাসিস্ট দল’ একদলীয় ব্যবস্থার দৃষ্টান্ত। এছাড়া রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া, কিউবা প্রভৃতি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একদলীয় ব্যবস্থা প্রচলিত।
২. দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা (Bi-party system)
রাষ্ট্রে যখন দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল থাকে, তখন তাকে দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা বলা হয়। এ ব্যবস্থায় প্রধান দুটি দল ছাড়াও গুটিকয়েক ছোট দলের অস্তিত্ব দেখা যায়। পৃথিবীর অধিকাংশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা বিদ্যমান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যে দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে। এ ব্যবস্থায় আইনসভা নির্বাচনে যে দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে তারাই সরকার গঠন করে এবং অন্যটি বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা পালন করে।
৩. বহুদলীয় ব্যবস্থা (Multi-party system)
যে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় দুই-এর অধিক রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম দেখা যায়, তাকে বহুদলীয় ব্যবস্থা বলে। বহুদলীয় ব্যবস্থায় প্রতিটি দল নিজ নিজ দলীয় কর্মসূচির মাধ্যমে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। যে দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে, সেই দল সরকার গঠন করে। ভারত, পাকিস্তান, ইতালি, ফ্রান্স, বাংলাদেশ, সুইডেন প্রভৃতি দেশে বহুদলীয় ব্যবস্থার অস্তিত্ব রয়েছে।
অতএব, উপরোক্ত আলোচনা থেকে রাজনৈতিক দল কত প্রকার সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেলেন। এই আর্টিকেলটি যদি আপনাকে উপকৃত করে থাকে তবে আপনার বন্ধুদের সাথেও শেয়ার করুন।