Home » জুলাই বিপ্লব এর কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর
জুলাই বিপ্লবের কারণ ও ফলাফল

জুলাই বিপ্লব এর কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর

by TRI

জুলাই বিপ্লব

১৮৩০ সালের জুলাই মাসে ফ্রান্সে সংঘটিত হয় জুলাই বিপ্লব ।

নেপোলিয়নের পতনের পর ফ্রান্সের ক্ষমতায় বুরবোঁ রাজপরিবারকে পুনঃস্থাপন করা হয়। অষ্টাদশ লুইয়ের মৃত্যুর পর তার ভ্রাতা দশম চার্লস সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ রহিতকরণ, রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তিদান এবং নিয়মতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা অক্ষুণ্ণ রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু তিনি প্রতিক্রিয়াপন্থী এবং অষ্টাদশ লুইয়ের ঘোর বিরোধী ছিলেন। ফলে অল্পকালের মধ্যে তার বিরুদ্ধে জনগণের অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়। যার ফলশ্রুতিতে ১৮৩০ সালে জুলাই মাসে একটি বিপ্লব সংঘটিত হয় এবং দশম চার্লস ক্ষমতা থেকে অপসারিত হন। এ বিপ্লবকেই ফ্রান্সের ইতিহাসে জুলাই বিপ্লব নামে অভিহিত করা হয়।

জুলাই বিপ্লবের কারণ

জুলাই বিপ্লব ছিল ভিয়েনা কংগ্রেস ও ইউরোপীয় শক্তি সমবায়ের গৃহীত জাতীয়তাবোধ ও গণতন্ত্র বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে চূড়ান্ত প্রতিবাদ। এ বিপ্লবের পেছনে বেশ কিছু কারণ উল্লেখযোগ্য। নিম্নে সেগুলো আলোচনা করা হল-

১. দশ চার্লসের স্বৈরাচারী মনোবৃত্তি

জুলাই বিপ্লবের কারণ হিসেবে দশম চার্লসের স্বৈরাচারী এবং প্রতিক্রিয়াশীল মনোবৃত্তিকে দায়ী করা হয়। তিনি ক্ষমতায় আসীন হয়ে উগ্র রাজপন্থি নীতি গ্রহণ করেন এবং প্রাক-বিপ্লব যুগের স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের চেষ্টা করেন। দশম চার্লস ফরাসি বিপ্লবের রাষ্ট্রনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সকল পরিবর্তন নাকচ করে বিপ্লব পূর্ববর্তী যুগের স্বৈরাচারী, রাজতন্ত্র, অভিজাত প্রাধান্য, যাজক সম্প্রদায়ের ধর্মের নামে শোষণ পুনঃপ্রবর্তনে বদ্ধপরিকর হন। ফলে তার বিরুদ্ধে অচিরেই বিদ্বেষ দেখা দেয়। ফলশ্রুতিতে ‘জুলাই বিপ্লব’ সংঘটিত হয়।

ইংলিশে দুর্বলদের জন্য: সাইফুল ইসলাম - Englishe durbolder jonno English  Therapy: Saiful Islam

TK. 499

২. যাজক ও অভিজাত সম্প্রদায়ের প্রাধান্য

দশম চার্লসের আমলে যাজক ও অভিজাত সম্প্রদায়ের প্রাধান্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। বিপ্লবের সময় যে সকল অভিজাত ব্যক্তি তাদের সম্পত্তি হারিয়েছিলেন তাদেরকে উপযুক্ত ক্ষতিপূর্ণ দেওয়া হয়। যারা বিপ্লবকালে দেশান্তরিত হয়েছিলেন তারা ফিরে আসলে তাদেরকেও উপযুক্ত ক্ষতিপূর্ণ দেওয়া হয়। ফলে এ বিষয়ে আইনসভায় তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয় এবং দশম চার্লসের শাসনের বিরুদ্ধে সমালোচনা ব্যাপকতর হয়ে উঠতে শুরু করে।

৩. প্রতিনিধি সভায় উগ্র রাজতন্ত্রীদের আবির্ভাব

দশম চার্লসের সময়ে প্রতিনিধি সভায় রাজতন্ত্রীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়। ফলে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উগ্র রাজতন্ত্রীদের প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়। ১৮২২ সালে নতুন আইন দ্বারা সংবাদপত্রের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। শিক্ষার নিয়ন্ত্রণ যাজকদের হাতে চলে যায়। পরিবর্তনপন্থিদের বিরুদ্ধে দমননীতি গ্রহণ করা হয়। ফলে বিরোধী গোষ্ঠীরাও সংঘবদ্ধ হওয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকে এবং ইতালির কার্বোনারি আন্দোলনের ধাঁচে বিভিন্ন গুপ্ত সমিতি গড়ে উঠে।

৪. পলিগনাকের মন্ত্রী নিয়োগ

জুলাই বিপ্লবের অন্যতম আরেকটি কারণ পলিগনাক নামক এক ধুরন্ধরক কূটনৈতিককে মন্ত্রিপদে নিয়োগ দান। পলিগনাক ছিলেন অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল এবং ফরাসি জাতির মনোভাব সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। রাজার পরামর্শে পলিগনাক স্বৈরাচারী শাসন স্থাপনের উদ্দেশ্য চারটি ঘোষণা দেন, যার পর পরই প্যারিসে বিদ্রোহের সূত্রপাত ঘটে। উক্ত ঘোষণার দ্বারা- ক) ফ্রান্সের পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া হয়, খ) সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বিলোপ করা হয়, গ) সম্পত্তির ভিত্তিতে নতুন ভোটার তালিকা তৈরি করা হয়, ঘ) নতুন তালিকার ভিত্তিতে পার্লামেন্ট নির্বাচনের আদেশ দেওয়া হয়। এ ঘোষণার পরদিন অর্থাৎ ২৬ শে জুলাই, ১৮৩০ প্যারিসে বিদ্রোহ দেখা দেয়।

আরও পড়ুন:  কনসার্ট অব ইউরোপ কি?

জুলাই বিপ্লবের ফলাফল

আপাত দৃষ্টিতে ১৮৩০ সালের জুলাই বিপ্লব ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ ইতিহাসে তেমন কোনো ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারেনি সত্য। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ বিপ্লব ফ্রান্স এবং ইউরোপের ইতিহাসে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচনা করেছিল। নিম্নে জুলাই বিপ্লবের ফলাফল আলোচনা করা হলো-

ক) অভ্যন্তরীণ ফলাফল

জুলাই বিপ্লবের অভ্যন্তরীণ ফলাফলগুলো নিম্নরূপ-

১. শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন

জুলাই বিপ্লবের দ্বারা রাজতন্ত্রের অবসান না ঘটলেও গুরুত্বপূর্ণ শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন ঘটে। এতে সর্বপ্রকার আইনের প্রস্তাব উত্থাপন করার অধিকার একমাত্র প্রতিনিধি সভাকে প্রদান করা হয়।

২. মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রাধান্য

লুই ফিলিপের প্রশাসন মূলত মধ্যবিত্তের উপর নির্ভরশীল ছিল। জুলাই বিপ্লবের ফল মূলত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ভোগ করে এবং শাসনব্যবস্থায় প্রাধান্য বিস্তার করে। কারণ ভোটার হতে ২০০ ফ্রাঁ ও পার্লামেন্টের সদস্য হতে ৫০০ ফ্রাঁ কর দিতে হতো যা সাধারণ জনগণের সামর্থ্যের বাইরে ছিল।

৩. জনগণের সার্বভৌমত্ব নীতি গ্রহণ

জুলাই বিপ্লব ফরাসি শাসনব্যবস্থায় রাজার ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতানীতি চিরতরে লুপ্ত করে তদস্থলে জনসাধারণের সার্বভৌমত্ব নীতি গ্রহণ করা হয়। এবং বুরবোঁ রাজতন্ত্রের পতাকার স্থলে ফরাসি বিপ্লবের ত্রিবর্ণ পতাকা গৃহীত হয়।

