ক্রিমিয়ার যুদ্ধ
উনিশ শতকের ইউরোপের ইতিহাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ক্রিমিয়ার যুদ্ধ । ১৮৪০ সালে লন্ডন কনভেনশনের পর ইউরোপে মোটামোটি শান্তি বজায় ছিল। কিন্তু রাশিয়া তুরস্ক সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে ইউরোপীয় শক্তিবর্গের মধ্যে বণ্টনের প্রচেষ্টা শুরু করলে ১৮৫৪ সালে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে। দুই বছর স্থায়ী এ যুদ্ধটি কৃষ্ণসাগরের উপকূলে ক্রিমিয়া উপদ্বীপে সংঘটিত হয় বলে এটি ক্রিমিয়ার যুদ্ধ নামে খ্যাত। ব্রিটেন ও ফ্রান্স নিজ স্বার্থে এ যুদ্ধে তুরস্কের পক্ষে যোগদান করে। এবং প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে এই যুদ্ধের অবসান ঘটে।
ক্রিমিয়া যুদ্ধের কারণ
ক্রিমিয়া যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পিছনে বিদ্যমান কারণসমূহের মধ্যে নিম্নোক্ত কারণগুলো উল্লেখযোগ্য।
১। ধর্মীয় কলহ
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের প্রাথমিক কারণ ছিল গ্রিক খ্রিস্টান ও ল্যাটিন খ্রিস্টান যাজকদের মধ্যে জেরুজালেমের পবিত্র স্থানগুলোর আধিপত্য নিয়ে দ্বন্দ্ব। যিশু খ্রিস্টের জন্মস্থান প্যালেস্টাইনে যে গির্জা নির্মাণ করা হয় এর চাবি উভয় দলের যাজকগণ দাবি করলে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটে। এ যুদ্ধে ধর্মীয় ব্যাপারটা ছিল উপলক্ষ মাত্র। প্রকৃতপক্ষে ইউরোপীয় শক্তিবর্গের নিজস্ব স্বার্থগত দ্বন্দ্বের ফলে এ যুদ্ধের প্রভাব প্রায় পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন: মহাদেশীয় ব্যবস্থা কি? নেপোলিয়নের মহাদেশীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কারণ
২। রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদ নীতি
রাশিয়ার আক্রমণাত্মক সাম্রাজ্যবাদ নীতিই ক্রিমিয়ার যুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল। রাশিয়ার জার প্রথম নিকোলাস তুরস্ককে ‘ইউরোপের রুগ্ন ব্যক্তি’ বলে ঘোষণা করে তুরস্ক সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে ইউরোপীয় শক্তিবর্গের মধ্যে ভাগ বাটোয়ার ফন্দি আঁটেন। রাশিয়ার এই সাম্রাজ্যবাদ নীতির কারণেরই ক্রিমিয়ার যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
৩। ফ্রান্স ও ব্রিটেনের স্বার্থ
ফ্রান্স ও ব্রিটেন নিজেদের স্বার্থের জন্য এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ফ্রান্সের সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন তার বৈদেশিক নীতি দ্বারা দেশের জনগণকে চমৎকৃত করার জন্য যুদ্ধনীতি গ্রহণ করেছিলেন। অন্যদিকে তুরস্ক সাম্রাজ্যের ভিতর দিয়ে ইংল্যান্ড ও ভারতের মধ্যে যোগাযোগের পথ ছিল। রাশিয়া তুরস্ক সাম্রাজ্যকে গ্রাস করলে ইংল্যান্ডের ভারতে আসার পথ বন্ধ হয়ে যাবে। তাই ইংল্যান্ড তুরস্কের পক্ষে সমর্থন দান করে।
৪। অস্ট্রিয়া ও সার্ডিনিয়ার স্বার্থ
রাশিয়া শক্তিশালী হয়ে উঠলে অস্ট্রিয়ার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। তাই অস্ট্রিয়া প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে যোগদান না করলেও ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সকে পরোক্ষ সমর্থন জানায়। অন্যদিকে সার্ডিনিয়ার প্রধানমন্ত্রী ক্যাভুর ইতালির স্বাধীনতা যুদ্ধে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সমর্থন লাভের আশায় এ যুদ্ধে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের পক্ষ অবলম্বন করে সৈন্যদল পাঠায়।
যুদ্ধের ঘটনা
গ্রিক খ্রিস্টান ও ল্যাটিন খ্রিস্টানদের ধর্মীয় দ্বন্দ্বে রাশিয়ার জার গ্রিকদের দাবি সমর্থন করে তুরস্কের সুলতানকে চরমপত্র দেন। কিন্তু তুরস্কের সুলতান জারের চরমপত্র অগ্রাহ্য করলে জার তুরস্কের বিরুদ্ধে সৈন্যদল পাঠায়। ফলে ক্রিমিয়া যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে। এ যুদ্ধের ঘটনাবলি নিম্নোক্তভাবে আলোচনা করা যায়-
১। রাশিয়া কর্তৃক মোলদাভিয়া ও ওয়ালাচিয়া দখল
তুরস্কের সুলতান রাশিয়ার চরমপত্রকে প্রত্যাখ্যান করলে রাশিয়ার সেনাবাহিনী মোলদাভিয়া ও ওয়ালাচিয়া দখল করে। রাশিয়ার এ আচরণ ইউরোপীয় শক্তিবর্গের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ইউরোপে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রিটেন, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া প্রভৃতি দেশ ‘ভিয়েনা নোট’ নামে রাশিয়ার কাছে এক শান্তি প্রস্তাব পাঠায়। কিন্তু রাশিয়া ‘ভিয়েনা নোট’ প্রত্যাখ্যান করলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠে।
Crimea: The Great Crimean War, 1854-1856
২। তুরস্ক কর্তৃক যুদ্ধ ঘোষণা
তুরস্ক মোলদাভিয়া ও ওয়ালচিয়া দখল করে নিলে ১৮৫৪ সালে তুরস্ক রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সিনোপ-এর নৌ যুদ্ধে রাশিয়ার নিকট তুরস্ক পরাজিত হলে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স তুরস্কের সাহায্যার্থে যুদ্ধে যোগদান করে। এ সময় অস্ট্রিয়ার প্রস্তাব অনুসারে রাশিয়া মোলদাভিয়া ও ওয়ালাচিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করলেও মিত্রশক্তি রাশিয়ার শক্তিকে খর্ব করার উদ্দেশ্যে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে। আলমার যুদ্ধে রুশ বাহিনী মিত্র বাহিনীর নিকট পরাজিত হলে মিত্রবাহিনী ক্রিমিয়া দখল করে নেয়। এরপর মিত্র বাহিনী রাশিয়ার ব্যুহ ভেদ করে সিবাস্তোপোল এর দিকে অগ্রসর হয় এবং ১৮৫৫ সালে সিবাস্তোপোল দখল করে নেয়। ইতিমধ্যে জার প্রথম নিকোলাস মৃত্যুবরণ করলে জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার সিংহাসনে আরোহণ করেন। ফলে ১৮৫৫ সালের ৩০ মার্চ প্যারিস সন্ধির দ্বারা যুদ্ধের অবসান ঘটে।