অভিধর্মের শিক্ষা যথাভূত দর্শন বা প্রজ্ঞা। সুতরাং মানুষ কি? মানুষের লক্ষ্যই বা কি? পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে তার সম্পর্কই বা কি ইত্যাদি যথাভূত বিচার ও মীমাংসা করতে গিয়ে অভিধর্মের আলোচ্য বিষয় চিত্ত, চৈতসিক, রূপ ও নির্বাণ এই চার প্রকার হয়েছে। পরমার্থ ধর্ম হিসেবে রূপ অভিধর্মের তৃতীয় প্রধান আলোচ্য বিষয়।
আরও পড়ুন: অনিত্য শব্দের অর্থ কি? বৌদ্ধ দর্শন কি অনিত্য দর্শন? – ব্যাখ্যা কর
রূপের সংজ্ঞা
সাধারণ অর্থে রূপ হল জড় পদার্থ – যা শীতে সঙ্কুচিত ও উত্তাপে প্রসারিত হয়। লৌকিক অর্থে বর্ণ ও আকার এবং বিশেষার্থে জড় পদার্থের গুণাবলীকে বুঝায়। ধর্ম্মসঙ্গণীতে বলা হয়েছে যে রূপ বলতে সাধারণত: জীবজগৎ, জড়জগৎ, জীবন্তদেহ, মৃতদেহ এবং তৎ সম্পর্কীয় যাবতীয় বিষয় ও বস্তুকে বুঝায়।
রূপের শ্রেণীবিন্যাস
গুণভেদে রূপের মোট সংখ্যা ২৮ প্রকার। এই আটাশ রকমের রূপকে প্রধানত: দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা- মহাভূত রূপ ও মহাভূতোৎপন্ন রূপ। এই দ্বিবিধ রূপ পুনঃ একাদশ ভাগে বিভক্ত। যথা- ১.মহাভূতরূপ, ২.প্রসাদরূপ, ৩.গোচররূপ, ৪.ভাবরূপ, ৫.হৃদয়রূপ, ৬.জীবিত রূপ, ৭.আহাররূপ, ৮.পরিচ্ছেদরূপ, ৯.বিজ্ঞত্তিরূপ, ১০.বিকাররূপ ও ১১.লক্ষণরূপ। প্রতিটি রূপ কিরূপে এর গুণ ও শক্তিতে পরিণত হচ্ছে- তার বিবরণ নিম্নে আলোচনা করা হল-
১. মহাভূত রূপ: এই রূপ চার প্রকার। যথা- পৃথিবী ধাতু, অপ ধাতু, তেজ ধাতু, বায়ু ধাতু। রূপের একটি প্রধান গুণ হল বিস্তৃতি বা স্থান অবরোধতা অর্থাৎ এটা একটি স্থান অধিকার করে থাকে। এই বিস্তৃতির গুণ হল কাঠিন্য ও কোমলতা যা পদার্থের মৌলিক পার্থক্য নির্ণয়ের সহায়ক । উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় কার্পাস দুধের তুলনায় কঠিন, কিন্তু মাটির তুলনায় কোমল । সুতরাং কার্পাসকে কঠিন বা কোমল বলা অন্য বস্তুর সাথে এর পার্থক্যের উপর নির্ভর করে। জড়পদার্থের এই বিস্তৃতি গুণকে ধাতু বলা হয়। জড় পদার্থের এ বিস্তৃতি গুণ এবং এর কঠিনতা- কোমলতা গুণকে দার্শনিক পরিভাষায় পৃথিবীধাতু বলা হয়। জড়ের অপর একটি গুণ সংসক্তি। এরূপ গুণের দ্বারা জড়বস্তু পিণ্ডীভূত হতে পারে। এ সংসক্তির দার্শনিক পরিভাষা হল অপধাতু। অপ শব্দের অর্থ হল বন্ধন। এ অপধাতু বা সংসক্তি জলে যেমন বিদ্যমান, সেরূপ লৌহদণ্ড, তাম্রখণ্ড এবং সুবর্ণ খণ্ডেও বিদ্যমান। জড়ের তৃতীয় মৌলিক অপর একটি গুণ তাপ। তাপহীন পদার্থ জগতে বিদ্যমান নেই। উষ্ণ কিংবা শীতল এটা পদার্থের তুলনামূলক অবস্থা মাত্র। এর দার্শনিক পরিভাষা হল তেজধাতু । দগ্ধ, উত্তপ্ত, আলোকিত, উদ্ভাসিত এবং পরিপাক করার যে শক্তি, তাকে তেজধাতু