বাংলাদেশের দারিদ্র্যের কারণ সমূহ
বাংলাদেশের দারিদ্র্য কোন বিশেষ একটি কারণে সৃষ্ট নয়। বরং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপাদানের এক জটিল সংমিশ্রণে দারিদ্র্য বাংলাদেশে বর্তমানে একটি ভয়াবহ সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের কারণ অনুসন্ধানে বহুমুখী নিয়ামক ও উপাদানের সন্ধান পাওয়া যায়। নিচে দারিদ্র্যের সাথে সংশ্লিষ্ট কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান তথা কারণের উপর আলোকপাত করা হয়েছে-
১। সম্পদের সীমাবদ্ধতা ও অতিরিক্ত জনসংখ্যা
আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীর ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর একটি। অথচ জনসংখ্যার দিক থেকে এটি পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম দেশ। মাত্র ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিলোমিটারের এই রাষ্ট্রের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। একদিকে বিপুল জনসংখ্যা, অন্যদিকে সম্পদের সীমাবদ্ধতা এবং দিনে দিনে গড় সম্পদের পরিমাণ কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের দারিদ্র্যের সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে।
২। সম্পদের সুষম বণ্টনের অভাব
গ্রামীণ অঞ্চলে ভূমি মানুষের প্রধান সম্পদ হলেও এই ভূমি মালিকানার ক্ষেত্রে বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। গবেষণা হতে দেখা যায় যে, গ্রামাঞ্চলের ৭০ ভাগ জমির মালিক হলো ১০% কৃষক। বাকি কৃষকের হাতে রয়েছে মাত্র ৩০% জমি । অন্যদিকে শহরাঞ্চলের দিকে দৃষ্টি দিলেও দেখা যাবে যে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধার উপর সমাজের মুষ্টিমেয় একটি অংশের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। শহর ও গ্রাম উভয় অঞ্চলেই সম্পদের অসম বণ্টনের কারণে কতিপয় মানুষ আর্থিক ও সামাজিক দিক থেকে লাভবান হলেও বাকি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অবস্থা দিনের পর দিন খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছে।
৩। স্বাস্থ্য ও পুষ্টিহীনতা
এদেশের মোট জনসংখ্যার ৭৫% কোন না কোনভাবে স্বাস্থ্যহীনতা ও পুষ্টিহীনতার শিকার। ব্যক্তির স্বাস্থ্যহীনতা কর্মে অনীহা সৃষ্টি করে। অন্যদিকে, পুষ্টিহীনতা দক্ষ শ্রমিক গড়ে তোলার অন্তরায়। এদেশের শ্রমিকরা সামান্য পরিশ্রমেই ক্লান্ত হয়ে যায়, যা দরিদ্রতা বৃদ্ধির লক্ষণ ।
অন্যান্য লেখা:
দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র কি? – ব্যাখ্যা কর
দারিদ্র্য কাকে বলে? দারিদ্র্যের প্রকারভেদ আলোচনা কর।
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ঘাটতির কারণ গুলো কি কি?
৪। ধর্মীয় কুসংস্কার
ধর্ম ও সামাজিক বিধি-নিষেধের বেড়াজালে এদেশের মানুষের জীবনযাত্রা অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রিত হয়। ব্রিটিশ আমলে এদেশে মুসলমানেরা ধর্মীয় কারণে ইংরেজি শিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে এবং পরবর্তীতে তাদেরকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক নানা সুযোগ-সুবিধা হতে বঞ্চিত হতে হয়। আবার আমাদের দেশে ধর্মীয় ও সামাজিক বিধি- নিষেধ ও কুসংস্কারের কারণে ঘরের বাইরে নারীদের কর্মের সুযোগ প্রদান করা হয় নি। এতে করে দেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠীই নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয় যা দারিদ্র্যাবস্থাকে ত্বরান্বিত করেছে।
৫। প্রাকৃতিক দুর্যোগ
বহিঃবিশ্বে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ হিসেবেই পরিচিত। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, খরা, নদী ভাঙন, প্রভৃতি হলো বাংলাদেশের সবচাইতে সাধারণ অথচ ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রতিবছর এ সকল দুর্যোগের কারণে শত শত কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং এতে করে বিপুল সংখ্যক মানুষ গৃহহীন, সহায় সম্বলহীন এবং কর্মহীন হয়ে দারিদ্রাবস্থায় নিপতিত হয়।
৬। ঐতিহাসিক কারণ
