Home » রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা কর
রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য

রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা কর

by TRI

Table of Contents

রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য

রাষ্ট্র ও সরকার দুটি ভিন্ন প্রত্যয়। মৌলিক অর্থে উভয়ের মধ্যে বিরাট পার্থক্য বিদ্যমান। চুক্তিবাদী দার্শনিক জন লক (John Locke) সর্বপ্রথম রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করেছেন। চুক্তিবাদী দার্শনিক রুশো (Rousseau) তাঁর “The social contract” শীর্ষক গ্রন্থে রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করেছেন। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ডানিং (Dunning), “State denotes the community as a whole-created by the social pact and manifesting itself in the supreme general will, ‘Government’ denotes merely the individual or group of individuals that is designed by the community to carry into effect the sovereign will.” (Dunning- Political theories from Rousseau to Spencer, p. 29 )

নিম্নে রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা করা হলো:

১. ধারণাগত পার্থক্য

রাষ্ট্র ও সরকার ধারণাগতভাবে দুটি পৃথক প্রতিষ্ঠান। অধ্যাপক গার্নার রাষ্ট্রের সংজ্ঞায় বলেন, “রাষ্ট্র হলো কম বা বেশি সংখ্যক লোকের দ্বারা গঠিত এমন এক জনসমষ্টি, যারা একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস করে, যারা বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে স্বাধীন বা প্রায় স্বাধীন এবং যার একটি সুসংগঠিত সরকার আছে যার প্রতি অধিকাংশ অধিবাসী স্বভাবজাত আনুগত্য স্বীকার করে।” অপরদিকে অধ্যাপক গার্নার (Garner) সরকারের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেন, “সরকার হলো একটি কার্যনির্বাহী মাধ্যম বা যন্ত্র যার মাধ্যমে সরকারের সাধারণ নীতি নির্ধারিত হয় এবং যার দ্বারা সাধারণ কাজ-কর্ম নিয়ন্ত্রিত হয় এবং সাধারণ স্বার্থ সাধিত হয়।”

২.রাষ্ট্র সমগ্র কিন্তু সরকার তার একটি উপাদান

জনসমষ্টি, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, সরকার ও সার্বভৌমত্ব চারটি উপাদানের সমন্বয়ে রাষ্ট্র গঠিত হয়। কিন্তু সরকার হলো রাষ্ট্র গঠনের অন্যতম উপাদান। কাজেই দেখা যায়, রাষ্ট্র হলো একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠান। আর সরকার হলো রাষ্ট্রের একটি অংশ।

৩. সমগ্র জনগণ নিয়ে রাষ্ট্র গঠিত কিন্তু সরকার কিছু সংখ্যক জনগণ নিয়ে গঠিত

রাষ্ট্র গঠিত হয় একটি ভূখণ্ডের অন্তর্গত সমগ্র জনসমষ্টিকে নিয়ে। কিন্তু সরকার গঠিত হয় কেবল আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের কাজে জড়িত ব্যক্তিবর্গ নিয়ে। অন্যভাবে বলা যায়, শাসক ও শাসিত এ দু’শ্রেণির জনসমষ্টি নিয়ে রাষ্ট্র গঠিত। কিন্তু কেবল শাসকদের নিয়ে সরকার গঠিত

৪. রাষ্ট্র স্থায়ী আর সরকার পরিবর্তনশীল

রাষ্ট্র কম-বেশি একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান। আর সরকার নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগ করে সরকারের পরিবর্তন ঘটায়। একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিপ্লব বা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারের পরিবর্তন ঘটে। সরকারের পরিবর্তন হলেও রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব অটুট থাকে।

৫. রাষ্ট্র বিমূর্ত ধারণা কিন্তু সরকার মূর্ত ধারণা

রাষ্ট্র হলো একটি বিমূর্ত ধারণা। রাষ্ট্রকে দেখা যায় না বা স্পর্শ করা যায় না, তবে ধারণা করা যায়। কিন্তু সরকার একটি মূর্ত ধারণা। যাদের নিয়ে সরকার গঠিত তাদের দেখা যায় এবং বোঝা যায়। মূলত সরকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব অনুধাবন করা যায়।

৬. রাষ্ট্র সার্বভৌমত্বের অধিকারী কিন্তু সরকার নয়

রাষ্ট্র সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী এবং এর ক্ষমতা সীমাহীন। কিন্তু সরকার রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত সীমিত ক্ষমতার মালিক মাত্র। রাষ্ট্রের এ সার্বভৌম ক্ষমতা সরকারের মাধ্যমে প্রয়োগ হয়ে থাকে। রাষ্ট্র আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সরকারের ক্ষমতা হ্রাস-বৃদ্ধি করতে পারে। বস্তুত সার্বভৌম ক্ষমতা ছাড়া রাষ্ট্র গঠন করা যায় না।

৭. রাষ্ট্র একই ধরনের কিন্তু সরকার বিভিন্ন ধরনের

বিশ্বের সকল রাষ্ট্র জনসমষ্টি, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, সরকার ও সার্বভৌমত্ব চারটি একই ধরনের উপাদান নিয়ে গঠিত। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার বিভিন্ন ধরনের। যেমন- গণতান্ত্রিক, একনায়কতান্ত্রিক, এককেন্দ্রিক, যুক্তরাষ্ট্রীয়, সংসদীয় ও রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার প্রভৃতি। সুতরাং বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিভিন্ন ধরনের সরকার দেখা যায়। কিন্তু সকল রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য এক ও অভিন্ন।

৮. রাষ্ট্র ভৌগোলিক প্রতিষ্ঠান, কিন্তু সরকার নয়

রাষ্ট্র একটি ভৌগোলিক প্রতিষ্ঠান। এটি একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড নিয়ে গঠিত যার ভৌগোলিক সীমানা রয়েছে। কিন্তু সরকারের সাথে ভৌগোলিক সীমারেখার কোনো রকম সম্পর্ক নেই। সরকার নিজস্ব ভূখণ্ড ছাড়া চলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ ১৯৭১ সালে ভারতে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছিল। এ সরকার ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করে।

আরও পড়ুন:   রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে পার্থক্য কি কি?