নামে অভিহিত করা হয়। জড়ের চতুর্থ গুণ হল গতিশীলতা, অভিধর্মের ভাষায় এর নামকরণ করা হয়েছে বায়ুধাতু। যা গতিশীল বা প্রবাহিত হয়, তাহাই বায়ু তেজধাতু ও বায়ুধাতু পরস্পর অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত এবং উত্তাপের উৎপাদক। সেরূপ মনোজগতে চিত্ত ও কর্মই পরস্পরের পরিপূরক। পৃথিবী ধাতু, অপধাতু, তেজধাতু ও বায়ুধাতু পরস্পরের আশ্রিত, সহজাত এবং একত্র সম্বন্ধীভূত। এসব একত্রে বর্ণ, গন্ধ, রস ও ওজের সাথে সম্পর্কযুক্ত। কেবল সংযোগের মাত্রাধিক্য অনুসারে বিভিন্ন প্রকার অবস্থা ও আকার প্রাপ্ত হয়। পৃথিবীধাতুতে কাঠিন্য, অপে সংসক্তি, তেজে তাপ ও বায়ুধাতুতে বেগের আধিক্য বর্তমান । এই চার মহাভূতরূপ থেকে বাকি ২৪ প্রকার রূপ উৎপন্ন হয় অর্থাৎ এদের মধ্যে এ চারগুণ প্রকটভাবে বিদ্যমান থাকে। তাই এই ২৪ প্রকার রূপের নাম উৎপন্নরূপ বা উপাদারূপ ।
২. প্রসাদরূপ: এই রূপ পাঁচ প্রকার- চক্ষু, শ্রোত্র, ঘ্রাণ, জিহ্বা ও কায়। প্রসাদ অর্থ স্বচ্ছতা। এই স্বচ্ছতা গুণবিশিষ্ট জড় পদার্থগুলোই প্রসাদরূপ। স্বচ্ছ দর্পণে যেমন পদার্থের প্রতিবিম্ব পড়ে, তেমনি চোখে বর্ণের, শ্রোত্রে শব্দের, ঘ্রাণে গন্ধের, জিহ্বায় রসের এবং কায়ার স্পৃষ্টের পতন দ্বারা স্পর্শের উৎপত্তি হয়। এজন্য এদের সাধারণ নাম প্রসাদরূপ। তবে এদের মধ্যে জড়ের সাধারণ গুণ পৃথিবী-অপ-তেজ-বায়ুধাতু বিদ্যমান । চক্ষু দ্বারা দর্শন কৃত্য সম্পাদিত হয়, অন্য জড়ের এই গুণ নেই। তাই এটা চক্ষুর বিশেষ গুণ। সেরূপ শ্রোত্রের ঘ্রাণের জিহ্বা এবং কায়ার বিশেষ গুণ হল প্রসাদগুণ।
৩. গোচররূপ: গোচররূপ পাঁচ প্রকার – রূপ, শব্দ, গন্ধ, রস ও সৃষ্ট। গোচর অর্থে চারণ ভূমি। চক্ষাদি পঞ্চেন্দ্রিয় রূপাদি আলম্বনে বিচরণ করে বলে রূপ, শব্দ, গন্ধ, রস ও স্পৃষ্টকে গোচররূপ বলা হয়। রূপের নানা বর্ণ ও আকার, এগুলো চক্ষু গ্রাহ্য। অন্য কোন জড়ের গ্রাহ্য নয়। সেরূপ শব্দ, গন্ধ, রস ও সৃষ্ট। তবে অপধাতু বা সংসক্তি কায়ার গ্রাহ্য নহে বিধায় অপধাতু বর্জিত ভূতত্রয়।
৪. ভাবরূপ: ভাবরূপ দু প্রকার- স্ত্রীভাব ও পুংভাব। ভূ-ধাতু নিষ্পন্ন ভাব অর্থ হওয়া বা উৎপন্ন হওয়া । ভাব শব্দ দ্বারা উৎপত্তি বা উৎপাদনকারী গুণ বুঝায়। স্ত্রী বা পুং ভাবরূপ অর্থ স্ত্রীজাতি বা পুরুষজাতি সুলভ আকার, ব্যবহার, চলন, ভাষণ, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, হাব-ভাব-ভঙ্গী ইত্যাদির উৎপাদক গুণ। এই গুণাবলী স্ত্রী ও পুরুষ উভয়ের সর্বাঙ্গে পরিব্যাপ্ত। ভাব উৎপাদক গুণ বলেই দু’টোকে একটি রূপ ধরা হয়।
আরও পড়ুন:
চৈতসিক বলতে কি বুঝ? চৈতসিক কত প্রকার ও কি কি? সর্বচিত্ত সাধারণ চৈতসিক কত প্রকার ও কি কি?
