Home » দীর্ঘ নিকায়ের পরিচয় দাও। বুদ্ধের ধর্ম প্রচারে দীর্ঘ নিকায়ের ভূমিকা তুলে ধর

দীর্ঘ নিকায়ের পরিচয় দাও। বুদ্ধের ধর্ম প্রচারে দীর্ঘ নিকায়ের ভূমিকা তুলে ধর

by TRI

দীর্ঘ নিকায়ের পরিচয় ও বুদ্ধের ধর্ম প্রচারে দীর্ঘ নিকায়ের ভূমিকা

ভূমিকা

বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র পবিত্র ত্রিপিটক নামে পরিচিত।ত্রিপিটক বলতে তথাগত ভগবান বুদ্ধের আদি মধ্য ও অস্তিম বাণীকে বুঝায়। ত্রিপিটক হল তিনটি পিটক বা পুস্তকের সমন্বয়। যথা: সূত্র পিটক, বিনয় পিটক ও অভিধর্ম পিটক। সূত্র পিটকে ভিক্ষু -গৃহী – প্রব্রজিত সকল শ্রেণির লোকের ধর্মমতঃ জীবন যাত্রার ব্যাবহার পদ্ধতি ও উপদেশ লিপিবদ্ধ রয়েছে।বিনয় পিটকে বৌদ্ধ ভিক্ষু ভিক্ষুণীর পরিশুদ্ধ জীবন গঠণের জন্য আচার আচরণের বিধি বিধান বর্ণিত আছে। অভিধর্ম বিষয়ে আধ্যাত্মিক বিষয়ের বিশ্লেষণ ও বৌদ্ধ মনস্তত্বের বর্ণনা রয়েছে।

দীর্ঘ নিকায়ের পরিচয়

দীর্ঘ নিকায় সূত্র পিটকের প্রথম নিকায়। চৈনিক বৌদ্ধশাস্ত্রে এটাকে দীর্ঘাগম বা দীর্ঘ সংগ্রহ বলা হয়েছে।বুদ্ধের দীর্ঘ উপদেশগুলো এ নিকায়ের অন্তর্গত। এতে মোট ৩৪ টি দীর্ঘ মাপের সূত্র আছে। সেজন্য বোধ হয় একে দীর্ঘ নিকায় আখ্যা দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘ নিকায়ের প্রতিটি সূত্রে বৌদ্ধধর্মের চরিত্রনীতি অথবা দার্শনিক তত্ত্বের এক বা একাধিক বিষয়াঙ্গের বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে।অধিকাংশ সূত্র এক একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ ক্ষুদ্রাকার গ্রন্থ বিশেষ বলা যায়। দীর্ঘ নিকায়ের সূত্রগুলি তিনটি বর্গে বিভক্ত। যথা-সীলকখন্ডবর্গ, মহাবর্গ ও পাটিকবর্গ। প্রথম বর্গের সকল সূত্র এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্গের কোন কোন সূত্র সম্পূর্ণ গদ্যে রচিত। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্গের বহু সূত্র গদ্যে ও পদ্যে রচিত। আবার কোন কোন সূত্রে সংস্কৃত ও আধা সংস্কৃতের ন্যায় একই বিষয় একবার পদ্যে ও পুনরায় গদ্যে প্রকাশ করতে দৃষ্ট হয়। সাধারণভাবে দীর্ঘনিকায়ের সূত্রগুলোর আলোচ্য বিষয়- দান, শীল, সমাধি, প্রজ্ঞা, ধ্যান, বিমোক্ষ, অনিত্য, দুঃখ, অনাত্ম, চিত্ত, চৈতসিক ও নির্বাণ।

আরও পড়ুন:   পুদগল শব্দের তাৎপর্য ব্যাখ্যা কর। পুদগলের বিশেষত্ব সম্পর্কে আলোচনা কর

