Home » অশোকের শিলালিপি সম্পর্কে বর্ণনা দাও
অশোকের শিলালিপি

অশোকের শিলালিপি সম্পর্কে বর্ণনা দাও

by TRI

অশোকের শিলালিপি

সম্রাট অশোকের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন অশোকলেখ বা অশোকলিপিগুলো বৌদ্ধধর্মের অভূতপূর্ব প্রচার ও বিস্তারের সাক্ষ্য বহন করে। লেখগুলি ব্রাক্ষ্মী ও খরোষ্ঠী উভয় লিপিতেই রচিত। অশোকের শিলালিপি গুলো পর্বত গাত্রে, স্তম্ভের উপর এবং গুহার অভ্যন্তরে পাওয়া গেছে। তাই এগুলোকে যথাক্রমে শিলালিপি, স্তম্ভলিপি এবং গুহালিপি বলা হয়। তাঁর প্রাপ্ত লেখের সংখ্যা সর্বমোট ৩৪ টি।

অশোকের শিলালিপি গুলোকে সাধারণভাবে পাঁচ প্রকারে ভাগ করা যায়। যথা- প্রধান শিলালেখ, অপ্রধান শিলালেখ, প্রধান স্তম্ভলেখ, অপ্রধান স্তম্ভলেখ ও গুহালেখ। শিলালিপিগুলো সাম্রাজ্যের সীমান্ত অঞ্চলে পাওয়া গেছে এবং স্তম্ভলিপিগুলো সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে অনেকটা কেন্দ্রস্থলে পাওয়া যায়। ১৮৩৭ সালে কলকাতা ঠাকশালের কর্মচারী এবং এশিয়াটিক সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত জেমস প্রিনসেপ সর্বপ্রথম অশোকের শিলালিপির পাঠোদ্বার করেন।

আরও পড়ুন:   অশোক কে ছিলেন? তিনি কিভাবে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন?

অশোকের প্রধান শিলালেখগুলোর সংখ্যা চৌদ্দটি। এগুলো সারিবদ্ধ অবস্থায় পাওয়া ‍গিয়েছে এবং এগুলো সর্বসমেত একটি সম্পূর্ণ গ্রন্থ। বিভিন্ন স্থানে প্রাপ্ত এই লেখগুলো বিশ্লেষণ করলে লেখগুলোর ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় মূল্যায়ন করা যায়। জনসাধারনের নৈতিক উন্নতিবিধানের জন্য তাঁর ছিল অকুণ্ঠ প্রয়াস। যে স্থানগুলোতে এই লিপি পাওয়া গেছে সেই স্থানগুলো হল- পেশোয়ারের অন্তর্গত শাহাবাজগাঢ়ি, হাজারা জেলার অন্তর্গত মানশেরা দেরাদুনের অন্তর্গত কালসি, কাথিয়াবাড়ের অন্তর্গত গিরনার, মহারাষ্ট্রের অন্তর্গত নানা জেলায়- সোপারা গঞ্জাম জেলায়, জৌগড় অন্ধ্রেকুরনুল জেলায় ইয়েরাগুড়ি এবং পুরী জেলায় ধৌলি। জৌগড়ে এবং ধৌলিতে একাদশ এবং দ্বাদশ শিলালিপির পরিবর্তে দুটি বিশেষ লেখ পাওয়া যায়। এদের কলিঙ্গ লিপি বলা হয়। অশোকের কলিঙ্গ জয়ের পরে এই লেখ দুটি প্রচারিত হয়। কেবলমাত্র ভারতের বিভিন্ন স্থানেই নয়, আরমীয় অক্ষরে লেখা দুইটি লেখ তক্ষশিলায় ও পূর্ব আফগানিস্তানের জালালাবাদে পাওয়া গিয়েছে। ত্রয়োদশ শিলালিপিতে অশোকের সাম্রাজ্যের সীমান্তের যে বর্ণনা আছে, সেই সীমান্ত অঞ্চলে এই প্রধান শিলালিপিগুলো পাওয়া গিয়েছে।