৪. ন্যায্য অধিকার নীতি পরিত্যাগ

এ বিপ্লবের ফলে ভিয়েনা সম্মেলনে গৃহীত ‘ন্যায্য অধিকার’ নীতি পরিত্যাগ করা হয়। ‘ন্যায্য অধিকার’ এর স্থলে শাসন ক্ষমতার উপর স্থান পায় জনমত।

৫. নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা

এ বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। উগ্র রাজতান্ত্রিক এবং যাজক সম্প্রদায়ের প্রাধান্য ও তাদের প্রাক-বিপ্লব যুগের অবস্থা ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করা হয়।

৬. ফরাসি বিপ্লবের  পরিপূরক

জুলাই বিপ্লব ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের পরিপূরক হিসেবে বিবেচিত হয়। তখন হতে সাম্য, ধর্মনিরপেক্ষ শাসন, শাসনতান্ত্রিক স্বাধীনতা প্রভৃতি গণতান্ত্রিক নীতি স্থায়ী ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়।

খ) আন্তর্জাতিক ফলাফল

জুলাই বিপ্লব সমগ্র ইউরোপে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে। তৎকালেই জুলাই বিপ্লবের ফলাফল দাবাগ্নির মতো সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। এ বিপ্লবের আন্তর্জাতিক ফলাফলগুলো নিম্নরূপ-

১. বেলজিয়ামের স্বাধীনতা

জুলাই বিপ্লব বেলজিয়ামের স্বাধীনতা আন্দোলনকে উস্কে দেয়। বেলজিয়ামবাসীগণ ভিয়েনা সম্মেলনে গৃহীত অন্যায়মূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং হল্যান্ডের অধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ঐ বছরেই লন্ডন কনভেনশনে বেলজিয়ামের স্বাধীনতা ইউরোপীয় দেশগুলো স্বীকার করে নেয়।

২. জার্মানিতে গণ অভ্যুত্থান

জুলাই বিপ্লবের ফলে জার্মানিতে এক ব্যাপক গণজাগরণের সৃষ্টি হয়। স্যাক্সনি, হ্যানোভার, হেসি প্রভৃতি জার্মান রাজ্যসমূহে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা স্বীকৃত হয়। কিন্তু ইউরোপীয় কনসার্টের নেতা মেটারনিক অভ্যুত্থান দমন করে জার্মানিতে পুনরায় শান্তি স্থাপন করে।

৩. পোল্যান্ডের স্বাধীনতা ঘোষণা

জুলাই বিপ্লবের প্রভাবে রুশ অধিকৃত পোল্যান্ডে ব্যাপক গণজাগরণের সৃষ্টি হয়েছিল। তারা তাদের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য স্বাধীনতা ঘোষণা করে। তাছাড়া দীর্ঘ ছয় বছর রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত ক্ষান্ত হয়। পোল্যান্ড সরাসরি রাশিয়ার শাসনাধীনে আসে।

৪. ইতালির বিপ্লব

জুলাই বিপ্লবের প্রভাবে ইতালির পার্মা, মোডেনা, পোপের রাজ্য প্রভৃতিতে গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দেখা দিলে অস্ট্রিয়া একে কঠোর হস্তে দমন করে।

৫. পর্তুগাল ও স্পেনে বিপ্লবের প্রভাব

জুলাই বিপ্লবের প্রভাবে পর্তুগাল ও স্পেনের জনগণ গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা আদায় করতে সমর্থ হয়। বিপ্লরেব পূর্ব থেকেই স্পেনে স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছিল। জুলাই বিপ্লবের ফলে সে সুযোগ আরও বৃদ্ধি পায়।

৬. ইংল্যান্ডে প্রভাব

গণতান্ত্রিক ইংল্যান্ডেও জুলাই বিপ্লবের প্রভাব পড়ে। ফলে ইংল্যান্ডে ১৮৩২ সালে সংস্কার আইন ‍গৃহীত হয়। এবং সর্বাসাধারণের ভোটাধিকার প্রসারিত করা হয়।

Related Posts