দাস প্রথা সম্পর্কে এরিস্টটল
এরিস্টটল তার “The Politics” গ্রন্থে দাস প্রথা বা দাস তত্ত্ব সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। তিনি দাসদের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন, সমাজে কিছু লোক আছে যারা প্রজ্ঞার অধিকারী এবং এ প্রজ্ঞার বলে তারা শুধু আদেশ প্রদানেই সক্ষম। পক্ষান্তরে, সমাজে বেশিরভাগ লোক আছে যারা শুধু দৈহিক বলে বলীয়ান এবং এ দৈহিক বলের কারণে তারা শুধু কায়িক পরিশ্রমে সক্ষম। তাদের মধ্যে প্রজ্ঞার অভাব থাকায় তারা আদেশ প্রদানে অক্ষম, তাদের একমাত্র যোগ্যতা প্রজ্ঞাবানের আদেশ মান্য করে তদুনুসারে কাজ করে যাওয়া। তাঁর মতে, প্রথম শ্রেণীর লোকেরা হচ্ছে প্রভু এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর লোকেরা হচ্ছেন দাস। প্রভুরা যুক্তি বা আত্মার প্রতিনিধি আর দাসরা লালসা বা দেহের প্রতিনিধি। প্রভু ও দাসের মধ্যে এই সম্পর্ক হচ্ছে উত্তম ও অধমের সম্পর্ক।
দাস প্রথার শ্রেণীবিভাগ
এরিস্টটল দাস শ্রেণীকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন। যথা- প্রকৃতদাস ও আইনগত বা প্রথাগত দাস।
প্রকৃতিগত দাসরা ছিল সাধারণত জন্মভিত্তিক। আর আইনগত দাস প্রথা হল আইন বা প্রথার কারণে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হওয়া। যেমন- যুদ্ধবন্দি হিসেবে ধৃত হয়ে দাসত্ব বরণ করা।
দাস প্রথার পক্ষে যুক্তি
পৃথিবীতে সকল মানুষই শাসন করার ক্ষমতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না। তাদের মধ্যে কেউ শাসন করার এবং কেউ শাসিত হওয়ার ক্ষমতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে এটাই প্রকৃতির নিয়ম।
এরিস্টটল এর মতে, “আত্মার নিকট যেমন দেহ, বুদ্ধির নিকট ক্ষুধা, মানবের নিকট পশু, পুরুষের নিকট নারী, পিতার নিকট সন্তান অধীনস্থ, ঠিক তেমনি বুদ্ধি বিবর্জিত মানুষ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের অধীনস্থ।”
আরও পড়ুন: এরিস্টটলকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলা হয় কেন? রাষ্ট্রবিজ্ঞানে তাঁর অবদান
১. প্রকৃতির নিয়ম
সব মানুষ সমান বুদ্ধি মেধা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না। কিছু মানুষ নেতৃত্বের গুণাবলি নিয়েই পৃথিবীতে আসে, আর বেশিরভাগ মানুষ আসে জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদের আদেশ মানার জন্য। এটাই প্রকৃতির বিধান। এরিস্টটল বলেছেন, “জনগণ হতেই কেউ শাসন করার জন্য চিহ্নিত হয় এবং অন্যরা শাসিত হওয়ার জন্য।” তাই প্রকৃতির এই চিরন্তন বিধানের কারণে দাস প্রথা অবশ্যম্ভাবী।
২. কর্মসম্পাদনের হাতিয়ার
এরিস্টটল দাস প্রথাকে জীবন্ত সম্পদ এবং কর্মসম্পাদনের হাতিয়ার হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, “A slave is possession of his master and an instrument of action.”
৩. প্রভুর সুবিধার্থে
এরিস্টটল মনে করতেন যে, প্রভুদের কল্যাণার্থে দাস প্রথা গ্রহণযোগ্য। রাষ্ট্র পরিচালনার মত গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সম্পন্ন করার জন্য প্রভু শ্রেণীর অনেক সময় প্রয়োজন। যার দরুণ তাঁরা দৈহিক পরিশ্রমের কাজগুলো করতে পারে না এবং দাসের প্রয়োজন হয়।
৪. দাসদের মঙ্গলার্থে
এরিস্টটল বলেছেন, দাস প্রথা বজায় থাকা দাসদের জন্য মঙ্গলময়। কারণ দাসরা দৈহিক শক্তিতে বলীয়ান ও বুদ্ধিহীন। দাসরা বিবেকসম্পন্ন প্রভুদের দাসবৃত্তি করে পরোক্ষভাবে তাদের গুণাবলি দ্বারা উপকৃত হয়। এরিস্টটল তাই দাসদের মঙ্গলার্থে দাস প্রথার সমর্থন করেন।
৫. স্বাভাবিক নীতি অনুসারে
এরিস্টটল এর মতে, স্বাভাবিক কারণেই উৎকৃষ্ট অংশ নিকৃষ্ট অংশের উপর আধিপত্য ও প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে। কাজেই দাস শ্রেণী প্রভু শ্রেণীর অধীন কাজ করবে এটাই স্বাভাবিক।
৬. রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনে
দাস প্রথা বিদ্যমান থাকলে প্রভুগণ রাজনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক ক্ষেত্রে অধিক সময় ব্যয় করতে পারবেন। প্রভুদের রয়েছে মানুসক বল এবং দাসদের রয়েছে দৈহিক ক্ষমতা। সংসার পরিচালনায় উভয়বিদ ক্ষমতার প্রয়োজন হয়।
৭. বাস্তবতার কারণে
বাস্তবে দেখা যায় যে, এক শ্রেণীর লোক আর্থিক প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের অধিকারী এবং আর এক শ্রেণীর লোক অধিকতর দৈহিক শক্তির অধিকারী। মানব প্রকৃতির এ বৈষম্য প্রভু ও দাস শ্রেণীর অস্তিত্বের যথার্থতা প্রমাণ করে।