৫. হৃদয়রূপ: হৃদয়রূপ একটি – হৃদয়বাস্তু। বাস্তু অর্থ ভিটা বা বসতিস্থান। হৃৎপিণ্ডই হৃদয়ের বাস্তু বলা হয়। কারণ মস্তিষ্ক যাবতীয় স্নায়ুর কেন্দ্ররূপে চিত্তক্রিয়ার অন্যতম সহায় হলেও মস্তিষ্ক ও স্নায়ুর সজীবতা হৃৎপিণ্ড প্রেরিত রক্তের উপর নির্ভরশীল। এজন্যে হৃদয়বাস্তুই হল হৃদয়রূপ।
৬.জীবিতরূপ: জীবিতরূপ একটি- জীবিতেন্দ্রিয় অর্থাৎ রূপের জীবনীশক্তি। কর্ম বলে রূপস্কন্ধের উৎপত্তি হলেও এর জীবনীশক্তি হল জীবিতেন্দ্রিয়। এই জীবিতেন্দ্রিয়ের বিদ্যমানতার উপর নির্ভর করে জীবিতরূপ। এই গুণ শিলাখণ্ডে বিদ্যমান নেই, কিন্তু জীবের সর্বাঙ্গে বিদ্যমান।
৭. আহার রূপ: আহাররূপ একটি তা হল কবলীকৃত আহার। রূপের পোষণ ও পুষ্টির জন্যে আহার প্রয়োজন। জীবিতেন্দ্রিয়ও এই আহারে নির্ভরশীল। গলাধঃকরণ দ্বারা যা করা যায়, তাহাই কবলী কৃতাহার। এই আহারের গুণে প্রাণীকুল নানাবিধ পরিশ্রম ও কর্ম করতে সক্ষম। পৃথিবী ধাতু হতে কবলীকৃত আহার পর্যন্ত ১৮ প্রকার রূপকে নিষ্পন্ন রূপ বলা হয়। কারণ- এই রূপসমূহ তৃষ্ণা-দৃষ্টি-মান সম্প্রযুক্ত কর্ম দ্বারা উৎপন্ন হয়। নীচের দশ প্রকার রূপ কর্ম নিষ্পন্ন নহে বলে অনিষ্পন্ন রূপ বলা হয়।
৮. পরিচ্ছেদ রূপ: এ রূপ একটি, তা হল আকাশধাতু। পরিচ্ছেদ হল ভাগ বা বিভাগ । এগুণ আছে বলে পদার্থকে ভঙ্গ করা যায়। বালুকাস্তূপের মধ্যে যেমন আকাশ বিদ্যমান, প্রত্যেক বালি-কণায়ও তেমন আকাশ বিদ্যমান। বালি-স্তূপ অপসারণ করলে এর মধ্যে উৎপন্ন আকাশও অপসৃত হয় ।
৯. বিজ্ঞপ্তি রূপ: বিজ্ঞপ্তি হল কায় বা বাক্য দ্বারা মনোভাব ব্যক্ত করার গুণ। বিজ্ঞপ্তি রূপ দু’টো- কায় বিজ্ঞপ্তি ও বাক্-বিজ্ঞপ্তি। যে গুণের সাহায্যে জড় পদার্থের মনোভাব ব্যক্ত করা যায়, তাহাই বিজ্ঞপ্তি রূপ। অর্থপূর্ণ বাক্য দ্বারা একের মনোভাব অন্যের বোধগম্য করা বাক- বিজ্ঞপ্তি এবং অঙ্গ-প্রত্যক্ষের সঞ্চালনে, ইসারা-ইঙ্গিতে মনোভাব ব্যক্ত করার নাম কায় বিজ্ঞপ্তি । এ বিজ্ঞপ্তিদ্বয় শুধু চিত্তজাত।
