আধুনিক রাষ্ট্রতত্ত্বের ইতিহাসে টমাস হবসের সার্বভৌমত্ব সম্পর্কিত মতবাদ একটি উল্লেখযোগ্য অবদান। পঞ্চদশ শতকের ইতালির রাজনৈতিক অবস্থা যেমন ম্যাকিয়াভেলিকে নিরঙ্কুশ ও লৌকিক সার্বভৌমিকতার তত্ত্ব প্রচার করতে অনুপ্রানিত করেছিল ঠিক তেমনি সপ্তদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক গোলযোগ ও গৃহযুদ্ধের ঘটনা প্রবাহ টমাস হবসকে সার্বভৌমত্বের ধারণা প্রদান করতে মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি দিয়েছে।
হবসের সার্বভৌমত্ব তত্ত্বের উৎস
হবস যখন লেখনী ধারণ করেন তখন ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক আকাশে ছিল দুর্যোগের ঘনঘটা। সমগ্র ইংল্যান্ডে তখন রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা এবং গৃহযুদ্ধের আশঙ্ক্ষা বিরাজমান ছিল। এ দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিকে আয়ত্তে আনার জন্য হবস্ চূড়ান্ত এবং চরম ক্ষমতাসম্পন্ন সার্বভৌমর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। হবস্ বিশ্বাস করতেন যে, রাজনৈতিক অরাজকতা ও গৃহযুদ্ধ হতে ইংল্যান্ডকে বাঁচাতে হলে একটি শক্তিশালী কর্তৃপক্ষের সৃষ্টি করতে হবে।
হবসের সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞা
হবস্ তাঁর সার্বভৌম ক্ষমতার মিশ্ররূপ সংজ্ঞা প্রদান করতে গিয়ে বলেছেন, সার্বভৌম ক্ষমতা এমন এক ব্যক্তি বা ব্যক্তিমণ্ডলী যার কাছে জনসাধারণ নিজেদের মধ্যে সম্পাদিত পারস্পরিক চুক্তির মাধ্যমে তার যাবতীয় প্রাকৃতিক অধিকার সম্পূর্ণ করে দিয়ে তার যাবতীয় কাজকে তাদের নিজেদের কাজ বলে স্বীকার করে নেয়।
আরও পড়ুন: ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্র দর্শন ও রাজনৈতিক অবদান আলোচনা কর
হবসের সার্বভৌম তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য
হবসের সার্বভৌমত্ব তত্ত্বটি বিশ্লেষণ করলে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো লক্ষ্য করা যায়-
১. সার্বভৌম চুক্তির ফসল
সার্বভৌম যেহেতু চুক্তির ফসল, সেহেতু সার্বভৌম জনসাধারণের কোন ক্ষতি করছে তা বলা যাবে না। কারণ সার্বভৌম যা করছে তা প্রকারান্তরে জনগণ নিজেরাই করছে।
২. সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা
রাষ্ট্রের যে কোন কর্তৃপক্ষ সার্বভৌমর অধীন। অর্থাৎ, সার্বভৌম ক্ষমতা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা।
৩. চুক্তির ফলে উদ্ভূত
প্রকৃতির রাজ্যের অসহনীয় অবস্থার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য জনগণ নিজেদের মধ্যে চুক্তি সম্পাদন করে সার্বভৌমিকতার জন্ম দিয়েছে।
৪. সার্বভৌম আইনের উর্ধ্বে
হবস্ মনে করেছেন, সার্বভৌম শক্তিই আইন প্রণয়নকারী ও আইনের ব্যাখ্যাকারী। সার্বভৌমের আদেশকে জনগণ আইন বলে গ্রহণ করতে বাধ্য। সার্বভৌম শক্তির আদেশ অমান্য করার অর্থ হল আইন লঙ্ঘনকারী হিসেবে অভিযুক্ত হওয়া।
৫. সর্বপ্রকার নিয়ন্ত্রণমুক্ত
সার্বভৌম শক্তি অপ্রতিরোধ্য। প্রাকৃতিক আইন, ঐশ্বরিক, সামাজিক কিংবা নৈতিক আইনের ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করতে পারে। সার্বভৌম শক্তি তাই সব ধরনের নিয়ন্ত্রণমুক্ত।
৬. চিরস্থায়ী
সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ স্বীয় ক্ষমতা কারও নিকট হস্তান্তর করে না এবং কারো নিকট দায়ী থাকে না। এটি অপ্রতিহতভাবে প্রয়োগযোগ্য ও চিরস্থায়ী।
৭. সামরিকবাহিনী নিয়ন্ত্রণ
সার্বভৌম শক্তি রাষ্ট্রের সামরিকবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করে।
৮. কর আরাপ ক্ষমতা
সেনাবাহিনী বা পৌর প্রশাসনের ব্যয় নির্বাহের জন্য যে কোন কর আরোপ করার পূর্ণ ক্ষমতাও সার্বভৌমের হাতে ন্যস্ত।
৯. আদর্শ নীতির উপর ক্ষমতা
হবসের মতে, সার্বভৌম যদি মনে করে যে কোনও আদর্শ নীতি বা মতামত রাষ্ট্রের পক্ষে বিপজ্জনক হলে তিনি তা পর্যালোচনা করতে পারেন এবং প্রয়োজনবোধে তা বন্ধ করে দিতে পারেন।
১০. কর্মচারী নিয়োগ
রাষ্ট্রের সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারী নিয়োগের ক্ষমতা কেবলমাত্র সার্বভৌমত্বের হাতে ন্যস্ত থাকে। তাছাড়া খেতাব, সম্মান ইত্যাদি সার্বভৌমিকতার একমাত্র উৎস।
১১. শাসকের সার্বভৌম ক্ষমতা
শাসক সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী এবং রাষ্ট্রের পরিচালিকা শক্তি।
১২. জনগণের নিকট দায়ী নয়
সার্বভৌম শক্তি জনগণের নিকট দায়ী নয়। হবসের চুক্তির শর্তানুযায়ী সার্বভৌম শক্তি চুক্তির উর্ধ্বে। এ চুক্তি অনুযায়ী শাসক শাসিতের নিকট হতে ক্ষমতা লাভ করলেও তিনি শাসিতের নিকট দায়ী নন।
১৩. জনগণের ক্ষতি করতে পারে না
মানুষ নিজেদের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির মাধ্যমে সার্বভৌম শক্তির সকল কাজকে নিজেদের কাজ বলে স্বীকার করে নিয়েছে। তাই সার্বভৌম শক্তি জনগণের কোন ক্ষতি করতে পারে না।