বিংশ শতাব্দীতে যে সকল মারাত্মক ও ধ্বংসাত্মক তত্ত্ব দানা বেধেছিল তাদের মধ্যে ফ্যাসিবাদ অন্যতম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে ইতালির বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী বেনেটো মুসোলিনির নেতৃত্বে ইতালিতে ফ্যাসিবাদ নামক প্রতিক্রিয়াশীল ভাবধারার বিকাশ ঘটে।
শাব্দিক অর্থে ফ্যাসিবাদ বা ফ্যাসিজম
ফ্যাসিজম (Facism) শব্দটি ল্যাটিন শব্দ (Fascio) থেকে এসেছে। এ শব্দটির অর্থ হলো এক বোঝা লাঠির সাথে একটি কুঠার। Fascio শব্দটি ছিল ঐক্য, সংহতি এবং কর্তৃত্বের প্রতীক। প্রাচীন রোমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতীকরূপে এক বোঝা লাঠির সাথে একটি কুঠার বাঁধা থাকত। সাধারণত শক্তিশালী কর্তৃত্ব বুঝাতে এটা ব্যবহৃত হতো।
ফ্যাসিবাদের সংজ্ঞা
ফ্যাসিবাদ একটি একনায়কতান্ত্রিক মতবাদ। এটি এমন এক মতবাদ যেখানে রাষ্ট্রই সর্বেসর্বা। এখানে ব্যক্তিস্বাধীনতাকে কোনো মূল্য দেওয়া হয় না। গণতন্ত্র বলতে ফ্যাসিবাদে কিছুই নেই। এখানে সবকিছুই করা হয় রাষ্ট্রের জন্য, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিছুই করা যায় না। এমনকি এ মতবাদ অনুসারে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে স্বাধীন চিন্তা ও মত প্রকাশ এবং সংগঠনের অধিকারও কারো থাকে না।
আরও পড়ুন: ত্রিশক্তি চুক্তি বা ত্রিশক্তি আঁতাত কি?
ইবেনস্টাইনের মতে, “ফ্যাসিবাদ হলো অন্ধ জাতীয়তাবাদী, জাতি-বিদ্বেষী, আগ্রাসী এবং সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত একদলীয় সরকার এবং সমাজের এক সামগ্রিকতাবাদী বা সর্বগ্রাসী মতবাদ।”
মরিস ক্রান্সটনের মতে, “ফ্যাসিবাদ হচ্ছে হেগেলের অধিবিদ্যামূলক চিন্তাধারা এবং সোরেলের সক্রিয়তাবাদী মতবাদের সমন্বয়।”
ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্য
ফ্যাসিবাদ কর্তৃত্ববাদী সরকারের একটা অভ্যুত্থান। শক্তিশালী কর্তৃত্ব বোঝাতে এটি ব্যবহৃত হয়। ১৯২২ সালে বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশৃঙ্খল পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে মুসোলিনি ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। এটি আদর্শ সাম্যবাদ, পুঁজিবাদ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও আন্তর্জাতিকতার বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদ। নিম্নে ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করা হলো-
১. গণতন্ত্র বিরোধী
ফ্যাসিবাদরে রাজনৈতিক দর্শনে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করা হয় না। ফ্যাসিবাদের মতে, গণতন্ত্র সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্টতম সরকার ব্যবস্থা। তাই তারা বলেন, জনগণ নয়, রাষ্ট্রই সার্বভৌমত্বের অধিকারী।
২. একদলীয় ও এক ব্যক্তি শাসন
ফ্যাসিবাদের এক ব্যক্তির শাসন ও একদলীয় শাসন ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। ফ্যাসিবাদের শ্লোগান হচ্ছে, এক দেশ, এক দল, এক আদর্শ ও এক নেতা।
৩. ব্যক্তিস্বাধীনতার বিরোধী
ফ্যাসিবাদ ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। এ মতবাদে বলা হয়, রাষ্ট্রের স্বার্থ সব স্বার্থের উর্ধ্বে। কাজেই রাষ্ট্রের স্বার্থে ব্যক্তির স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতে হয়। তাইতো ফ্যাসিবাদীরা বলেন, সবকিছুই রাষ্ট্রের জন্য, রাষ্ট্রের বাইরে বা বিরুদ্ধে কিছু নয়।
৪. সমাজতন্ত্র বিরোধী
ফ্যাসিবাদ সমাজতন্ত্রকে অস্বীকার করে। কেননা ফ্যাসিবাদীদের মতে, যেহেতু ব্যক্তিগত সম্পত্তি মানুষের কর্মোদ্যম বৃদ্ধি করে এবং পারিবারিক সম্পর্ককে সুদৃঢ় করে, সুতরাং তা বিলোপ করা উচিত নয়।
৫. সমরবাদী
ফ্যাসিবাদে সমরবাদকে বিশ্বাস করা হয়। তাইতো দেখা যায়, বিশ্বের প্রায় সকল ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রনায়কই যুদ্ধকে অপরিহার্য বলে মনে করতেন।
৬. এলিট শ্রেণীর শাসনে বিশ্বাসী
ফ্যাসিবাদ এলিট শ্রেণীর শাসনে বিশ্বাসী। তাদের মতে, এ পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ শাসন করার এবং কিছু কিছু মানুষ শাসিত হওয়ার জন্যই জন্ম নিয়েছে। মুষ্টিমেয় শক্তিশালী ব্যক্তির হাতে অধিকসংখ্যক জনগণ শাসিত হবে এটাই স্বাভাবিক।
৭. শান্তি ও আন্তর্জাতিকতার বিরোধী
ফ্যাসিবাদ শান্তি ও আন্তর্জাতিকার পরিপন্থী সমরবাদ ও সম্প্রসারণবাদে বিশ্বাসী। এ মতবাদ অনুসারে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের প্রধান কাজ হলো যেকোনোভাবে নিজের শক্তি বৃদ্ধি করা। জাতীয় রাষ্ট্রের গণ্ডি অতিক্রম করে অন্য রাষ্ট্র দখল করা রাষ্ট্রের কাজ।
৮. সাম্রাজ্যবাদী
ফ্যাসিবাদীরা উগ্র জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী হয়ে এ মতবাদের সমর্থক হিসেবে সাম্রাজ্য বিস্তারে প্রয়াসী হন।
৯. প্রচারতন্ত্রের একচেটিয়া ব্যবহার
ফ্যাসিবাদে জনসংযোগের মাধ্যমগুলোর উপর ক্ষমতাসীন সরকার একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে। সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমগুলোকে সরকারের প্রচারযন্ত্র হিসেবে একচেটিয়া ব্যবহার করা হয়।