৯. রাষ্ট্র অধিকারের উৎস কিন্তু সরকার নয়

রাষ্ট্র জনগণের সকল আইন ও অধিকারের উৎস। অধ্যাপক বার্কার (Barker) বলেন, “অধিকার হলো ব্যক্তির সর্বোত্তম ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযোগী সেই সকল প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা যেগুলো রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত হয়।” এক কথায় রাষ্ট্র কর্তৃক নাগরিকদের সকল অধিকার স্বীকৃত ও সংরক্ষিত হয়। অপরদিকে সরকার রাষ্ট্র কর্তৃক সৃষ্ট অধিকারের রক্ষকমাত্র এবং প্রয়োজনে অধিকারে হস্তক্ষেপ করে।

১০. রাষ্ট্রের বিরোধিতা করা যায় না, কিন্তু সরকারের বিরোধিতা করা যায়

রাষ্ট্রের সমালোচনা করা অথবা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কাজ করা যায় না। কেউ এমনটি করলে সে রাষ্ট্রদ্রোহী হবে। পক্ষান্তরে সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করা এবং তার কাজ-কর্মের বিরোধিতা করা যায়।

১১. রাষ্ট্র মৌলিক প্রতিষ্ঠান কিন্তু সরকার তার সংগঠন

রাষ্ট্র হলো একটি মৌলিক প্রতিষ্ঠান, আর সরকার হলো রাষ্ট্রের একটি সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানমাত্র। বস্তুত সরকার রাষ্ট্রের পরিচালক।

১২. জনসাধারণ রাষ্ট্রের নাগরিক কিন্তু সরকারের নয়

পূর্ণ বয়স্ক সকল জনগণ রাষ্ট্রের নাগরিক। কিন্তু সরকারের নয়। একটি রাষ্ট্রে সরকারি দল ও বিরোধী দলের অস্তিত্ব থাকলেও সবাই মিলে রাষ্ট্রের নাগরিক।

১৩. রাষ্ট্র জীবদেহ, আর সরকার তার মস্তিষ্ক

রাষ্ট্র হলো একটি জীবদেহ আর সরকার হলো তার মস্তিষ্ক। অধ্যাপক গার্নার (Garner) বলেন, “রাষ্ট্র যদি হয় জীবদেহ তবে সরকার হলো এর মস্তিষ্কস্বরূপ।” জীবদেহ যেমন মস্তিষ্কের নির্দেশে
পরিচালিত হয়, রাষ্ট্রও তেমনি সরকারের নির্দেশে পরিচালিত হয়।

১৪. রাষ্ট্রের সদস্যপদ বাধ্যতামূলক, কিন্তু সরকারের পদ বাধ্যতামূলক নয়

প্রত্যেক ব্যক্তিকে নাগরিকতার বিভিন্ন সূত্রে রাষ্ট্রের সদস্য পদ গ্রহণ করতে হয়। রাষ্ট্রের সদস্য হওয়া বাধ্যতামূলক, অপরদিকে সরকারের সদস্য হওয়া বাধ্যতামূলক নয় । সকল নাগরিক সরকারের সদস্য হতে পারে না।

১৫. অভিযোগ আনয়নের ক্ষেত্রে পার্থক্য

রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অভিযোগ উত্থাপন করা যায় না। কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনয়ন করা যায়। অধিকার হরণের বিরুদ্ধে প্রত্যেক নাগরিক সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে

১৬. সংবিধানের অস্তিত্বের ক্ষেত্রে পার্থক্য

প্রত্যেক রাষ্ট্রেরই এর নিজস্ব সংবিধান রয়েছে। সংবিধান হলো রাষ্ট্রের দর্পণ বা প্রতিচ্ছবি; পক্ষান্তরে, সরকারের পৃথক কোনো সংবিধান নেই। সংবিধানে সন্নিবেশিত বিধি-বিধান অনুযায়ী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করে থাকে।

১৭. নির্ভরশীলতার ক্ষেত্রে পার্থক্য

রাষ্ট্র কখনো সরকারের উপর নির্ভরশীল নয়। কিন্তু সরকার রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ব্যতীত সরকারের কথা কল্পনাও করা যায় না।

পরিশেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে উপর্যুক্ত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। রাষ্ট্র ছাড়া সরকারের অস্তিত্ব অর্থহীন। আর সরকার ছাড়া রাষ্ট্রের অস্তিত্বের কথা ভাবা যায় না। রাষ্ট্রের উন্নতি-অবনতি, সাফল্য- ব্যর্থতা প্রভৃতি সকল কিছু নির্ভর করে সরকারের দক্ষতা ও কর্মকুশলতার উপর। অধ্যাপক লাস্কি (Laski) যথার্থই বলেছেন, “কার্যত প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ থেকে সরকারই রাষ্ট্র। ” (For the purpose of practical administration. the state is nothing but government.)

Related Posts