সংগঠনের ভেতরে যোগাযোগ প্রবাহে সমস্যা থাকাটা স্বাভাবিক। কারণ, বহুসংখ্যক ব্যক্তির সমন্বিত ফল হলো সংগঠন। মানুষ মাত্রই ভূল করে। আর সংগঠন যেহেতু ব্যক্তি দ্বারা আবর্তিত একটি কর্মজাল, সেহেতু এখানে যোগাযোগ প্রবাহে সমস্যা আপনি-আপনিই তৈরি হয়ে যায়। সংগঠনের ভেতরে বিভিন্নভাবে বার্তা বা তথ্য প্রবাহিত হয়। নানা করাণে বার্তা উৎস থেকে গ্রাহক পর্যন্ত যেতে যেতে অবিকৃত রূপ হারিয়ে ফেলে।
যোগাযোগ প্রবাহে সমস্যা
সংগঠনের ভেতরে যোগাযোগ প্রবাহে সমস্যা দেখা দেয় বার্তার বিকৃতির মাধ্যমে। প্রেরিত বার্তা কাটছাঁট হয়ে যাওয়া কিংবা কিছুটা বর্জিতরূপ ধারণ করা ইত্যাদি সংগঠনের ভেতরে যোগাযোগ প্রবাহে সমস্যা তৈরি করে। আবার বার্তা কখনো অসম্পূর্ণ থেকে যায়, কখনো বা তথ্য ভারাক্রান্ত হয়ে যায়।
যোগাযোগ বিজ্ঞানী রিচার্ড এইচ হল তাঁর “Organizations: Structure and Process” বইতে সংগঠনের ভেতরে বার্তা প্রবাহের তিন ধরণের সমস্যার কথা বলেছেন। যথা-
১) বর্জন করা (Omission)
২) বিকৃতি ঘটানো (Distortion)
৩) অতিরিক্ত তথ্য (Overload)
আরও পড়ুন: সম্পাদকীয় লেখার কাঠামো কেমন হওয়া দরকার?
বর্জন করা (Omission)
সংগঠনের ভেতরে যোগাযোগ প্রবাহে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে তথ্যের কোন অংশ বাদ দিয়ে দেয়া হয়। এই ঘটনাকে Richard H. Hall তার ভাষায় Omission বা বর্জন বলেছেন। উর্ধ্বমুখী যোগাযোগের ক্ষেত্রে নিম্নস্তরের ব্যক্তিবর্গের তাদের ভূলত্রুটি, অন্যায়, ব্যর্থতা ইত্যাদি শাস্তির ভয়ে বাদ দিয়ে তথ্য সরবরাহ করে। এটি যোগাযোগ প্রবাহে একটি অন্যতম বড় সমস্যা। অনেক সময় নিম্নমুখী বা সমান্তরাল বার্তা প্রবাহেও বর্জনের ঘটনা ঘটে থাকে।
উদাহরণস্বরুপ বলা যায়- রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন দেশের কুটনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে অনেক বিষয়ে আলোচনা করে থাকেন। এর মধ্যে থাকতে পারে তাঁর পারিবারিক কিংবা ব্যক্তিগত কোন আলাপ। কিন্তু রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব বাইরে অপেক্ষমান সাংবাদিককে বলেন রাষ্ট্র ও দেশের উন্নয়ন চুক্তি সংশ্লিষ্ট কথগুলো। বাকি তথ্যগুলো এখানে বর্জন করা হয়।
বিকৃতি ঘটানো (Distortion)
যোগাযোগ প্রবাহে গেট কিপারের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গেট কিপিং এর কারণে তথ্যের বিকৃতি ঘটে। ফলে যোগাযোগ প্রবাহে সমস্যা সৃষ্টি হয়। এবং কখনো কখনো তা বর্জনে রূপ নিতে পারে। নানাভাবে তথ্যের বিকৃতি ঘটতে পারে। এরকম তিনটি কারণ হলো-
১) সমতা বিধান: একজন অন্যজনকে তথ্য দেয়ার সময় নিজের মতো করে দেয়। ফলে সে তথ্যের কঠিন ও দুর্বোধ্য অংশগুলো নিজের মতো করে বর্ণনা করে।
২) তীক্ষ্ণকরণ: কেউ কেউ তথ্যকে নিজের স্বার্থের অনুকূলে সূচারুরুপে বর্ণনা করে, ফলে মূল তথ্য বিকৃত হয়।
৩) সদৃশকরণ: কখনো কখনো মূল তথ্যকে নিজের মতো করে উপস্থাপন করতে গিয়ে তথ্য সম্পূর্ণ রূপে বিকৃত হয়ে যায়।
আবার লিখিত বক্তব্যের ক্ষেত্রেও তথ্যের বিকৃতি হতে পারে। যেমন- সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত গুলো ছাপানোর সময় প্রিন্টে ভূল হতে পারে বা এক কপি থেকে অন্য কপি লেখার সময় কোন অংশ বিকৃত হতে পারে।
অতিরিক্ত তথ্য
যোগাযোগ প্রবাহে অনেক সময় অতিরিক্ত তথ্য দিয়ে তথ্যের মূল প্রবাহ নষ্ট করে দেয়া হয়। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত তথ্য দিয়ে মূল তথ্যকে লুকানোর চেষ্টা থাকে।
উদাহরণস্বরূপ হিসেবে বলা যায়, কোন ব্যক্তি কোন অভাব বা অভিযোগের কথা এমডিকে বলতে গিয়ে তিনি যখন তার বোনের বিয়ের দাওয়াত দিয়ে দেন, তখন তার বক্তব্যটি তথ্য ভারাক্রান্ত হয়।
যোগাযোগে তথ্য প্রবাহের সমস্যার সমাধান
প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগে তথ্য প্রবাহের নানাবিধ সমস্যা থাকলেও সচেতনভাবে এগুলো এড়িয়ে যাওয়া যায়। যোগাযোগবিদ Dawn এ সকল সমস্যা সমাধানের তিনটি সম্ভাব্য উপায়ের কথা বলেছেন। যথা-
১) উৎসের তথ্যকে যাচাই বাছাই করা।
২) মধ্যস্থতাবাদ দিয়ে সরাসরি যোগাযোগ করা।
৩) বার্তাকে অবিকৃত রাখার চেষ্টা করা।
যোগাযোগবিদ Hage আরও একটি উপায়ের কথা বলেছেন- সংগঠনের বাইরের লোকদের মাধ্যমে নিজের সংগঠনের মূল্যায়ণ করার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা।
উপরোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করে সাংগঠনিক যোগাযোগে তথ্য প্রবাহের সমস্যাগুলো দূর করা যায়। এছাড়াও আরো কয়েকটি বিষয়ে সচেতনতা অবলম্বন করে এ সকল সমস্যা এড়িয়ে যাওয়া যায়। যেমন-
১) রাশভারী থেকে মুক্তি পেতে বাক্যের বা শব্দের পুনরাবৃত্তি করা। লিখিত বক্তব্যের ক্ষেত্রে সতর্কতার সাথে মূল বক্তব্য তুলে ধরা।
২) সভায় বা আলোচনায় সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। এতে প্রত্যেকে সমপরিমাণ তথ্য পাবে, ফলে তথ্য বিকৃতি বা হ্রাস-বৃদ্ধি বন্ধ হবে।
৩) তথ্যকে সকলের বোধগম্যভাবে প্রকাশ করা। কঠিন বা অজানা শব্দ বা বাক্য ব্যবহার না করা।
৪) তথ্যের মিথোজীবিতা রক্ষা করা। কথাশিল্পী আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন মিথোজীবিতার ধারণাটি ব্যাখ্যা করেন। এর মাধ্যমে সকল বক্তব্যই বোধগম্যভাবে প্রকাশ করা যায়।
৫) বহিঃস্থ সংগঠনের সাথে সম্পর্ক জোরদার করা। এতে করে সমালোচনা কম হয়। ফলে তথ্যের বিকৃত রোধ করা যায়।