Home » রুশোর সার্বভৌমত্ত্ব তত্ত্ব ব্যাখ্যা কর

রুশোর সার্বভৌমত্ত্ব তত্ত্ব ব্যাখ্যা কর

by TRI

সতেরো শতকের মধ্যভাগ থেকে আঠারো শতকের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত দীর্ঘ দেড়শ বছরের যে পর্ব, রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে তাকে সাধারণভাবে ‘যুক্তিবাদের যুগ’ বা ‘জ্ঞানালোক’ বলে অভিহিত করা হয়। এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক জ্যাঁ জ্যাক রুশো তার যেসব মতবাদ ও চিন্তাধারার বদৌলতে রাষ্ট্রদর্শনে স্থায়ী আসন লাভে সক্ষম হয়েছেন তন্মধ্যে সার্বভৌমত্ত্ব তত্ত্ব অন্যতম। এ তত্ত্বে রুশো সাধারণ ইচ্ছার সাথে রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতাকে শনাক্ত করেছেন। আর তা করতে গিয়ে তিনি হব্স এবং লকের সার্বভৌম তত্ত্বের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছেন।

রুশোর সার্বভৌমত্ত্ব তত্ত্ব

১৭৬২ সালে প্রকাশিত ‘The Social Contract’ গ্রন্থে রুশো তার সার্বভৌমত্ত্ব তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করেছন। তার মতে, সাধারণ ইচ্ছার বাস্তব প্রতিফলন বা প্রয়োগই হল সার্বভৌমত্ব। যে উদ্দেশ্য সাধনের জন্য রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে সে কাজ সাধারণ ইচ্ছা করবে। সামাজিক চুক্তির ফলে ব্যক্তিগত ইচ্ছা লোপ পেয়ে সামাজিক ইচ্ছা জাগ্রত হয়। আর এ ইচ্ছা যাদের দ্বারা প্রয়োগ করা হয় তারাই সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ। রুশোর সার্বভৌমিকতা সর্বাত্মকবাদ ও নিয়মতান্ত্রিকতার সংমিশ্রণ এবং এটা জনগণের কল্যাণকামী। রুশোর সার্বভৌমত্ত্ব তত্ত্বের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য নিম্নে প্রদত্ত হল-

১। হস্তান্তর অযোগ্যতা

রুশোর ভাষায়, “The moment a master exits, there is no longer a sovereign and from that moment the body politic bas ceased to exit.” সার্বভৌমিকতা অন্যের হাতে চলে গেলে এর আসল চরিত্র নষ্ট হয়ে যায়। এ কারণে রুশো সার্বভৌমিকতাকে হস্তান্তর অযোগ্য বলেছেন।

২। অবিভাজ্যতা

রুশোর সার্বভৌমিকতাকে টুকরো টুকরো করে ভাগ করা যায় না। ভাগ করার অর্থ একে ধ্বংস করা। সকল জনসাধারণের যে ইচ্ছার পেছনে সমর্থন আছে তাকেই সাধারণ ইচ্ছা বলে। রুশোর মতে, যারা সার্বভৌম শক্তিকে ভাগ করতে চান তাদের এ সম্বন্ধে সঠিক ধারণা নেই।

আরও পড়ুন:  জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচার বলতে কি বুঝ?

৩। চরমতা

রুশোর মতে, বিপথগামী ব্যক্তিকে সঠিক পথে আনার জন্য সাধারণ ইচ্ছার হাতে চরম ক্ষমতা থাকা খুবই বাঞ্ছনীয়। সার্বভৌম শক্তির চরমতা প্রসঙ্গে রুশো বলেন, সমস্ত শক্তি, বিষয়-আশয় ও স্বাধীনতা সমাজের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এগুলোর মধ্যে কোনটা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ তা কেবল সার্বভৌম শক্তিই বিচার করবে। সার্বভৌম শক্তির সিদ্ধান্তই চরম ও সবার পক্ষে মেনে চলা বাধ্যতামূলক।

৪। সার্বভৌম ক্ষমতা সীমাহীন

রুশোর সার্বভৌম ক্ষমতা নিজে অন্য আইন বা বিধি-নিষেধের দ্বারা সীমিত হতে পারে না ।বহিঃরাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে তার সার্বভৌম ক্ষমতা সম্পূর্ণ স্বাধীন ও বাধাবন্ধনহীন এবং অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে তা সকল নাগরিক ও সংস্থার উপর চরম কর্তত্বের অধিকারী।

৫। প্রতিনিধিত্বহীন

সার্বভৌমের বিশেষ কোনো ক্ষমতা তার এজেন্টদের দ্বারা সম্পাদিত হতে পারে। কিন্তু সার্বভৌমের নিজস্ব যে ইচ্ছা তার প্রতিনিধিত্ব ছাড়া অন্য কেউ তা করতে পারে না। রুশো বলেন, সার্বভৌমত্ব নিজে ছাড়া অন্য কেউ তার প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। সার্বভৌম সর্বাবস্থায়ই প্রতিনিধিত্বহীন।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা বলা যায় যে, রুশোর সার্বভৌমত্ব তত্ত্ব রাষ্ট্রের কর্তৃত্ববাদী চেহারাকেই তুলে ধরে। এইচ. জে. টোজার (H. J. Tozer) রুশোর সার্বভৌমত্বকে ‘অদূষণীয়, অবিচ্ছেদ্য, প্রতিনিধিত্বের অযোগ্য, অবিভাজ্য ও অবিনশ্বর’ বলে বর্ণনা করেছেন। বস্তুত, রুশোর মতে এ ধরনের সার্বভৌম ক্ষমতা সমগ্র জনগণের যৌথ সংস্থা ছাড়া অন্য কারো দ্বারা কার্যকরী হতে পারে না।

Related Posts