অশোকের অপ্রধান শিলালিপির সংখ্যা মাত্র দুইটি। প্রধান শিলালিপিগুলোর মত এরা পরষ্পরের সঙ্গে যুক্ত নয়। বরং বলা যায় এরা পরষ্পরের বিচ্ছিন্ন। প্রধান শিলালেখগুলোর মত এগুলো বিশদ নয়, পরন্তু এগুলো সংক্ষিপ্ত। এদের মধ্যে প্রথমটি পাওয়া গিয়েছে জব্বলপুর জেলার রুপনাথে এবং দ্বিতীয়টি পাওয়া যায় জয়পুরের বৈরাটে। প্রথমটির ভাষান্তর শাহাবাদ জেলায় সাসারামে, জয়পুরের বৈরাটে, রায়চুর জেলার মাসাকিতে এবং বর্দ্ধিত আকারে মহীশুরের অন্তর্গত চিতল দ্রুগ জেলার সিদ্দপুর, জতিঙ্গ রামেশ্বর, এবং ব্রক্ষ্ম গিরিতে পাওয়া গিয়েছে। এই অপ্রধান শিলালিপির দুইটির ভাষান্তর মাদ্রাজ প্রদেশের অন্তর্গত কুরনুর জেলার ইয়েবা গুড়িতে এবং একদা নিজাম রাজ্য কোপবলে পাওয়া যায়। এই স্থান গুলো ছিল পাঙ্গুড়ারিয়া মৈধ্য প্রদেশ শিহোর জেলা। নিট্টুর এবয় উড়ে গেলাম কের্ণাটক, বেলারি জেলা। প্রাকৃত ভাষা ছাড়াও গ্রীক এবং আরমীয় ভাষায় লিখিত অশোকের লিপি পাওয়া গিয়েছে। এগুলোকে অপ্রধান লিপি অথবা প্রধান লিপিগুলোর ভাষান্তর বলা যায়। তক্ষশিলা, পল-ই-ডরুন্ত লাঘমন উপত্যকা, কান্দাহার এবং তৎসংলগ্ন সারিকুনা এগুলোর প্রাপ্তি স্থান।

অশোকের প্রধান স্তম্ভলেখ হল সাতটি। এই সাতটি লেখই দিল্লীর একটি স্তম্ভগাত্রের উপর পাওয়া যায়। এই স্তম্ভটি সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘল অদূরবর্তী তোপরা গ্রাম থেকে এখানে এনেছিলেন। সাতটি লিপির মধ্যে প্রথম ছয়টি ভাষান্তর দিল্লীর আর একটি স্তম্ভের উপর পাওয়া গেছে। একই সুলতান এই স্তম্ভটি মীরাট থেকে এখানে এনেছিলেন। এলাহাবাদের একটি স্তম্ভের উপর অনুরূপ ভাষান্তর পাওয়া যায়। সম্ভবত আকবর এই স্তম্ভটি কোশাম্বী থেকে এখানে এনেছিলেন। এছাড়া প্রথম ছয়টি লিপির ভাষান্তর বিহারের চম্পারণ জেলার অন্তর্গত লৌরিয়া আরারাজ, লৌরিয় নন্দনগড় এবং রাম পর্বতে পাওয়া যায়। মগধ থেকে নেপাল যাত্রার পথে এই তিনটি স্থান অবস্থিত। অশোক বুদ্ধের জন্মস্থান লুম্বিনী গ্রামে যাওয়ার সময় এই পথে গিয়েছিলেন। মনে হয় অশোকের এই যাত্রাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এই স্তম্ভ গুলো নির্মিত।

অশোকের অপ্রধান স্তম্ভলেখ তিনটি। প্রথমটি পাওয়া যায় বারাণসীর নিকটবর্তী সারনাথে এবং ভূপালের অন্তর্গত সাঁচীতে। দ্বিতীয়টি পাওয়া যায় বুদ্ধের জন্মস্থান লুম্বিনী গ্রামে এবং তৃতীয়টি পাওয়া যায় এরই অদূরে নিগলিভ নামক স্থানে। গুহালিপি পাওয়া যায় গয়া জেলার বরাবর পাহাড়ে। এই লেখটিতে অশোকের আজীবিক সম্প্রদায়ের প্রতি দানের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই শিলালিপিগুলোতে অশোকের নিজের নাম উল্লেখিত নেই। একমাত্র চতুর্থ অপ্রধান মাস্কি শিলালেখতে তাঁর দেবানং প্রিয় উপাধির সাথে নিজের নাম ”অশোক” যুক্ত রয়েছে। যথা- ”দেবানং পিয়স অসোকস”। আফগানিস্তানের গ্রীক ও আর্মেণীয় লিপিতেও “পিয়দসেস” উপাধিটি উল্লিখিত রয়েছে।

উপসংহার

পরিশেষে বলা যায়, ভারতের ইতিহাসে সম্রাট অশোকই প্রথম সম্রাট যিনি তাঁর আদর্শ এবং কৃতিত্ব এভাবে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। চিন্তায় ও কাজে তদানীন্তন ভারতের নিকট প্রতিবেশী পারস্যে আর্কিমেনীয় বংশের প্রথম সম্রাট দারয়রৌষ অনুরূপ লেখা প্রচার করেছিলেন। দুই জনের লিপিতেই মুখবনদ্ধ প্রায় একই রকমের। তাছাড়া অশোকের লিপিতে দিপি নিপিষ্ট ইত্যাদি কয়েকটি শব্দ পাওয়া যায়, যেগুলোর উপত্তি পারস্য দেশীষ বলে মনে করা হয়। সুতরাং অনেকে অনুমান করেন যে, অশোকের এই কাজের পিছনে পারস্যের প্রেরণা ছিল।

Related Posts