ইতিহাস বিশ্লেষণেও এদেশের দারিদ্র্যের প্রেক্ষাপট খুঁজে পাওয়া যায়। বাংলাদেশসহ অতীতে ভারতীয় উপমহাদেশের রূপ, সৌন্দর্য ও সম্পদের মোহে বহু বিদেশি দস্যুরা এদেশে এসে সম্পদ লুণ্ঠন করেছে। পরবর্তীতে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলেও এ অঞ্চলের সম্পদ পাচার হয়েছে। অর্থাৎ ঐতিহাসিকভাবেই আমাদের এদেশে দারিদ্র্যের প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছে।
৭। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা
১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মাধ্যমে এদেশ স্বাধীন হয় । যুদ্ধকালীন সময়ে নষ্ট হয় হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ। কিন্তু যুদ্ধপরবর্তী রাজনৈতিক অবস্থার চিত্রটিও সুখকর নয়। হত্যা, অবৈধ ক্ষমতা দখল, সামরিক শাসন প্রভৃতি হলো যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতির সাধারণ চিত্র। এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতিতে হরতাল, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি বিষয়গুলো ব্যাপক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে করে দেশের শিল্প ও ব্যবসায় বাণিজ্যের এবং ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতিসাধন হচ্ছে। মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহের পথ হারাচ্ছে এবং তারা দারিদ্র্যের মধ্যে নিপতিত হচ্ছে।
৮। ঔপনিবেশিক শোষণ
বাংলাদেশের দরিদ্রতার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে দীর্ঘদিনের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শোষণকে দায়ী করা হয়। ব্রিটিশরা ২০০ বছরে এদেশে উন্নয়নের প্রাথমিক ভীত পর্যন্ত রচনা করে নি উল্টো বিপুল পরিমাণ সম্পদ নিজ দেশে পাচার করেছে। এরই বিষফল তথা দারিদ্র্যতার অভিশাপ এদেশের মানুষকে এখনও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। ৯।
৯। পাকিস্তানের শোষণ
বাংলাদেশের দারিদ্র্যতার জন্য দীর্ঘ ২৫ বছরের পাকিস্তানি শাসন বা শোষণ বহুলাংশে দায়ী। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার এদেশের (তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে) উন্নয়নে কোনরূপ কার্যকর ব্যবস্থা নেয় নি। এর বিপরীতে এদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ পশ্চিম-পাকিস্তানে পাচার করা হয়। এর ফলে এদেশের মানুষ দারিদ্র্যের বেড়াজালে আটকা পড়ে। ১০
১০। স্বাধীনতা যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে এদেশের অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ, রেলওয়ে, নৌবন্দর, সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর ইত্যাদির প্রভূত ক্ষতি সাধিত হয়। এখনও এ ক্ষতির দায় বহন করতে হচ্ছে। এজন্য বাংলাদেশ এখনও দারিদ্র্য্য কাটিয়ে উঠতে পারে নি।
১১। অনুন্নত কৃষি ব্যবস্থা
কৃষিপ্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা অনুন্নত। প্রাচীন চাষ পদ্ধতি, নে ব্যবস্থার অভাব, উত্তম বীজ ও সারের অভাব প্রভৃতি বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের কৃষির উৎপাদন ক্ষমতা অত্যন্ত কম। কৃষি নিম্ন উৎপাদনশীলতা বাংলাদেশের জনসাধারণের বিশেষ করে কৃষকদের দারিদ্র্যের অন্যতম প্রধান কারণ।
১২। শিল্পে পশ্চাৎপদতা
বাংলাদেশের দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ হলো শিল্পে অনগ্রসরতা। ব্যাপক শিল্পায়ন ছাড়া বর্তমানে কোনো দেশের পক্ষেই দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জনগণের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি ঘটানো সম্ভব না। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পূর্বে সাবেক পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের শিল্পায়নের গতি ছিল মন্থর। স্বাধীনতা লাভের পরও বাংলাদেশ শিল্পক্ষেত্রে আশানুরূপ অগ্রগতি অর্জন করতে পারে নি। বাংলাদেশের জিডিপিতে শিল্পের অবদান তুলনামূলকভাবে কম। শিল্পে পশ্চাৎপদতা বাংলাদেশের দারিদ্র্যের জন্য বিশেষভাবে দায়ী।
১৩। প্রাকৃতিক সম্পদের অপূর্ণ ব্যবহার
বাংলাদেশের দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ হলো প্রাকৃতিক সম্পদের অপূর্ণ ব্যবহার। বাংলাদেশে যথেষ্ট প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। কিন্তু মূলধনের স্বল্পতা, কারিগরি জ্ঞান ও উদ্যোক্তার অভাবে এসব প্রাকৃতিক সম্পদ পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব হয় না। ফলে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ দরিদ্র রয়ে গেছে।