বুদ্ধের ধর্ম প্রচারে দীর্ঘনিকায়ের ভূমিকা

দীর্ঘনিকায় প্রাক বুদ্ধ ও বুদ্ধকালীন ভারতের ইতিহাস, দর্শন, রাজনীতি, সমাজ নীতি ও অর্থনৈতিক অবস্থা প্রভৃতি সকল বিষয়ের আলোচনায় পূর্ণ। দীর্ঘনিকায়ের প্রথম সূত্র ব্রক্ষ্মজাল সূত্র বৌদ্ধধর্ম তথা প্রাচীন ভারতের ধর্মীয় জীবন ও দার্শনিক চিন্তাধারা জানার পক্ষে একান্ত অপরিহার্য। বিভিন্ন ধরনের হীন জীবনযাত্রা ও অবৌদ্ধ দার্শনিক মতবাদ পরিহার করে যাতে বুদ্ধ শিষ্যগণ তাঁর নির্দেশিত পবিত্র জীবন যাপন ও ধ্যান সমাধি ভাবনা করে অর্হত্ত্ব লাভ ও নির্বাণোপলব্ধি করতে পারেন তাই এই সূত্রের প্রধান আলোচ্য বিষয়। দীর্ঘনিকায়ের দ্বিতীয় সূত্র শ্রামণ্যফল সূত্রে বুদ্ধ নির্দেশিত আদর্শ ভিক্ষু জীবন যাপনের ফলে অর্হত্ত্ব লাভ, প্রাচীন ভারতের ধর্মীয় নেতাদের বিভিন্ন মতবাদ ও সমাজ চিত্রের উপর আলোকপাত করে। এই সূত্রে বুদ্ধের ধর্মে মগধের রাজা অজাতশত্রুর উপাসক রূপে দীক্ষা গ্রহণও বর্ণিত হয়েছে। শুভ সূত্রে শ্রামণ্যফল সূত্রের ন্যায় বৌদ্ধ শীল, সমাধি, প্রজ্ঞা সম্পর্কে আলোচনাও দৃষ্ট হয়। দীর্ঘনিকায়ের অম্বট্ঠ সূত্র ও সোণদণ্ড সূত্রে জাতিভেদ সম্পর্কে বুদ্ধের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত ব্যক্ত করা হয়েছে। কুটদন্ত সূত্রের আলোচ্য বিষয়, যাগ-যজ্ঞে পশুবলি পরিত্যাগ করে ধান্য, ফল-মূল, দুগ্ধ, নবনীত ইত্যাদি উপাদানের আহুতি দিয়ে যজ্ঞ সম্পাদনই আদর্শ অহিংস যজ্ঞ। তেবিজ্জ সূত্রে, ত্রিবেদজ্ঞ ব্রাক্ষ্মণের জীবনযাপনের উপর তীব্র কটাক্ষপাত করা হয়েছে। মহালি সূত্রে ও জালিয় সূত্রে কিভাবে দিব্যচক্ষু ও দিব্যকর্ণ ইত্যাদি ঋদ্ধিশক্তি লাভ করা যায়, শরীর ও মন এক কি না, আত্মার অস্তিত্ব আছে কি না প্রভৃতি বিষয় সমূহের আলোচনা আছে। কস্সপসীহনাদ সূত্রে মুক্তিলাভের জন্য মধ্যম প্রতিপদ বা আর্য-অষ্টাঙ্গিক মার্গের উপযোগিতার কথা বলা হয়েছে। পোটঠ্পাদ সূত্রে ধ্যান, সমাধির বিবিধ স্তর ও আত্মার অস্তিত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন প্রকার অলৌকিক শক্তির বিবরণ পাওয়া যায় কেবদ্ধ সূত্রে।

আরও পড়ুন:   

গনকমোগ্গলায়ন কে ছিলেন? সংক্ষেপে গনকমোগ্গলায়ন সূত্রের মূল বিষয়বস্তু আলোচনা কর

দীর্ঘনিকায়ের সূত্রের মধ্যে মহাপরিনির্বাণ সূত্র সর্বাপেক্ষা মূল্যবান এবং রচনা বৈশিষ্ট্যে ভিন্ন প্রকৃতির। মহাপরিনির্বাণ পর্যন্ত বুদ্ধের শেষ জীবনের ধারাবাহিক কাহিনী অন্য কোন প্রাচীন সূত্রে লিপিবদ্ধ নেই। যদিও এতে বুদ্ধের ধর্মের কোন তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা নেই, তথাপি ভিক্ষুদের প্রতি বুদ্ধের শেষ বানী বা উপদেশ এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। রাজগৃহ হতে বুদ্ধের শেষ যাত্রা শুরু করে কুশীনগর পৌঁছানো পর্যন্ত বিবরণ হতে প্রাচীন ভারতের পথ ঘাটের ভৌগলিক পরিচয় এই সূত্রে পাওয়া যায়। বুদ্ধের কতকগুলো অতি মূল্যবান উপদেশ এই সূত্রে রয়েছে। তিনি লিচ্ছবিদের প্রতি সাতটি ও ভিক্ষুদের প্রতি সাতটি মঙ্গলবিধায়ক নীতি সম্পর্কে যে উপদেশ দিয়েছেন তা এই সূত্রে বর্ণিত আছে। এই উপদেশগুলো যুগ যুগ ধরে মানুষকে অনুপ্রেরিত করেছে। এছাড়াও বৌদ্ধ ধ্যান ধারণার বিশদ বিবরণ জানার জন্য দীর্ঘনিকায়ের মহাসতিপট্ঠান সূত্র খুবই প্রয়োজনীয়। আদর্শ গৃহস্থদের কর্তব্য সম্বন্ধে নির্দেশ দেয়া হয়েছে সিগালোবাদ সূত্রে। মহিানিদান সূত্রে প্রতীত্যসমুৎপাদ তত্ত্ব বিশদভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং লক্ষণ সূত্রে বুদ্ধের ৩২ প্রকার লক্ষণ বর্ণিত হয়েছে।

এভাবে দীর্ঘনিকায়ের প্রতিটি সূত্রে বুদ্ধের নির্দেশিত ধর্ম দর্শন ও উপদেশাবলী সুন্দর ভাবে আলোকপাত করা হয়েছে। যা বৌদ্ধ সাহিত্যে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।

উপসংহার

উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, দীর্ঘ নিকায়ের প্রতিটি সূত্রে বুদ্ধের উপদেশগুলো দীর্ঘাকারে আলোকপাত করা হয়েছে।মধ্যম ও খুদ্দক নিকায়ের কোন কোন সূত্রে বুদ্ধজীবনের কিছু কিছু প্রামাণ্য ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও দীর্ঘ নিকায় ব্যতীত কোথাও বুদ্ধের ধারাবাহিক জীবনী পাওয়া যায় না।

Related Posts