গ্রিক দার্শনিক প্লেটো তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “The Republic” গ্রন্থে একটি আদর্শ রাষ্ট্রের বর্ণনা দেন। তিনি তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের বর্ণনায় তাঁরই গুরু মহাজ্ঞানী সক্রেটিসের মূলনীতি “Virtue is knowledge” এবং “যা আদর্শ তাই বাস্তব” প্রভৃতি নীতি দ্বারা যথেষ্ট পরিমাণে প্রভাবিত হয়েছেন।
নিম্নে প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা প্রদান করা হলো-
ক) প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র তত্ত্ব
“সদগুণই জ্ঞান” এবং “ন্যায়ধর্ম জ্ঞান সমতুল্য” শিক্ষাগুরু মহাজ্ঞানী সক্রেটিসের এ মৌলিক সূত্র প্লেটোর চিন্তাধারায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। এ মৌলিক তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে প্লেটো তাঁর বিখ্যাত “The Republic” গ্রন্থে আদর্শ রাষ্ট্রতত্ত্ব আলোচনা করেন। তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রতত্ত্বের মূল বিষয় হল রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা এবং সুন্দর জীবনের বিকাশ সাধন করা।
প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে জনগণের প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি পারস্পরিক সম্পর্কের উপরও গুরুত্বারোপ করেছেন। তাঁর মতে, মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার বিভিন্নতায় এবং সেগুলোর পরিতৃপ্তির জন্য পারস্পরিক সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। তিনি আদর্শ রাষ্ট্রের পরিকল্পনায় বাস্তবতা এবং ঐতিহাসিক মতবাদের সাথে সমন্বয় সাধন করেন নি। এজন্য তিনি বলেছেন, “রাষ্ট্র একপ্রকার মনোজাত ফসল; এটা কোন চুক্তির ফল নয়।”
আরও পড়ুন: প্লেটোর শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা কর
খ) প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য
প্লেটো তাঁর রিপাবলিক গ্রন্থের মধ্যে যে আদর্শ রাষ্ট্রের চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন তার মধ্যে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য-
১) প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র একটি শ্রেণীভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। এ রাষ্ট্রের অধিবাসীরা প্রধানত তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত। এ শ্রেণীবিন্যাসকে বর্ণ ব্যবস্থার ন্যায় মনে হলেও আসলে তা নয়।
২) প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রকে শ্রমবিভাগ ও বিশেষীকরণের নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
৩) প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতা একমাত্র দার্শনিকদের হাতে ন্যস্ত থাকবে। অর্থাৎ দার্শনিক রাজাই হবেন শাসনক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। কারণ একমাত্র দার্শনিকরাই হচ্ছেন যথার্থ জ্ঞানের অধিকারী।
৪) প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রে শাসক শ্রেণীর জন্য কোনরূপ ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকতে পারে না। শাসক শ্রেণীর ব্যয়ভার বহন করবে সরকার।
৫) শাসক শ্রেণীর কোনরূপ স্থায়ী বৈবাহিক সম্পর্ক থাকবে না। সমাজে নিয়ন্ত্রিত জন্মদান পদ্ধতি প্রবর্তিত হবে।
৬) প্লেটোর কল্পিত আদর্শ রাষ্ট্রে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে। তবে তিনি উৎপাদকে শ্রেণীকে সাম্যবাদ থেকে মুক্ত রাখেন।
৭) প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রে নিয়ন্ত্রিত এক বাধ্যতামূলক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করেন।
৮) প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের প্রতিটি অংশ পরস্পরের সাথে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িত। মূলত প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র ছিল অবিমিশ্র অভিজাততন্ত্র।