১৪। মূলধনের অভাব
বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় কম হওয়ায় তাদের সঞ্চয়ের ক্ষমতাও কম। সঞ্চয়ের অভাবে দেশে প্রয়োজনীয় মূলধন সৃষ্টি হচ্ছে না। মূলধনের অভাবে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও জনশক্তিকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এটি বাংলাদেশের দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ।
১৫। শিক্ষার অভাব
বাংলাদেশের দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ হলো শিক্ষার অভাব। বাংলাদেশের অধিকাংশ লোক অশিক্ষিত ও নিরক্ষর। শিক্ষার অভাবে বাংলাদেশে মানব সম্পদের উন্নয়ন ঘটছে না। শ্রমিকদের অদক্ষতা ও নিম্ন উৎপাদনশীলতা বাংলাদেশে দারিদ্র্যের জন্য অনেকাংশে দায়ী।
১৬। কারিগরি জ্ঞানের অভাব
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা ও দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ হলো কারিগরি জ্ঞানের অভাব। বাংলাদেশের অধিকাংশ লোক অশিক্ষিত। উন্নত উৎপাদনের উন্নত কলাকৌশল ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের অভাবে কল-কারখানায় উৎপাদন বাড়ছে না। ফলে জনগণ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করতে বাধ্য হচ্ছে।
১৭। দক্ষ উদ্যোক্তার অভাব
বাংলাদেশে দক্ষ উদ্যোক্তা বা সংগঠকের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। পুঁজি বিনিয়োগ করে ঝুঁকি গ্রহণের মতো সংগঠকের সংখ্যা বাংলাদেশে খুব কম। দক্ষ ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সংগঠকের স্বল্পতা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা ও দারিদ্র্যের জন্য বিশেষভাবে দায়ী।
১৮। বেকার সমস্যা
বাংলাদেশে বেকার সমস্যা অত্যন্ত প্রকট। দেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় এক তৃতীয়াংশই হলো বেকার । জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে সে হারে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না হওয়ায় বেকার সমস্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ বেকার জনগোষ্ঠী জীবনধারণের জন্য অন্যের আয়ের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় দেশে দারিদ্র্য আরও ঘনীভূত হচ্ছে।
১৯। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি
বাংলাদেশে দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ হলো দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে জনগণের মাথাপিছু প্রকৃত আয় হ্রাস পাচ্ছে এবং জীবনযাত্রার মান ক্রমশ নিম্নমুখী হচ্ছে।
২০। অনুন্নত অবকাঠামো
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো খুবই অনুন্নত ও দুর্বল। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন হলো উন্নত আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো । কিন্তু বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো খুবই অনুন্নত। উন্নত রাস্তাঘাট, রেলপথ, সেচ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য সেবা প্রভৃতির অভাবে বাংলাদেশের দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে । ফলে জনগণের দারিদ্র্য পরিস্থিতির কোনো উন্নতি ঘটছে না।
২১। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি
বাংলাদেশের দারিদ্র্যের অন্যতম প্রধান কারণ হলো দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি। বাংলাদেশে জনসংখ্যা সুবিধা বৃদ্ধি পাচ্ছে না। এর ফলে বাংলাদেশের জনগণ আরও দরিদ্র হয়ে পড়ছে। সুযোগ-
২২। ব্যাপক দুর্নীতি
বাংলাদেশের দারিদ্র্যের অন্যতম প্রধান কারণ হলো সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিরাজমান দুর্নীতি। দরবারে বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই ‘একটি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। প্রশাসনসহ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতি প্রকট আকার ধারণ করেছে। দুর্নীতির কারণে সম্পদের অপচয় ঘটছে এবং উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রার মান ক্রমশ নিম্নমুখী হচ্ছে।