বিখ্যাত ইংরেজ দার্শনিক জন লক (John Locke) যেসব তত্ত্বের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন তার মধ্যে সম্পত্তি তত্ত্ব অন্যতম। তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “Second Treaties of Civil Government” এর পঞ্চম অধ্যায়ে সম্পত্তি নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে, সকল প্রকার প্রাকৃতিক অধিকারের মধ্যে সম্পত্তির অধিকার সবচেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।
জন লকের সম্পত্তি তত্ত্বের প্রেক্ষাপট
জন লকের সম্পত্তি তত্ত্ব বিচ্ছিন্ন কোন ধারণা নয়। বিশেষ করে যখন মধ্যযুগে সম্পত্তিকে একটা সামাজিক ধারণা বলে মনে করা হতো। সপ্তদশ শতাব্দীতে লক যখন আবির্ভূত হলেন তখন পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীর সামন্ততন্ত্র অবক্ষয়ের মুখে। বাণিজ্যিক পুঁজিবাদের তখন উঠতি অবস্থা। বিশেষ করে ইংল্যান্ডে সম্পত্তির প্রতি জনসাধারণের সংবেদনশীলতা বেশ লক্ষণীয়। রাজশক্তির সাথে জনগণের বিরোধের অন্যতম কারণ ছিল জনসাধারণের উপর রাজার ইচ্ছামতো কর চাপানো। আর জনসাধারণ কর দাতাদের সম্মতি ব্যতিরেকে কর স্থাপনকে সংবিধান বিরোধী বলে মনে করতো। এমন পরিস্থিতিতে জন লক তার সম্পত্তি তত্ত্বের অবতারণা করেন।
সম্পত্তি সম্পর্কে লকের ধারণা
জন লক তাঁর “Two Treaties on Civil Government” গ্রন্থে সম্পত্তিকে দ্বিবিধ অর্থে ব্যবহার করেছেন। ব্যাপক অর্থে সম্পত্তি বলতে তিনি মানুষের জীবন, স্বাধীনতা ও বৈষয়িক সম্পদকে বুঝিয়েছেন। আবার সংকীর্ণ অর্থে সম্পত্তি বলতে শুধু বৈষয়িক সম্পদকে বুঝিয়েছেন। তবে জন লক শব্দটিকে প্রধানত ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। এর ফলে তার নিকট থেকে আমরা যে সম্পত্তি তত্ত্ব পাই তা নিছক একটি অর্থনৈতিক মতবাদ নয়। এ তত্ত্বের মধ্যে মানুষের জীবন, স্বাধীনতা, পার্থিব সুখশান্তির সমগ্র বিষয় পরিব্যপ্ত।
আরও পড়ুন: টমাস হবসের সামাজিক চুক্তি মতবাদটি ব্যাখ্যা কর
সম্পত্তির যুক্তিভিত্তিক ব্যাখ্যা
জন লকই সর্বপ্রথম ব্যক্তিগত সম্পত্তির একটি যুক্তিভিত্তিক ব্যাখ্যা প্রদানের চেষ্ট করেন। তাঁর মতে, প্রকৃতির রাজ্যে মানুষের প্রাকৃতিক অধিকার ছিল। সম্পত্তিগত অধিকার মানুষের প্রকৃতিগত অধিকার। কারণ প্রত্যেক মানুষের আশ্রয় গ্রহণের অধিকার ছিল।
লক মনে করেন, সম্পত্তির উপর অধিকার থাকলে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই জমি চাষাবাদ করে ফসল ফলাবে। তিনি কৃষি অর্থনীতির উপর অধিকতর জোর দেন। তাঁর মতে, উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে সমাজের প্রতিটি মানুষের কল্যাণ ও জীবনধারণের মান উন্নত হবে।
লক আদিম সমাজকে প্রাকৃতিক রাজ্য হিসেবে বর্ণনা করলেও তাঁর মতে সেখান থেকেই সম্পত্তির সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, “Property is without any compact of all the commonness.” অর্থাৎ, সম্পত্তি কোন প্রকার চুক্তি ছাড়াই জনগণের অধিকারভুক্ত। দৈহিক শক্তির মতই এ অধিকার ব্যক্তি তার ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে সমাজে আনয়ন করতে পারে।
ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার
ব্যক্তিগত সম্পত্তির উপর জন লক বেশ জোর দিয়েছেন। কারণ, ব্যক্তিগত সম্পত্তি মানুষকে শ্রমের মর্যাদা পুরোপুরি দেয় এবং শ্রমের মাধ্যমে উৎপাদিত বস্তু সমুদয়ের মধ্যে তার ব্যক্তিসত্তাকে সঞ্চারিত ও সম্প্রসারিত করে দেয়। শ্রমের মর্যাদা ও মূল্য নিরূপণ হয় তার উৎপাদিত বস্তুর মাধ্যমে। এভাবে পারিশ্রমিকও নির্ধারণ হয়ে থাকত।
সম্পত্তির পরিমাণ
জন লক বিশ্বাস করতেন যে, কোন লোকই সীমাহীনভাবে সম্পত্তি অর্জনের দাবি করতে পারে না। নষ্ট হোক বা অপচয় হোক এ উদ্দেশ্যে সৃষ্টিকর্তা কোন জিনিসই সৃষ্টি করেন নি। অত্রএব, অপচয় বা নষ্ট না করে মানুষ যে পরিমাণ সম্পত্তি তার জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় মনে করে সে পরিমাণ সম্পত্তি মানুষ ন্যায়সঙ্গতভাবে অর্জন করতে পারবে।
সম্পত্তির শ্রমতত্ত্ব
জন লক সম্পত্তির শ্রমতত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর মতে, সম্পত্তির উদ্ভবের পিছনে ব্যক্তি বিশেষের শ্রম নিহিত। শ্রমের সাহায্যেই কোন বস্তুর উৎপাদন বা সংগ্রহ সম্ভব। যতদিন মানুষ শ্রম নিয়োগ করতে শিখে নি ততদিন সম্পত্তির সৃষ্টি হয় নি।
শ্রমের মূল্যতত্ত্ব
জন লকের মতে, ব্যক্তির উৎপাদিত বস্তুর মাধ্যমে শ্রমের মূল্য নিরূপিত হয়। বস্তুর ব্যবহারিক মূল্য বৃদ্ধির জন্য ব্যক্তির শ্রমই দায়ী। ব্যক্তিগত সম্পত্তি মানুষের শ্রমের মর্যাদা বৃদ্ধি করে।
জন লকের সম্পত্তি তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য
জন লকের সম্পত্তি তত্ত্বে যেসব বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় নিম্নে সেগুলো উল্লেখ করা হলো-
১) সম্পত্তি মানুষের প্রকৃতিগত অধিকার।
২) সম্পত্তি মানুষের প্রয়োজনে সৃষ্টি হয়েছে।
৩) শ্রম মিশ্রিত করার ফলে যে সম্পত্তির সৃষ্টি হয় তা একান্তই ব্যক্তিগত।
৪) ব্যক্তিগত সম্পত্তি মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধি করে।
৫) সম্পত্তি অপচয়ের নীতি সম্পত্তির মাত্রা দ্বারা সীমাবদ্ধ।
৬) মানুষের ব্যক্তিগত প্রয়োজন মিটিয়ে যে উদ্বৃত্ত সম্পত্তি থাকে তা নিজের প্রাপ্য নয়, অন্যের প্রাপ্য।
৭) সম্পত্তি মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল করে তোলে।
৮) কোন চুক্তি ছাড়াই সম্পত্তি মানুষের অধিকারভুক্ত।