১০. বিকার রূপ: বিকাররূপ তিনটি। যথা-লঘুতা, মৃদুতা ও কর্মণ্যতা। উৎপন্ন রূপের বিশেষ অবস্থার নাম বিকার। রূপের হালকা ভাবই লঘুতা। কায়ক্রিয়ার ইচ্ছানুরূপ সঞ্চালন শীলতাই মৃদুতা। শারীরিক ক্রিয়ার অনুকূল অবস্থা বা কর্ম-উপযোগিতাই কর্মণ্যতা। বিকার রূপ তিনটি- চিত্ত, ঋতু ও আহারজাত।
১১. লক্ষণ রূপ: লক্ষণরূপ চার প্রকার। যথা-উপচয়, সন্ততি, জড়তা ও অনিত্যতা। যে সমস্ত প্রধান লক্ষণ বা চিহ্ন দ্বারা জড়ের অনিত্যতা ও পরিবর্তনশীলতা জানা যায়, সে সকল চিহ্নই লক্ষণরূপ । প্রতিসন্ধি বা অচয় হতে উপচয় পর্যন্ত অর্থাৎ প্রতিসন্ধির পরক্ষণ হতে চক্ষু- দশকাদির উৎপত্তি পর্যন্ত ক্রমিক গঠনাবস্থা হল উপচয়। পূর্ণ গঠিতাবস্থার প্রবাহকে সন্ততি বলা হয়। অচয় হতে সন্তুতির শেষ পর্যন্ত রূপের উৎপত্তি কাল। জড়তা হল পতনাবস্থা এবং অনিত্যতা হল মৃতাবস্থা । এসব লক্ষণ যেমন বৃক্ষে, এর শাখা-প্রশাখায়, পত্র-পুষ্প-ফলে দৃষ্ট হয়, তেমন প্রত্যেক দৈহিক ক্রিয়ায়, গমনাগমনে, দাঁড়ানে, শয়নে বা উপবেশনে, ভাষণে এমন কি চক্ষুর উন্মীলনে ও নির্মীলনে বিদ্যমান। এই লক্ষণরূপ ভাবনা বিদর্শনের অন্তর্গত।
উপসংহার
উপোরেল্লিখত রূপ অহেতুক, সমপ্রত্যয়, স-আসব, সংস্কৃতি, লোকীয় কামাবচর, অনালম্বন, প্রহাতব্য, আধ্যাত্মিক, বাহ্যিক ইত্যাদি নানাভাবে বিভক্ত করা যেতে পারে। কর্ম, চিত্ত, ঋতু ও আহার-এই চার বিষয় দ্বারা রূপের সমুত্থান বা অবস্থান্তর হয়। দুগ্ধ হতে যেমনি দধির উৎপত্তি, তেমনি রূপের এক অবস্থা হতে অন্য অবস্থার উৎপত্তিই রূপ সমুত্থান। রূপ চিত্তের আলম্বন আকারেই ব্যবহৃত হয়; রূপ নিজে কোন আলম্বন গ্রহণ করতে পারে না। কামলোকের সত্ত্বগণ প্রবর্তনের সময় এসব রূপ যথাযথ প্রভাবে পরিপূর্ণাকারে প্রাপ্ত হয়।