সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য
রাষ্ট্রের সরকার দেশ পরিচালনা করে। সরকারের শাসনব্যবস্থা তথা দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল, সচল, প্রাণবন্ত ও ন্যায়ানুগ করার জন্য নাগরিককে কতগুলো দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয়। এসব কর্তব্য পালনেরমাধ্যমেই নাগরিকরা রাষ্ট্রীয় জীবনকে সুসভ্য, সুন্দর ও গৌরবময় করে তোলে। অর্থাৎ, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারের যেমন ভূমিকা আছে, তেমন নাগরিকরাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। মূলত নাগরিকের যথাযথ কর্তব্য পালনের মাধ্যমেই সুশাসন পূর্ণতা পায়। নিম্নে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য আলোচনা করা হলো:
১. সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারী ও পুরুষের সমান অংশগ্রহণ
সুশাসনের মূল ভিত্তি হচ্ছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারী এবং পুরুষের সমান অংশগ্রহণ। নাগরিকদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্রের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়, নাগরিকদের ক্ষমতায়ন হয়, গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। তাই সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নাগরিকদের অংশগ্রহণ করতে হবে।
২. জবাবদিহিতা
সুশাসনের অপর একটি উপাদান হলো জবাবদিহিতা। এটি সুশাসনের মূল চাবিকাঠি। রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং সুশীল সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলোকে নাগরিকদের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। কিন্তু এ জবাবদিহিতার বিষয়টি নিশ্চিত করার দায়িত্ব নাগরিকদের। জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে নাগরিকরা যদি সচেতনতা প্রদর্শন না করে তবে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে না।
আরও পড়ুন: সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারের করণীয় কি কি?
৩. সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা
সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারের কাজের গঠনমূলক সমালোচনা করা নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। সরকারের ভালো কাজে যেমন সহযোগিতা করা প্রয়োজন, তেমনি জনকল্যাণ বা জনস্বার্থ বিরোধী কাজের সমালোচনা করাও নাগরিকের দায়িত্ব।
৪. নিষ্ঠার সাথে সরকারি দায়িত্ব পালন
নাগরিকদের নিষ্ঠা ও সততার সাথে সরকারি দায়িত্ব সম্পাদন করা আবশ্যক। প্রত্যেকে যদি নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে, তবে দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে। পাশাপাশি সুশাসন নিশ্চিত হবে।
৫. মূল্যবোধের চর্চা
নাগরিকদেরকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা করতে হবে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ব্যক্তিত্বের বিকাশ, সহনশীলতা, সহিষ্ণুতা, ভ্রাতৃত্ববোধ ও সমতার মতো গুণগুলোর বিকাশ ঘটাবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নাগরিকদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
৬. নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শের অনুশীলন
নাগরিকদেরকে নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শের অনুশীলন করতে হবে। নিয়ম বহির্ভূতভাবে কোটি কোটি টাকা উপার্জনের মানসিকতা নাগরিকদের মধ্যে থাকলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না। দুর্নীতি করে নাগরিকরা হয়তো বিত্ত-বৈভবের মালিক হতে পারবে, কিন্তু সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে না।
৭. নাগরিক সচেতনতা
দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যে সব নীতিমালা ও আইন রয়েছে সেগুলো সম্পর্কে নাগরিকদের ভালোভাবে জানতে হবে এবং সচেতনভাবে তা প্রয়োগ করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে মৌলিক অধিকার, নাগরিক অধিকার, মানবাধিকার প্রভৃতির কথা বলা যায়। একজন নাগরিক যদি মানবাধিকার সম্পর্কে বিস্তারিত না জানে তবে সে হয়তো অজান্তেই অন্যের মানবাধিকার লঙ্ঘন করবে।
৮. আইনের প্রতি আনুগত্য
রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন মেনে চলা প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য। নাগরিকরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হলে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, যা সুশাসনের মান খর্ব করে। রাষ্ট্রের সংবিধানসহ অন্যান্য আইন সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রত্যেক সুনাগরিকের কর্তব্য। তাই এ সম্পর্কে নাগরিকদের ধারণা না থাকলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা কষ্টকর হয়ে পড়বে।
৯. অন্যের অধিকারের প্রতি সচেতনতা
নাগরিকের কোনো কর্মকান্ডের জন্য যাতে আশপাশের নাগরিকরা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়ে প্রত্যেককে সচেতন থাকতে হবে। অন্যের অধিকারের বিষয়ে সচেতন না হলে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে যা সুশাসনের পরিপন্থি।
১০. ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা
ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা সুনাগরিকের অন্যতম গুণ। এ ধরনের গুণের অধিকারীরা সহজেই সমাজে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিতে পরিণত হন, যা সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক।
১১. গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা
আধুনিক বিশ্বে সবচেয়ে প্রচলিত ও গ্রহণযোগ্য শাসনব্যবস্থা হচ্ছে গণতন্ত্র। আর এ গণতান্ত্রিক কার্যক্রমে অংশ নেওয়া প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য। নাগরিকরা ভোট দিয়ে যোগ্য প্রতিনিধি নির্বাচনের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে পারে।
১২. উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ
দেশের জনগণ যখন দেশের উন্নয়নের জন্য সচেতনমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে তখন দেশ এগিয়ে যাবে। সচেতনমূলক কর্মকান্ডের মধ্যে বৃক্ষরোপণ, নদী-খাল খনন কর্মসূচি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য জনগণকে সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হবে। সামাজিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে বাল্যবিবাহ রোধ, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ, বহু বিবাহ নিষিদ্ধকরণ ইত্যাদি।
১৩. আত্মকর্মসংস্থান বৃদ্ধি
দেশের ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যা দূরীকরণে নাগরিকগণ যখন আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারবে তখন দেশের বেকার সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে। আর বেকার সমস্যার সমাধান হলে তা সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
১৪. জাতীয় ঐক্য
দেশের নাগরিকরা যখন জাতীয় ঐক্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে তখন দেশ সুশাসনের দিকে ধাবিত হবে। তাই নাগরিকদের হীন দলীয় স্বার্থ বা ব্যক্তি স্বার্থ পরিহার করে জাতীয় ঐক্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।
১৫. লিঙ্গ-বৈষম্য রোধ করা
দেশের পুরুষ নাগরিকরা যখন নারীদের ক্ষমতায়নের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখবে তখন নারী সমাজের উন্নয়ন ঘটবে। এই উন্নয়নের অর্থ নারীদের প্রতি পুরুষের শ্রদ্ধাশীলতাকেই বোঝায়।
১৬. নিয়মিত কর প্রদান
সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয় হলো রাষ্ট্রীয় অর্থের পর্যাপ্ত যোগান থাকা। রাষ্ট্রীয় কোষাগারে অর্থের যোগানের প্রধান উৎস হলো নাগরিকের দেওয়া কর। তাই সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নাগরিকের অন্যতম কর্তব্য হলো নিয়মিত কর প্রদান করা।
পরিশেষে বলা যায়, সমাজ ও রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নাগরিকের কর্তব্য পালনের গুরুত্ব অনেক। নাগরিকের কর্তব্য পালনের মধ্য দিয়েই নাগরিক জীবন সুসংহত ও উন্নত হয়। আর নাগরিক জীবনের উন্নয়ন মানে রাষ্ট্রে একজন ব্যক্তির সাম্য, স্বাধীনতা ও অধিকার ভোগের নিশ্চয়তার পরিবেশ সৃষ্টি হওয়া। কেননা যথাযথভাবে কোনো নাগরিক কর্তব্য পালন না করলে সামাজিক ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে বহু সমস্যার সৃষ্টি হয়। ফলে রাষ্ট্রের অগ্রগতি ব্যাহত হয়। তাই বলা যায় সুস্থ, সভ্য, প্রগতিশীল ও উন্নত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নাগরিকের সচেতন কর্তব্যবোধ ও দায়িত্বের ওপর নির্ভরশীল।