পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রচিন্তা (Western Political Thought)
গ্রিক, রোম, ইতালি ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশসমূহের রাষ্ট্রচিন্তাকে পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রচিন্তা বলা হয়। পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তাকে ইউরোপীয় রাষ্ট্রচিন্তা (European Political Thought) নামেও অভিহিত করা হয়। প্রাচীনকাল থেকেই পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার উদ্ভব। গ্রিক সভ্যতা ও নগররাষ্ট্রের উদ্ভবের মধ্যদিয়ে পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার উৎপত্তি হয়েছে বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ অভিমত পোষণ করেছেন। আলোচনা ও অধ্যয়নের সুবিধার্থে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তাকে তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন। এগুলো হলো : ক. প্রাচীন যুগ (Ancient Age)
খ. মধ্যযুগ (Mediaeval Age )
গ. আধুনিক যুগ (Modern Age)
নিম্নে এ তিনটি যুগের বর্ণনা করা হলো-
ক. প্রাচীন যুগ (Ancient Age)
পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রচিন্তা এর ইতিহাসে প্রাচীন যুগ একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৯ হতে খ্রিস্টপূর্ব ২৬ অব্দ পর্যন্ত প্রাচীন যুগের পরিব্যাপ্তি। এ সময়ে গ্রিক, রোমসহ ইউরোপীয় অনেক দেশে রাষ্ট্রচিন্তার উৎপত্তি ঘটে। তবে গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তাকে (Greek Political Thought) রাষ্ট্রচিন্তার সূতিকাগার (Birthplace) বলে অভিহিত করা হয়। সে সময়ে গ্রিক চিন্তাবিদদের রাজনৈতিক চিন্তা–চেতনার দ্বারা অন্যান্য দেশের চিন্তাবিদ এর রাজনৈতিক চিন্তা প্রভাবিত হয়েছে। অধ্যাপক বার্কার (Prof. Ernest Barker) বলেন, গ্রিকদের মাধ্যমেই রাষ্ট্রচিন্তার সূচনা ও সমৃদ্ধি ঘটে।“
আরও পড়ুন: রাষ্ট্রচিন্তা কি? রাষ্ট্রচিন্তায় এরিস্টটলের অবদান
গ্রিক সভ্যতার ছোঁয়া সমসাময়িককালীন অনেক দেশেই পরিলক্ষিত হয়। দিকে দিকে গ্রিস সভ্যতার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। দূর–দূরান্ত থেকে মানুষ জ্ঞানার্জনের জন্য গ্রিসের শান্ত সুনিবিড় পরিবেশে আসতেন এবং গ্রিক পণ্ডিতদের সাহচর্য লাভ করে নিজেদের সমৃদ্ধ করার প্রয়াস পেতেন। তাছাড়া গ্রিসের নগররাষ্ট্রের (City State) ধারণা তৎকালীন রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রকে আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে তুলেছিল। নগররাষ্ট্রের বিভিন্ন সংগঠন কেন্দ্রিক কর্মকাণ্ড রাষ্ট্রচিন্তার যাত্রাকে সুসংহত করে তুলেছিল। গ্রিক পণ্ডিতদের মধ্যে রাষ্ট্রচিন্তায় যারা অসামান্য অবদান রেখেছেন, তারা হলেন সক্রেটিস (Socrates), প্লেটো (Plato), এরিস্টটল ( Aristotle) প্রমুখ। গ্রিসের এসব জ্ঞানীদের পদচারণায় প্রাচীনযুগের রাষ্ট্রচিন্তা পূর্ণ মাত্রায় বিকশিত হয়েছিল।
খ. মধ্যযুগ (Mediaeval Age)
পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রচিন্তা র ইতিহাসে মধ্যযুগ একটি আলাদা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এ যুগকে অন্ধকার যুগ (Age of ignorance) বলে অভিহিত করা হয়। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস (Socrates), প্লেটো (Plato), এরিস্টটল (Aristotle) প্রমুখের পর প্রাচীন যুগে আর কোনো উল্লেখযোগ্য দার্শনিকের আবির্ভাব না ঘটায় প্রাচীন যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে। গ্রিক নগররাষ্ট্রের পতন এবং আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্রের আবির্ভাব অর্থাৎ ম্যাকিয়াভেলীর (Machiavelli) আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কাল রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে মধ্যযুগ (Mediaeval Age) হিসেবে খ্যাত। এ সুদীর্ঘ সময়ে ন্যায়নীতির অবসান এবং ধর্মীয় রাজনীতি প্রবর্তিত হবার ফলে রাষ্ট্রচিন্তায় স্থবির অবস্থা বিরাজ করে। তাছাড়া এ সময়ে “জোর যার মুল্লুক তার” (Might is right) নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজনীতি ধর্মীয় যাঁতাকলে আবর্তিত হবার ফলে রাষ্ট্রচিন্তা প্রসারের পরিবর্তে সংকুচিত হয়।
মধ্যযুগের রাজনীতিতে কতিপয় বৈশিষ্ট্য ছিল লক্ষণীয়। এ সময়ে গির্জা ও রাষ্ট্রের মধ্যে সংঘাত, রাষ্ট্রতত্ত্বের অনুপস্থিতি, পোপতন্ত্র, সামন্তবাদ, বিশ্বজনীনতাবাদ এবং ধর্মীয় আধিপত্যবাদ সুস্পষ্ট রূপ লাভ করে। মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে ডব্লিউ. এ. ডানিং (W. A. Dunning) এর একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, “The Middle age was unpolitical, aspirations and ideals centred about the form and content and religious belief.” এছাড়াও মধ্যযুগে যেসব দার্শনিক রাষ্ট্রচিন্তায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন তারা হলেন সেন্ট অগাস্টিন (St Augustine), সেন্ট টমাস একুইনাস (St. Thomas Acquinas), এলিমেয়েরী দান্তে (Dante), এবং মার্সিলিও অব পানুয়া (Marsilio of Padua) প্রমুখ।
গ. আধুনিক যুগ (Modem Age)
রাষ্ট্রচিন্তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সময়কাল হলো আধুনিক যুগ। মূলত পঞ্চদশ শতাব্দিতে পরিষদ আন্দোলনের ব্যর্থতার মধ্যদিয়ে আধুনিক যুগের সূত্রপাত হয়। গির্জা ও রাষ্ট্রের সীমিত শাসনের ফলে পরিষদ আন্দোলন যে সামান্য উন্নতি ও অগ্রগতি লাভ করে, ষোড়শ শতাব্দির শুরুতে ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রের তীব্র রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া তাকে স্রোতের ন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এসময়ে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সংস্কারমূলক মানা আন্দোলন সূচিত হয়। এ সব আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে মানুষের চিন্তা–চেতনায় আমূল পরিবর্তন দেখা দেয়। ঠিক এমনি সময়ে যুগ পরিবর্তনের আলোকবর্তিকা নিয়ে ম্যাকিয়াভেলীর আবির্ভাব ঘটে এবং তার রাজনৈতিক চিন্তাধারার ফলে রাষ্ট্রের উপর গির্জার প্রভাব সম্পূর্ণরূপে হ্রাস পায়। তার চিন্তাধারা ও লেখনীতে ধর্মভিত্তিক চিন্তাধারার পরিবর্তে ধর্মনিরপেক্ষতার ছাপ পরিলক্ষিত হয়। পোপতন্ত্র ও রাজার ক্ষমতার মধ্যে সুস্পষ্ট বিভক্তি দেখা দেয়। তার এ চেতনা শুধুমাত্র ইতালিতে সীমাবদ্ধ ছিল না, এটি গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল। এটি রেনেসাঁ (Renaissance) বা পুনর্জাগরণ হিসেবে খ্যাত। যেসব দার্শনিকদের চিন্তাচেতনা ও লেখনী মধ্যযুগের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে আধুনিক যুগের সূত্রপাত ঘটান তারা হলেন নিকালো ম্যাকিয়াভেলী (Nicalo Machiavelli), টমাস হবস (Thomas Hobbes), জন লক (John Locke), মন্টেস্কু (Montesquieu), রুশো (Rousseau) প্রমুখ।