দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা
দেওয়ানি সনদের নামে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার সম্পদ লুণ্ঠনের একচেটিয়া ক্ষমতা লাভ করে। দেওয়ানি লাভ করে ক্লাইভ বাংলায় দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। দ্বৈত শাসনের অর্থ হলো বাংলার শাসনব্যবস্থাকে দুটি পৃথক কর্তৃপক্ষের হাতে ন্যস্ত করা। অভিনব এ পদ্ধতিতে দেওয়ানি ও দেশরক্ষার ব্যবস্থা থাকে কোম্পানির হাতে এবং বিচার ও শাসনভার থাকে নবাবের হাতে। এ অবস্থায় নবাব পেলেন ক্ষমতাহীন দায়িত্ব আর কোম্পানি পেল দায়িত্বহীন ক্ষমতা। সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হলেও কোম্পানি এ কার্যভার স্বহস্তে গ্রহণ না করে দেশীয় কর্মচারীদের উপর ন্যস্ত করল।
দ্বৈত শাসন প্রবর্তনের পশ্চাতে ক্লাইভের কয়েকটি উদ্দেশ্য ছিল। প্রথমত, দেশীয় শাসকদের অকার্যকর করে তাদের বিরুদ্ধে জনরোষ সৃষ্টি করা। দ্বিতীয়ত, কোম্পানি শাসনের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি এবং সুকৌশলে বাংলার রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করা। এ উদ্দেশ্যে তিনি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজা খানকে বাংলার এবং সেতাব রায়কে বিহারের নায়েবে নাজিম নিযুক্ত করে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দেন। মূলত তারা নবাবের অধীন হলেও কোম্পানি তাঁবেদার হিসেবে হুকুম পালন করতেন। ফলে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে অরাজকতা সৃষ্টি হয়।
দ্বৈত শাসন চালুর সাথে সাথে রাজস্ব আদায় ক্ষমতা কার্যকর করার জন্য সেনাবাহিনী নিয়োগের ক্ষমতা কোম্পানির হাতে চলে যায়। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ভার নবাবের হাতে থাকায় প্রয়োজনীয় অর্থের জন্য নবাবকে কোম্পানির দ্বারস্থ হতে হয়। পার্সিভ্যাল স্পিয়ার এই ব্যবস্থাকে দ্বৈতশাসন না বলে ‘পরোক্ষ’ শাসন নামে অভিহিত করেছেন।
আরও পড়ুন: মধ্যযুগে বাংলার ইতিহাসের উৎস বা উপাদানসমূহ কি কি?
দ্বৈত শাসনের ফলাফল ও গুরুত্ব
ভারতে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠায় দ্বৈত শাসন ভূমিকা রাখলেও তা এ দেশের আর্থ-সামাজিক স্থিতি, শান্তি ও সমৃদ্ধি ধ্বংস করে দেয়। দ্বৈতশাসনের গুরুত্ব ও ফলাফল নিম্নরূপ-
প্রথমত, নবাবের হাতে শাসনের দায়িত্ব থাকলেও তার কোনো ক্ষমতা ছিল না। অন্যদিকে কোম্পানির ক্ষমতা থাকলেও দায়িত্ব ছিল না। ফলে দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়। ডাকাতরা গ্রামবাংলায় লুটপাট চালালে গ্রামগুলো জনশূন্য হয়ে পড়ে।
দ্বিতীয়ত, বাংলায় দ্বৈতশাসনের ফলে ‘আমিলদারি’ প্রথার উদ্ভব হয়। বিভিন্ন জেলার জমিদারগণ ‘আমিলদারদের’ নিকট রাজস্ব জমা দিতেন। যে জমিদার যত বেশি রাজস্ব দিতে পারতেন, আমিলদাররা তাদেরই রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দিতেন। ফলে জমিদারগণ ইজারাদারে পরিণত হন। বাংলার মানুষ হতদরিদ্র ও অসহায় হয়ে পড়ে।
তৃতীয়ত, বাংলার স্বাধীন নবাবি আমলে বিভিন্ন বিদেশি ব্যবসায়ী এ দেশের পণ্য কিনতেন। কিন্তু ইংরেজদের একচেটিয়া প্রাধান্যে দেশি ও অন্য বিদেশি ব্যবসায়ীরা বাণিজ্যে লোকসানের সম্মুখীন হন এবং দেশের রপ্তানি আয় সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে যায়।
চতুর্থত, কোম্পানির কর্মচারী গোমস্তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসায় ও শোষণের ফলে দেশের সম্পদ কমতে থাকে এবং পর্যায়ক্রমে ইংল্যান্ডে পাচার হতে থাকে। এক হিসাবে এ তথ্য প্রকাশ পায় যে, একমাত্র ১৭৬৮ খ্রিষ্টাব্দেই বাংলা থেকে ৫.৭ মিলিয়ন পাউন্ড ইংল্যান্ডে চলে যায়। অথচ রাজস্বের হার প্রতিবছর বাড়তে থাকে। যেমন- পূর্ণিয়া জেলার বার্ষিক রাজস্ব চার লাখ থেকে পঁচিশ লাখ টাকায় উন্নীত হয়। অনুরূপভাবে দিনাজপুর জেলার রাজস্ব বারো লাখ টাকা থেকে সত্তর লাখ টাকায় উন্নীত হয়।
পঞ্চমত, কোম্পানির অস্বাভাবিক রাজস্ব আদায়ে জনগণের অবস্থা চরমে পৌঁছে। এ সময় পর পর দুই বছর অনাবৃষ্টি ও খরার ফলে ১১৭৬ বঙ্গাব্দ, অর্থাৎ ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলায় এক প্রচণ্ড দুর্ভিক্ষ ও মহামারি দেখা দেয়। এক মণ চালের মূল্য এক টাকা থেকে বেড়ে তিন টাকায় দাঁড়ায়। কোম্পানির কর্মচারীরা খোলাবাজারের খাদ্যশস্য বেশি লাভের আশায় মজুদ করে রাখে। ফলে মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ দুর্ভিক্ষে মারা যায়। এমন সময়ও খাজনা মওকুফ করা হয়নি। তা ছাড়া নাজাই প্রথা (অর্থাৎ কোনো একজন রাজস্ব বাকি ফেললে সেই গ্রামের অন্য কৃষকদের সেই রাজস্ব দিতে হতো) ভয়ে বহু কৃষক জমি স্বত্ব ছেড়ে পাইকে পরিণত হয়। এ দুর্ভিক্ষের ক্ষত বাংলায় প্রায় ২০-২৫ বছর পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল।