রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসের মধ্যে সম্পর্ক
রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসের মধ্যকার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি অপরিপূর্ণ। তাইতো জন শিলি বলেছিলেন, “Political science without history has no root and history without political science has no fruit.” আবহমান বিশ্বের অতীত ঘটনাবলির বিস্তারিত বর্ণনাই হচ্ছে ইতিহাস। আর রাষ্ট্রীয় ঘটনাবলির রাজনৈতিক আলোচনাই হল রাষ্ট্রবিজ্ঞান। নিম্নে এদের মধ্যকার সম্পর্ক বিস্তারিত আলোচনা করা হল-
১। উৎপত্তিগত সম্পর্ক
সমাজবিজ্ঞানের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ শাখা রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাস। এরা একই অখণ্ড সত্তা হতে সৃষ্টি। জর্জ সিমসন যথার্থই বলেছেন, “সামাজিক বিজ্ঞানগুলো একটি অখণ্ড সত্তা এবং এ অখণ্ডতা অকৃত্রিম।”
R. M. MacIver বলেছেন, সামাজিক বিজ্ঞানগুলোর মধ্যে কোন বাস্তব শারীরিক পৃথকতা নেই। Geer এর মতে, “The social sciences are essentially one.” সুতরাং বলা যায়, উৎপত্তিগত দিক থেকে উভয়ের মধ্যে গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান।
আরও পড়ুন: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাথে অর্থনীতির সম্পর্ক কী?
২। পরিচয়গত সম্পর্ক
অধ্যাপক E. M. White এর ভাষায়- “রাষ্ট্রবিজ্ঞান জ্ঞান-বিজ্ঞানের সেই শাখা; যা রাষ্ট্রের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ, স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করে।” অনুরূপভাবে প্রখ্যাত ঐতিহাসিকদের ভাষায়- ‘ইতিহাস হল আবহমান বিশ্বের অতীত ঘটনাবলি; যেমন- যুদ্ধ-বিগ্রহ, উত্থান-পতন, রাজ্য বিজয়, ঐতিহাসিক ঘটনাবলি ইত্যাদির বিস্তারিত বর্ণনা। অতএব, উভয়ের মাঝে পরিচয়গত সম্পর্ক বিদ্যমান।
৩। বিষয়বস্তুতে সম্পর্ক
ইতিহাস বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের স্বাধিকার আন্দোলন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠ ও রক্ষার আন্দোলন এবং এতে যারা অবদান রেখেছেন তাদের নিয়ে আলোচনা করা। যেমন- ঐতিহাসিক ফরাসি বিপ্লব, ইংল্যান্ডের বিপ্লব, বাংলা ভাষার আন্দোলন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ইত্যাদি ইতিহাস আলোচ্য বিষয়। তদ্রুপ রাষ্ট্রবিজ্ঞান এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা, পর্যালোচনা ও এসবের যথার্থ মূল্যায়ন করে থাকে।
৪। ইতিহাসে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপাদান
লর্ড এ্যাকটন বলেছেন- “The science of politics is the one science that is deposited by the stream of history like the grains of hold in the sands of a river.” অর্থাৎ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান এমন একটি সামাজিক বিজ্ঞান যার উপাদানসমূহ ইতিহাসের স্রোতধারায় বালুকণাসমূহের মধ্যে স্বর্ণরেণুর মত জমে উঠেছে। সুতরাং এর দ্বারা প্রমাণিত যে, ইতিহাসের মধ্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপাদান বিদ্যমান।
৫। ইতিহাস রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পূর্ণতা দানকারী
রাষ্ট্রবিজ্ঞান ঐতিহাসিক তথ্যাবলির ভিত্তিতে রাষ্ট্রতত্ত্বের কাঠামো গঠন করে থাকে। ইতিহাস থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রয়োজনীয় সূত্র বা তথ্য সংগ্রহ করে। রাষ্ট্র, রাষ্ট্রীয় আইনকানুন ও শাসনব্যবস্থার উত্থান-পতন সম্পর্কীয় জ্ঞান লাভ করতে ইতিহাসের শরণাপন্ন হতে হয়। এজন্য বলা হয়, ইতিহাস রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পূর্ণতা দানকারী। উইলোবীর ভাষায়, “ইতিহাসই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তৃতীয় মাত্রা সরবরাহ করেছ।”
৬। পরস্পর পরিপূরক
ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান পরস্পর সম্পূরক। একটিকে বাদ দিলে অন্যটি অপূর্ণাঙ্গ থেকে যায়। ঐতিহাসিক জন শিলির বক্তব্যে এ কথার যথার্থতা ফুটে উঠেছে, “Political science without history has no root and history without political science has no fruit.” অর্থাৎ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ছাড়া ইতিহাস ফলবিহীন বৃক্ষ আবার ইতিহাসবিহীন রাষ্ট্রবিজ্ঞান শিকড়বিহীন। বার্জেস এর ভাষায়, “উভয়কে পৃথক করা হলে ইতিহাসের মৃত্যু না হলেও বিকলাঙ্গ হবে এবং পৌরবিজ্ঞান হবে আলেয়ার মত আবছায়া ও অবান্তর।”
৭। পূর্বে অভিন্ন সত্তা ছিল
ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান পূর্বে অভিন্ন সত্তা ছিল। কালের বিবর্তনে এরা দু’টি শাস্ত্রে রূপ নিয়েছে। ম্যাকাইভারের ভাষায়- “It is the focus of interest which separates social science from the other.” সুতরাং উৎপত্তিগত দিক থেকেও ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান অভিন্ন।