আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার জনক
মধ্যযুগের বেড়াজাল ভেঙে যুগ পরিবর্তনের আলোকবর্তিকা নিয়ে ম্যাকেয়াভেলীর আবির্ভাব ঘটে। তার চিন্তাধারা ও লেখনীতে ধর্মভিত্তিক চিন্তাধারার পরিবর্তে ধর্মনিরপেক্ষতার ছাপ পরিলক্ষিত হয়। পোপতন্ত্র ও রাজার ক্ষমতার মধ্যে সুস্পষ্ট বিভক্তি দেখা দেয়। তার এ চেতনা শুধুমাত্র ইতালিতে সীমাবদ্ধ ছিল না, এটি গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল। এটি রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণ হিসেবে খ্যাত। তাই নিকালো ম্যাকিয়াভেলীকে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার জনক বলা হয়।
আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় ম্যাকিয়াভেলীর অবদান
অধ্যাপক ডানিং বলেন, “রাষ্ট্রতত্ত্বের ইতিহাসে ম্যাকিয়াভেলীর প্রভাবকে কদাচিৎ অতিরঞ্জিত করা যায়। তাঁর দর্শনের পদ্ধতি ও বিষয়বস্তুই শুধু নয়, তিনি তাঁর রচনাবলির মধ্যে যে বিস্ময়কর সাহিত্য নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছেন তা তার জন্য চিরস্থায়ী আসন দখল করে রেখেছে। ম্যাকিয়াভেলী এরিস্টোটল বা একুইনাসের মতো একজন উঁচুদরের রাষ্ট্রতত্ত্ববিদ না হলেও তিনি বর্তমান যুগের রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে যে স্থায়ী অবদান রেখে গেছেন তা কোনোদিন বিস্মৃতির অতলে বিলীন হয়ে যাবে না।
প্রথমত, তিনি রাষ্ট্রকে প্রাকৃতিক বা দৈব আইনের আওতা থেকে মুক্ত করে এবং রাষ্ট্রের উপর অন্য কোনো পার্থিব বা অতিপ্রাকৃতিক শক্তি যে থাকতে পারে না তা স্বার্থহীনভাবে ঘোষণা করে মধ্যযুগের সাথে পুরোপুরি সম্পর্কচ্ছেদ করেন এবং আধুনিক চিন্তাধারার সূচনা করেন। এদিক দিয়ে বলতে গেলে তিনি সর্বপ্রথম রাজনীতিকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করেন। রাষ্ট্র যথার্থই একটি স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠান– এরিস্টোটলের এই উক্তিকে তিনিই নতুন করে সপ্রমাণ করেন। রাষ্ট্রনীতিকে নৈতিকতার বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে তার উপরে স্থান দেবার ফলে যৌক্তিকতা বিধান করে, প্রয়োজন কোনো আইন মানে না, প্রভৃতি মারাত্মক প্রতিক্রিয়াগুলোর সূচনা হয়, এবং তার পরোক্ষ ফলশ্রুতি দাঁড়ায় এই যে, আধুনিক যুগের নীতিজ্ঞান বিবর্জিত স্বৈরাচারী একনায়কদের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ কথা স্বীকার না করে পারা যায় না যে, রাষ্ট্রনীতি ও নৈতিকতার এই বিচ্ছেদ রাষ্ট্রতত্ত্বকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর সংগঠিত করার পথ সুগম করে দেয় এবং রাষ্ট্রকে যথার্থই একটি স্বাভাবিক ও পার্থিব প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে। ম্যাকিয়াভেলীর এই বস্তুবাদী মনোভাবই মার্ক্সের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের (Dialectical Materialism) পথকেও সুগম করে দেয়।
আরও পড়ুন: রাষ্ট্র কি বা কাকে বলে?
সুতরাং ধর্ম ও নৈতিকতার সাথে রাষ্ট্রনীতির বিচ্ছেদ সাধন করে মূল্যবোধের রাজ্যে (In the realm of values) কিছুটা অরাজকতার সৃষ্টি করলেও সার্বিক বিবেচনায় তিনি এর দ্বারা মানব জাতির কল্যাণই সাধন করেছেন। এর দ্বারা তিনি রাষ্ট্রচিন্তার জগতে মুক্ত ও বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করেছেন এবং তার এই দৃষ্টিভঙ্গিকে কেন্দ্র করেই উত্তরকালে হবস, লক, কেন্দ্রাম প্রমুখ রাষ্ট্রচিন্তার শীর্ষস্থানীয় নায়কগণ তাদের দর্শনের বুনিয়াদ গড়ে তুলেছেন।
রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে ম্যাকিয়াভেলী যে স্থায়ী আসন লাভ করেছেন তার আরও একটি বড় কারণ হলো এই যে, তিনিই জাতীয় রাষ্ট্রের প্রথম প্রবক্তা। প্রাচীন যুগ যেমন ছিল নাগররাষ্ট্রের (City-state) ফুল এবং মধ্যযুগ বিশ্বজনীন সাম্রাজ্যের (Universal empire) যুগ, তেমনি বর্তমান যুগ হলো জাতীয় রাষ্ট্রের (Nation-state) যুগ। সুতরাং জাতীয় রাষ্ট্রতত্ত্বের জনক হিসেবে আমরা ম্যাকিয়াভেলীকে একজন যুগস্রষ্টা (Epoch-making) চিন্তাবিদ বলেও আখ্যায়িত করতে পারি।
উপসংহারে আমরা বলতে পারি যে, ম্যাকিয়াভেলীকে “ম্যাকিয়াভেলীবাদের” জন্মদাতা হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁকে শুধু ‘ব্ল্যাকমেইল‘ (Blackmail) করারই চেষ্টা করা হয়েছে। তাঁর চিন্তাধারার মধ্যে যে আরও বহু মূল্যবান সম্পদ লুকিয়ে আছে তার উপর মোটেই কোনো গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি। কারণ এ কথা অনস্বীকার্য যে, ষোড়শ শতাব্দীতে যদি ম্যাকিয়াভেলীর আবির্ভাব না হতো তাহলে হয়তো আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার জন্ম আরও দীর্ঘদিন বিলম্বিত হয়ে যেত। রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে ম্যাকিয়াভেলীর মূল্য নির্ধারণ করতে গিয়ে ডব্লিউ. টি. জোনস বলেন, “রাষ্ট্রকে শুধু যে মানুষের লোভ ও ক্ষুধার প্রেক্ষিতে বোঝা যায়, ম্যাকিয়াভেলীর এই অন্তর্দৃষ্টি এবং লোভ ও ক্ষুধার এই শক্তি কী করে দমন করতে হয় একজন সফল শাসকের তা অবশ্যই জানা প্রয়োজন, ম্যাকিয়াভেলীর এই পরবর্তী স্বীকৃতি, রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে এক নবযুগের সূচনা করে এবং তা আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার সার্বিক বিকাশের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
আরও পড়ুন: আধুনিক রাষ্ট্রের কার্যাবলী