৯) আদর্শ রাষ্ট্রে আইনের কোন প্রয়োজন নেই। এর রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা ব্যক্তিভিত্তিক, আইনভিত্তিক নয়।
১০) প্লেটো বলেছেন, “একমাত্র আদর্শ রাষ্ট্রে সর্বোত্তম ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত।”
১১) প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের স্থান ছিল না। কারণ তিনি এক মূর্খের শাসন মনে করতেন।
প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের কাঠামো
আদর্শ রাষ্ট্রের গঠনশৈলী বর্ণনা প্রসঙ্গে প্লেটো নিখিলবিশ্বে রাষ্ট্র ও ব্যক্তির একত্র মিলন ঘটিয়েছেন। তিনি মানব ব্যক্তিত্বের তিনটি উপাদানের কথা উল্লেখ করেন। এগুলো হল- যুক্তি, সাহস ও কামনাবাসনা। তাঁর মতে, মানুষ বা মানবাত্মার মধ্যে যুক্তিবাদিতা, সাহস ও কামনাবাসনা পরিলক্ষিত হয়। কেউ যুক্তির দ্বারা, কেউ সাহসের দ্বারা এবং কেউ আকাঙ্ক্ষা বা লালসার দ্বারা পরিচালিত হয়ে কাজ করে যায়। তবে সকলের কাজের ফলাফল এক নয়।
প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্রের কাঠামোকে তিনভাগে বিভক্ত করেন। যথা-
১) দার্শনিক রাজা বা শাসক শ্রেণী,
২) যোদ্ধা শ্রেণী, এবং
৩) উৎপাদক শ্রেণী।
নিম্নে এগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
১) দার্শনিক রাজা বা শাসক শ্রেণী
আদর্শ রাষ্ট্রের কাঠামোতে প্লেটো দার্শনিক শাসকদের স্থান দিয়েছেন সর্বোচ্চ আসনে। দার্শনিক রাজা বা শাসক হবেন সে ব্যক্তি যার ন্যায়ধর্ম, সৌন্দর্য এবং মিতাচার সম্পর্কে পূর্ণজ্ঞান থাকবে এবং যার কোন প্রকার লোভলালসা ও ব্যক্তিগত স্বার্থ থাকবে না। প্লেটোর মতে, রাষ্ট্রের শাসনভার জনগণের হাতে ন্যস্ত হওয়া উচিত নয়। কারণ গণতন্ত্র হল নিকৃষ্টতম সরকার। প্লেটো আরও বলেছেন, দার্শনিক শাসকগণ বা রাজাগণ শাসনকার্য পরিচালনার সময় কতকগুলো মৌলিক নীতি মেনে চলবেন। যথা-
প্রথমত, রাষ্ট্রের যাতে ঐশ্বর্যের প্রাচুর্য না ঘটে সেদিকে খেয়াল রাখবেন।
দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ যাতে নিজ আওতায় কাজ করে সেদিকে দৃষ্টি দিবেন।
তৃতীয়ত, রাষ্ট্রের আয়তন যাতে খুব বেশি না হয় সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। কারণ রাষ্ট্রের আয়তন বেশি হলে রাষ্ট্রীয় ঐক্য রক্ষা করা কঠিন হবে।
চতুর্থত, শিক্ষাপদ্ধতির যাতে কোনরূপ পরিবর্তন না হয় সেদিকে দৃষ্টি দিবেন।
প্লেটোর মতে, দার্শনিক শাসকগণ কোন আইনের দ্বারা আবদ্ধ নন। কারণ তাঁরা সর্বজ্ঞানী। যখন শাসক ন্যায়বান হবেন তখন আইন নিষ্প্রয়োজন। আবার যখন শাসক দুর্নীতিপরায়ণ হবেন তখনও আইন হবে নিরর্থক।
২) যোদ্ধা শ্রেণী
প্লেটো বলেছেন, শুধু রাজ্যের শাসনভার দার্শনিক রাজা বা শাসকদের হাতে ন্যস্ত হলেই চলবে না। আদর্শ রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষাও প্রয়োজন। সেজন্য প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকেও সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে হবে। রাষ্ট্র যাতে বাইরের কোন শক্তি দ্বারা আক্রান্ত না হয় সেজন্য দেশের প্রতিরক্ষার ভার এক সুনিপুণ যোদ্ধার উপর ন্যস্ত হওয়া আবশ্যক। এদের স্থান ঠিক দার্শনিক রাজাদের পরেই। যারা সাহস ও দৈহিক শক্তিসম্পন্ন তারাই এ শ্রেণীর উপযুক্ত। তারা কখনো ক্ষমতা লিপ্সু হবে না। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষাই তাদের প্রধান লক্ষ্য।
৩) উৎপাদক শ্রেণী
রাষ্ট্রের শাসক ও প্রতিরক্ষার সাথে সাথে রাষ্ট্রের প্রতিপালনও প্রয়োজন। দার্শনিক ও যোদ্ধ শ্রেণী রাষ্ট্রকে যথাক্রমে শাসন ও প্রতিরক্ষা করতে পারে, কিন্তু প্রতিপালন করতে পারে না। রাষ্ট্রকে চালানোর জন্য যথেষ্ট পরিমাণে উৎপাদিত দ্রব্য থাকা একান্ত প্রয়োজন। উৎপাদক শ্রেণী এসব দ্রব্যের যোগান দিবেন। রাজনৈতিক জীবনে তাদের কোন ভূমিকা থাকবে না।